(১)
সিগারেটটা অ্যাশ-ট্রেতে চেপে ধরে শীর্ষ বলে ওঠে, “ঠিক এইভাবে ও ঘাড় গুঁজে দিয়েছে জানেন? বাঁচতে চায়নি, খুব রাগ আমার ওপর। কিন্তু বাইরেটা একেবারে তকতকে-ঝকঝকে। আজকাল আর ঝগড়া করত না, গলা জড়িয়ে আবদার…কিচ্ছু না…
আমাদের প্রথম দেখা এক বসন্তে। একটা বড়ো বেণী আর সাদা কালোয় মেশানো শাড়িতে ও চমৎকার। বিশ্বাস করুন, জাস্ট ভুলতে পারিনা। রাজকন্যার নায়িকা হয়ে তখন ও দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। সামান্য মেলামেশা, কয়েক কলি গান শুনেই মুগ্ধ আমি। জানালাম আমার অতীতের কয়েক টুকরো ঘটনা। আমি তিন বছরের ডিভোর্সি এবং আমার একটি পুত্র সন্তানও রয়েছে। ওর মা ওকে নিতে চায়নি। তাই রক্তিম এখন আমার কাছে। আমি বুঝতাম ছোট্ট রক্তিমের মা-র প্রয়োজন। আর আমার হয়তো ঠিক সহধর্মিণী নয়, একজন কাছের বন্ধু কোনো…।
আমাদের দুজনেরই বিয়ের ব্যাপারে কোনো সমস্যা হয়নি। শ্বেতা, রক্তিমকে পেয়ে খুশি হয়। বরং শ্বেতা আর রক্তিম এতই ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়ে, আমিই মাঝখান থেকে তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে যাই। আমি চেয়েছিলাম আমার আর শ্বেতার একটা সন্তান হোক। শ্বেতা চাইল না। মেনেও নিয়েছিলাম শ্বেতার ইচ্ছেটা। কী অদ্ভুত! একদিন নাটকের রিহার্সাল থেকে ফেরার পর সারা বাড়ি রক্তিমকে না পাওয়ায় শ্বেতা খেপে যায়। কাঁদতে শুরু করে। তারপর আস্তে আস্তে রক্তিমকে সিঁড়ি দিয়ে নামতে দেখে একছুট্টে কোলে তুলে নিয়ে বলে, “কখনো ছাদে যাবে না বাবা। কক্ষনো না। ছাদে জুজু থাকে।” রক্তিম তখন অনেকটাই বড় বুঝলেন, প্রায় সাত-আট হবে।”
টানা কথাগুলো বলে যাওয়ার পর শীর্ষ একটু মুখ তুলে তাকালো। স্বচ্ছ জলের গ্লাসটা শীর্ষর মুখোমুখি। ডাঃ চ্যাটার্জি একটা সিগারেট বাড়িয়ে বললেন, “নিন ধরিয়ে ফেলুন। বুঝলেন মশাই, এইটে না থাকলে আমাদের হার্ট অচল। আর যাই বলুন, স্বাস্থ্য সেবক হয়েও আমি সিগারেটের পক্ষে। তবে হ্যাঁ আমি অবশ্য মনোবিশেষজ্ঞ।” বলেই হা হা করে হাসি।
“শ্বেতা বারকয়েক সুইসাইডও করতে যায়। কারণ নাকি রক্তিম ওর বারণ সত্ত্বেও ছাদে চলে যায়। কী রকম পাগলামি ভাবুন তো একবার। ছাদ তো বাচ্চা থেকে বুড়ো সব্বার একলা কাটানোর জায়গা। সেই খোলা ছাদটার সঙ্গে রক্তিমের সম্পর্কটাকে মুছে ফেলার জন্য শ্বেতা একের পর এক দিব্যির পাহাড় জমায়। প্রথম দিকে কাজ হলেও, পরে রক্তিম শ্বেতাকে ফাঁকি দিতে শুরু করে। আর সেটাই স্বাভাবিক। ছেলে বড়ো হচ্ছে, দু-চারটে সিগারেট ফুঁকবে এটা খুব সহজ ঘটনা। তাই প্রয়োজনে ছাদে উঠবে। বাধা দেওয়ার-ই কী আছে আমার সহজ মাথায় ঢুকত না। এই নিয়ে স্বামী স্ত্রী তে আমাদের কথা কাটাকাটিও হয়েছে।
