ডিহি কলকাতার দিননামা

ছিদাম একটু অন্যমনস্ক হয়েছিল। আসলে ভাবছিল জটাকেশের কথা। একটা অদ্ভুত চরিত্র বটে। পোস্তার কাছে গড়ে ওঠা নতুন রাজবাড়ির বারমহলের যে খুপরি ঘরে ছিদাম মাথা গোঁজার ঠাঁই পেয়েছে, তার পাশের ঘরেই জটাকেশের ডেরা। হাবিজাবি আশ্চর্য সব জিনিসে জটাকেশের ঘর ভর্তি। ঘরের পাশে এক ফালি বারান্দায় ছোট ছোট খোপওয়ালা পাখির বড় খাঁচা। ছিদাম দেখেছে 
মাঝে মাঝে একটা দাঁড় কাক এসে জটাকেশের কাঁধে বসে।
তাকে কাঁধে নিয়ে জটাকেশ ঘুরে বেড়ায়। তারপর জটাকেশের হাত থেকে টুকটাক খাবার খেয়ে নিজেই উড়ে যায়।
পোস্তার নতুন রাজবাড়ীর বাইরের মহলে অনেক কাজের লোকের সঙ্গে অনেক বাজে লোকের ও আড্ডা। তাদের কেউ কেউ ছিদাম কে বলেছে জটাকেশ আসলে তান্ত্রিক।
ওই দাঁড় কাক নাকি আসলে কামাখ্যার কাক। 
ছিদামের অবশ্য এ সব বুজরুকি পেত্যয় যায় না।
তবু ছিদামের ধারণা জটাকেশকে কে ঘিরে কোন রহস্যময় ব্যাপার আছে। 
ছিদাম এসবসাতপাঁচই ভাবছিল।
এমন সময় কাঁধে হাত পড়তে চমকে ফিরে তাকায়। দেখে  সপ্তগ্রামের আড়ংএর কানাই।কানাই একগাল হেসে
বলে ,এসে পড়েচি। নিচে ঘাটের দিকে আঙুল নির্দেশ করে। 
ছিদাম তাকিয়ে দেখে ঘাটে মাল বোঝাই নৌকা নোঙ্গর করা রয়েছে। 
কানাই বলে চলো জোয়ার ঠেলে যেতে হবে। দেরি করে লাভ নাই। 
সুতানুটির  বড় ঘাটে লাগাতে হবে তো? গদি কিন্তু আমি চিনি নে।
ছিদাম বলে সে তোমায় ভাবতে হবে না। আমি তো আছি। তাছাড়া গুদামে মাল তুলবার জন্য বাবু লোক পাঠিয়ে রাখবে। 
তুমি তাকে গাঁটের হিসেব বুঝিয়ে দিলেই হবে।
দুজনে ঘাটের দিকে নামতে থাকে। একজন নৌকা থেকে এবার উঠে আসে। ছিদামের দিকে তাকিয়ে বলে, এই ভাইটি আমাদের নিয়ে যাবে নাকি? 
কানাই বললো,ও হচ্ছে যুধিষ্ঠির বৈরাগী। নৌকা নিয়ে এসেছে।
ওর সাগরেদ কালু নৌকাতেই আছে।
যুধিষ্ঠির দ্রুত নৌকা ছেড়ে দেয়। 
দুপাশে পরপর ঘাট সরে যাচ্ছে।
বড় বড় নৌকা বিস্তার মালামাল নিয়ে বড়বাজার আর চাঁদপাল ঘাটের দিকে যাচ্ছে। সাহেবদের কোম্পানি সেখানে মালামাল জমা করে বড় বড় গুদামে। কলকাতা সুতানুটি গোবিন্দপুর নএর গঙ্গার পারের চেহারা বদলে যাচ্ছে। মাল বলতে মূলত কাপড়। বাংলার সূক্ষ্ম কাপড়ের মেলা চাহিদা বিলেতে। বিলেতের মেমরা বাংলার সূক্ষ্ম কাপড়ের জন্য পাগল। এছাড়া আছে মশলা। মসলা অবশ্য একটা বড় অংশ এসেছে দক্ষিণের দেশ থেকে।আর গড়ে উঠছে লবণের গুদাম। যারা সমুদ্রের লোনা মাটি থেকে সারারাত জেগে জাঁক দিয়ে লবণ তৈরি করে উপকূল ভূমিতে, সেই মলঙ্গীদের নিংড়ে নিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা মুনাফা করছে কোম্পানির কর্তা আর তাদের দেশী এজেন্টরা। নতুন নতুন শব্দ হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ছে। মুন্সি গোমস্তা নায়েবের সঙ্গে এখন যোগ হয়েছে "এজেন্ট।"
