তন্ত্র মানবজীবনের সর্বাঙ্গীণ সাধনা। বিদ্যা-ছন্দ-বীর্য-শ্রী-সম্পদ-প্রতিষ্ঠা-অমৃত-অভয়ে জীবনকোরকের পূর্ণ বিকাশ সম্ভব হয়। একদিকে তন্ত্রে সূক্ষ্ম ভোগ, যোগৈশ্বর্য এবং ইচ্ছাশক্তির অপূর্ব বিকাশ, অন্যদিকে তন্ত্রসাধককে ব্রহ্মভূমিকায় প্রতিষ্ঠা দেয়। তন্ত্রসাধনায় জ্ঞান, শ্রী ও আনন্দ, সকল উন্মেষ শক্তিকে স্বীকার করেই হয়। তন্ত্র শক্তিসর্বস্ব। এই শক্তি অপূর্বতা প্রকাশক– তামসিকতার আবরণমুক্ত সত্তার ঊর্ধ্ব-মধ্য-নিম্নগ্রাম শক্তির স্পন্দনে ঝঙ্কৃত, এবং আলোকসম্পাতে দীপ্ত ও স্বচ্ছ হয়। সমস্ত সত্তাকে দীপ্ত, ক্রিয়াশীল করা তন্ত্রের একমাত্র লক্ষ্য না হলেও তা তান্ত্রিক সাধনার আনুসঙ্গিক ফল। জীবনবেদীতে সত্য ও শক্তির প্রতিষ্ঠা, জীবনবাদের পূর্ণ স্বীকৃতি ও আহ্বান তন্ত্র সাধনার বিশেষত্ব। জীবনের তুচ্ছ বা মহান– কোন বিকাশকই তন্ত্রে অনাদৃত নয়। বস্তুত জীবন শক্তিতেই ধৃত ও পুষ্ট এই শক্তির আহ্বানে জীবনের অস্ফুট বিকাশকে স্ফুট, অরমণীয় বিকাশকে রমণীয় করে তুলে পূর্ণ জীবনের আহ্বান তন্ত্রের পরমাকর্ষণ। তন্ত্রের দৃষ্টিতে এই মূলীভূত শক্তি সৃষ্টির সকল পর্যায়ে কার্যকরী। মহেন্দ্রনাথ সরকার তন্ত্রের আলো-য় (২০০৬) তন্ত্রসাধনায় পূর্ণনিয়তি জীবনের স্বাধীন গতি, শক্তির সঙ্গে একৈকানুভূতিতে দিব্যমহিমা, জ্ঞান ও সত্তার প্রাপ্তির কথা বলেছেন। স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ তন্ত্রে তত্ত্ব ও সাধনা, (১৯৮৮) তন্ত্রকে তত্ত্ব ও মন্ত্রের বিষয় নির্ধারক রূপে বর্ণনা করেছেন। ‘তত্ত্ব’ শিব-শক্তি তত্ত্ব এবং প্রকৃতিতত্ত্বের পারে পুরুষতত্ত্ব। পুরুষের পাঁচটি কঞ্চুক বা উপাধি (আবরণ)– কলা, রাগ, বিদ্যা, কাল ও নিয়তি। এই উপাধিগুলি কার্যমায়া থেকে জাত, কার্যমায়া থেকেই ভ্রমের সৃষ্টি। এই ভ্রমই শক্তিকে শিব থেকে বিচ্ছিন্ন করে। কার্যমায়ার পারে কারণমায়া শুদ্ধবিদ্যা (জ্ঞান)। এই শুদ্ধবিদ্যারূপ জ্ঞান থেকে ‘অহং’ ও ‘ইদং’– বিষয় ও বিষয়ী সম্বন্ধে অভিজ্ঞান জন্মায়। অহং ও ইদং অথবা অহন্তা ও ইদন্তা জ্ঞানের বিশ্লেষণই শিব বা ঈশ্বরজ্ঞানের উপলব্ধি আনে। ঈশ্বরজ্ঞান ও