আমার সদ্য লেখা কবিতার প্রথম শ্রোতা ও পাঠক ছিল আমার বউ, মানে শ্বেতা। কবিতাটা ও ভালো বুঝত আর লেখাটা আমি পারতাম। কলেজ লাইফ থেকেই ছোটোখাটো পত্রিকা, তারপর আস্তে আস্তে নামকরা পত্রিকায় লেখার পাকাপাকি ঠিকানা। এই লেখার সুবাদেই অনেক মহলের মানুষজনের সঙ্গে আমার পরিচয়। তবে সেটা যে ধারাবাহিক সেটা আর বলব না। অনেক সমস্যা বুঝলেন।” ডাঃ চ্যাটার্জি, “কী সমস্যা?” “সমস্যা বলতে লড়াই শুধু লড়াই, এ-ওকে টেক্কা তো ও-ওকে ছক্কা দেওয়ার প্ল্যান কষছে সবসময়। পেরে উঠলাম না ছেড়ে দিলাম। ছুটতে ইচ্ছে হলো না-কো। এখন নিজের মতো লিখি। টাকা পয়সার অভাব আমার কোনোদিনই ছিল না, আজও নেই। একবার তো শ্বেতাকে না জানিয়েই মুম্বাই চলে যাই ঘুরতে। ১৬ দিন পর ফিরি বাড়ি। বাড়ি এসে আমার চেতনা হয়, আরে! আমি তো ১৬ দিন নিখোঁজ ছিলাম। কিন্তু শ্বেতা আমার বিষয়ে আগ্রহ দেখায়নি বিন্দুমাত্র। বুঝলাম রেগে আছে। স্বাভাবিকও। ঠিক এর দুই দিন পরেই আমাদের বিবাহবার্ষিকী। ঠিক করেছিলাম শ্বেতাকে একটা খুব বড়ো সারপ্রাইজ দেব। লোকজন পার্টি-ফার্টি একেবারেই আমার অপছন্দের। আমার নিজের হাতে বোনা গোলাপ দিয়ে সাজানো চারপাশটা আর মেঝেটাও লাল গোলাপের কার্পেট। গোলাপ ওর খুব পছন্দের, আর আমার তো সাদা ফুল। রাতটা ছিল অমাবস্যা, ঘুটঘুটে কালো। একটাও আলো জ্বালিনি কো। শ্বেতাকে ছাদে নিয়ে এলাম। চোখ চেপে ধরলাম। বললাম, এবার দেখো। ও তখন গোলাপের পাপড়ির ওপর দাঁড়িয়ে। আমি বুঝতে পারছিলাম ওর নরম দুটো সাদা পা কীরকম রাঙা হতে পারে। কিন্তু জানেন ও কথা বললো না একটাও। শুধু বলল নীচে চল, খুব অন্ধকার। আমি তো অবাক। কী হলো এটা!
একটা-একটা করে সুতো কেমন খুলো যাচ্ছে দেখছেন?
আজ সাড়ে ন মাস হতে চললো ও কোমায়। জানি মরে গেছে। তবুও বাঁচিয়ে রেখেছি কেন জানেন? শুধুমাত্র সত্যিটা জানতে চাই। কেন বলবে না ও আমায়? কীসের এত দূরত্ব? অভিমান? রক্তিম মাত্র একদিন দেখতে এসেছিল ওর মা-কে। কাচের ওপার থেকে চিৎকার করে বলেছিল যন্ত্রটা বন্ধ করে দাও, কোনো মানে হয় না স্বাভাবিক মৃত্যু থেকে আমার মা-কে বঞ্চিত করার।
কাল আমাদের ১৬তম বিবাহবার্ষিকী গেছে। কী মনে করে আমি কাল ছাদে যাই। দেখলাম আমার ছেলে রক্তিম আর ওর কোনো বান্ধবীর ঠোঁট জ্যোৎস্নায় মিশে গেছে। ওরা শুষে নিচ্ছে পৃথিবীর সকল আলোকে। খুব জোরে। আরো জোরে। কিন্তু পারছে না। কাব্যিক হয়ে পড়ছি বোধহয় ডাক্তার। এই সময় আমার খুব ভালো লেখা আসছে…।” ডাক্তার চ্যাটার্জি মুচকি হেসে কলম প্যাডটা এগিয়ে দিয়ে বললেন, “লিখে ফেলুন তবে। আমি নয় বাইরে…” “আহা! উপহাস করছেন মশাই! কবিত্ব কি অতই ছেলেমানুষী যতটা মনে করেন! বসুন বসুন।” ডাক্তার বললেন “আপনি বেশ আশ্চর্য।”
“আচ্ছা ডাক্তার আপনি কি মনে করছেন সত্যিই আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি? এই নিয়ে ছ-বার আপনার কাছে আসা হলো। প্রথম কয়বারের আসাটা অবশ্য আপনার সঙ্গে নেহাতই গল্প করতে আসতাম। আপনি খুব ভালো শোনেন। জানেন এটা আপনার মারাত্মক প্লাস পয়েন্ট।” ডাঃ চ্যাটার্জি একটা নম্র হাসি দিয়ে বললেন, “শোনাটাও একপ্রকার আর্ট। আপনি মানেন?” শীর্ষর গলায়, “হ্যাঁ মানি। আচ্ছা কী লাভ হচ্ছে আপনাকে আমার ব্যক্তিগত সুবিধা অসুবিধা জানিয়ে… উফ্! আমার মাথাটা কামড়ে উঠছে। কেমন যেন ঝাপসা লাগছে সব। কেন যে আমি ছবিটা মেলাতে পারছি না কিছুতেই…।”