নিমতলার ঘাট পেরিয়ে 
জোয়ার ঠেলে বেলা দ্বিপ্রহরের মধ্যেই, নৌকা সুতানুটির  ঘাটে এসে লাগলো। 
ঘাটে তখন মেলা হুড়োহুড়ি। কোন এক শেঠ গঙ্গাস্নানে এসে কাঙ্গালি ভোজন করাচ্ছেন। 
যুধিষ্ঠির তার শাগরেদ কে নিয়ে নৌকাতেই থেকে গেল খাবারের উদ্যোগ করতে। তাছাড়া বিদেশ বিভূঞ এ নৌকা ছেড়ে যাবে না।
মুটেদের দিয়ে গরুর গাড়িতে মাল চাপিয়ে সব মাল  সুতানুটিতে জায়গা মতো পৌঁছে ছিদাম কানাই কে বললো,
তুমি আমার ডেরাটা দেখে যাও। 
কারবারের যা অবস্থা তাতে তো মনে হচ্ছে পুরো কারবারটাই এদিকে চলে আসবে। আমার ডেরা চেনা থাকলে তোমার সুবিধেই হবে। আর দুপুরে আমার এখানেই দুগাল খেয়ে যাও। যুধিষ্ঠিররা স্থপাকে নিজেদের ব্যবস্থা নৌকাতেই করে নেবে।
শোভারামের  গুদাম থেকে পোস্তারঘাট বেশ কিছুটা পথ। 
তবে ছিদাম আর কানাই দুজনে গ্রামের মানুষ। দ্রুত পায়ে হেঁটে ছিদামের ডেরায় পৌঁছে গেল কিছুক্ষণের মধ্যেই।
রাজ বাড়ির চেহারা দেখে কানাই বললে এতো বেশ বড় মানুষের বাড়ি মনে হচ্ছে। ছিদাম বললে হ্যাঁ। নতুন হয়েছে। তারপর একটু গলা নামিয়ে বললে, মহাজনী কারবারে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ। মারাঠাদের সঙ্গে যুদ্ধের সময় কোম্পানি কেউ টাকা ধার দিয়েছিলো। এখন দিল্লির দরবার থেকে' মহারাজ' উপাধি আনিয়ে নিয়েছে। সাহেবদের ধরে।
কানাই বললে, শহর কলকাতায় এদেরই এখন রবরবা শুনেছি।
রানী ভবানী ,দেবী চৌধুরানী সব ফৌত হয়ে গেল। আর এলি-তেলিরা কলকাতায় রাজা মহারাজ হয়ে বসেছে।
# ##
খাওয়া-দাওয়ার পাট শেষ হলে 
কানাই ছিদাম কে বললো,
তুমি গদিতে খবর দিয়ে সন্ধ্যা নামার আগেই নৌকায় চলে এসো। কলকাতায় যখন এলামই। 
কালীঘাটটা একবার ঘুরেই যাব। 
বৈরাগীরও খুব ইচ্ছে।
তারপর একটু গলা নামিয়ে বললো, আসলে বৈরাগীর ইচ্ছে আজকে রাতটা কালীঘাটের ওই অসভ্য পাড়ায় "ইয়ে" দের সঙ্গে একটু কাটানোর। 
ভাইটি তুমিও থাকবে নাকি সঙ্গে? 
ছিদাম অস্থস্তিবোধ করে বললো,
আরে কানাই দা আমার এদিকে মেলা কাজ। তোমরা নিজেদের মতো ফুর্তিফার্তা করবে করো।
কানাই বললো ,সে ঠিক আছে। 
তবে  ফেলবার সময় গদিতে দেখা করে যাব। এখন তাহলে বিকেলের মধ্যে নৌকা ছেড়ে দি।আমাদের রাতে নৌকা নিয়ে যাওয়ার অভ্যাস আছে। তারপর আজ পূর্ণিমা। 
ভাটার টান শুরু হলে অসুবিধা থাকবে না।আর হ্যাঁ কালীঘাটের মন্দিরের নাকি এলাহি সংস্কার হচ্ছে?
তা পয়সাটা দিলে কে? 
ছিদাম বললো, ও তোমরা কালীপ্রসাদি হাঙ্গামা কথা শোনোনি? 
কানাই বললো, আরে আমি বলছি মন্দির সংস্কারের কথা। 
এর মধ্যে আবার হাঙ্গামার কথা এলো কোত্থেকে? 
ছিদাম বললো,
সে এক ভারি কেচ্ছর কিসসা।
তাহলে বলছি শোনো।

  • সুমিত চৌধুরী
  • পর্ব দুই