“একটু জল খান। শান্ত হন। সব ছবি মেলে না মিঃ শীর্ষ বসু।” ডাক্তারকে থামিয়ে শীর্ষ বলল—“আমি বাড়ি যেতে চাই। প্লিজ। আজকের মতো নমস্কার।”
(২)
দু-তিন বছর আগে শ্বেতা একবার শীর্ষকে বলে, “এই, তুমি একটা ছাদের জীবনী লিখতে পারো না। আই মিন উপন্যাস?” ছাদের উপন্যাস! শীর্ষ বাঁকা হেসে বলে “তুমি কী মনে করো ছাদ বাংলাসাহিত্যে এতই ব্রাত্য?” বিছানায় শুয়ে শুয়ে শীর্ষ ভাবছিল কীভাবে মেলানো যেতে পারে ছাদের সঙ্গে শ্বেতার গল্পটাকে। শ্বেতার বিয়ের আগের জীবন নিয়ে শীর্ষ তেমন কিছুই জানেনি। বলা চলে জানতেও চায়নি। শ্বেতার আত্মীয় পরিবার সম্পর্কেও না। জানার প্রয়োজন হয়নিকো। শ্বেতা তখন স্বাবলম্বী ও যথেষ্ট আত্মসচেতন। আর ওর ভালোবাসায় কোনো ফাঁকি ছিল না। সেটাই শীর্ষর পক্ষে যথেষ্ট ছিল না কি? এমন সময় ভেজানো দরজাটা খুলে এগিয়ে এল রক্তিম। মুখটা কেমন উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। বাসি চুমুর দাগ এখনও রক্তিমের ঠোঁটে। স্পষ্ট গলায় রক্তিম বলল—“মা সেদিন ছাদ থেকে পড়ে যায়, মানে আত্মহত্যা, তুমি তো জানোই মানে, আমি তুমি সব্বাই জানি তাহলে এখনো কেন মা কে…” শ্বেতার আত্মহত্যার পর এই প্রথম ঠিকঠাক কথা বলল রক্তিম বাবার সঙ্গে।
“আমি জানি মা কেন এমন করল।” শীর্ষ—“কেন?” “তুমি ছাদে যে রকম আমায় আর মধুরিমাকে দেখেছিলে মা-ও দেখেছিল আমাদের। তুমি মানতে পারলে আর মা আমাদের মুহূর্তটাকে মানতে পারেনি।” “তুই কী করে জানলি তোর মা মানতে পারেনি?” “মা-মানতে পারলেও হয়তো খোলা ছাদটাকে আমাদের সম্পর্কর জন্য মেনে নিতে পারেনি। সব লেখা আছে মায়ের নাটকের খাতায়। যাকে আমরা হয়তো কখনো খুলে না দেখি মায়ের স্ক্রিপ্ট ভেবে।” পড়তে থাকে রক্তিম শব্দগুলো… “তিন বছরের সুহানকে আমি বাঁচাতে পারিনি। ওর ছোট্ট পায়ে চলতে চলতে কখন ন্যাড়া ছাদ বেয়ে গড়িয়ে গেল নীচে। আমি তখন বাবার বাড়িতে। আমার স্বামী মুম্বাই-এ। ওখানেই আমরা থাকতাম তিনজন। সুহান চোখ বন্ধ করে দিল। রিক্সাতে চাপিয়ে কোলে আঁকড়ে নিয়ে গেলাম হসপিটাল। রাস্তার লোকগুলো বলাবলি করছিল, মরে গেছে। কচি ছেলে আবার বাঁচে নাকি! মায়ের খেয়াল নেই বাপু। কি রকম মা দেখ। সুহান চোখ খোলেনি। আমিও আর মুম্বাই যাইনি। তারপর, আমার স্বামী দু-তিন বার খোঁজ করেছিল। আর নয়।” কয়েক পাতা বাদ দিয়ে… “রক্তিম এখন সুহানের বয়সী। সেই ছোট্টবেলা থেকেই রক্তিমকে আমি দুহাতে আঁকড়ে বাঁচিয়ে রেখেছি। বোধহয় ও আমার রক্ত নয় বলেই। রক্তিম আর খোলা ছাদ বেয়ে পড়বে না কোনোদিন। ও রেলিং দু-হাতে ধরতে শিখেছে। তারিখ ১২.০৩.২০২৪।”
পড়া শেষ হলে মিনিট দুই চুপচাপ থাকার পর রক্তিম আলো নিভিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
(৩)
শীর্ষ ল্যাপটপটা অন করে ডাঃ চ্যাটার্জিকে ইমেল করে, “কাল সাত বারের মতো আপনার কাছে যেতে হবে। একটা ভালো গল্প এসেছে বুঝলেন। শুভরাত্রি….”
ছাদ ও সমাপতন
অপর্ণা দাস
শান্তিনিকেতন
ফোন : ৬২৯৬৫৫৬৬০২
ইমেল : aparnadasvb@gmail.com