ঈশ্বরতত্ত্বজ্ঞান একই। ঈশ্বরতত্ত্বজ্ঞানে ইচ্ছাজ্ঞান ক্রিয়াময়ী বিমর্শশক্তি মহাপ্রকৃতি এবং প্রকাশময় শিব যে এক ও অভিন্ন এই সাম্যরসোপলব্ধির দ্বার উন্মুক্ত করে। এই উপলব্ধি তন্ত্রে মুক্তি, কৈবল্য বা নির্বাণ। মহামহোপাধ্যায় গোপীনাথ কবিরাজ তান্ত্রিক সাধনা ও সিদ্ধান্ত (১৯৮৩) গ্রন্থে বলেছেন যে মুখ্যত শক্তির উপাসক শাক্ত আর শাক্তের আধার তন্ত্র। তন্ত্রের প্রধান শক্তি বা প্রাণ হল মহামাতৃকা। মাতৃকা তথা মায়া হলো সৃষ্টি এবং মহামাতৃকা তথা মহামায়া বিশ্ব সৃষ্টিকারী, বিশ্বজননী। ইদং জগতের মধ্যে অহং চেতনার ক্রমোন্নতিতে দেহ এবং মনের নিশ্চল অবস্থায় পরমশিবত্বলাভ বা সিদ্ধি ঘটিয়ে সাধক চতুর্বর্গ লাভ করেন। জরা-ব্যাধি-রোগ-শোক-মৃত্যু প্রভৃতি ভূমাজগৎ থেকে মন মুক্ত হয়ে চৈতন্য তথা মোক্ষলাভের কারণে ভাগবতী সৃষ্টি এবং প্রেমময় জগতের আবির্ভাব ঘটে। সাধককে তা এক অপার্থিব আনন্দময় অনুভূতির জগতে নিয়ে যায়। এই আনন্দময় মনোজগতের শক্তি মোক্ষদা বা আনন্দময়ীরূপে শাক্ত সাধকের কাছে প্রতিভাত হয়। শাক্ততন্ত্রে এটি সাধকের চরমতম সাধ্যবস্তু। বৌদ্ধতন্ত্রে এটি মহাসুখলাভ। পরমশিবত্বলাভ শাক্ততন্ত্রের আধ্যাত্মিক মত ও দর্শনের মূলকথা। পরমশিবত্ব শব্দবন্ধের পরিভাষিক নাম যামল। পুরুষ ও প্রকৃতির যুগ্মসত্তা অর্থাৎ শিব ও শক্তির যুগ্মভাব বা অবিনা বা অদ্বৈতভাব অর্ধনারীশ্বর সত্তা শাক্ততন্ত্রের ইপ্সিত লক্ষ্য। শৈব, শাক্ত, বৈষ্ণব তন্ত্রসাধনতত্ত্বের সারকথা পুরুষ-প্রকৃতির অদ্বৈতযুগল রূপ। সুতরাং, জাত-পাত-লিঙ্গ-দেবদেবী প্রভৃতি খণ্ডিত চেতনার উর্ধে ঈশ্বরের অদ্বৈত বা যুগ্ম অবস্থান একাধারে পরমশিব ও পরাশক্তির তত্ত্ব। সহজিয়া বৈষ্ণবধর্ম দর্শনের ‘যুগল সাধনা’ বা সহজিয়া বৌদ্ধধর্মের ‘যুগনদ্ধ’ – শাক্ততন্ত্রের ‘যামল’ পরিভাষার প্রকারভেদ মাত্র। চর্যাপদ থেকে শৈব, শাক্ত ও সহজিয়া বৈষ্ণব পদাবলীতে তন্ত্রভাবনার বিচিত্র প্রকাশ ঘটেছে। তন্ত্রনির্ভর গবেষণা সাহিত্যের কথা বাদ দিলে বাংলা কথাসাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যেয়ের (১৮৩৮–১৮৯৪) কপালকুণ্ডলা-য় (১৮৬৬) তন্ত্র আধারিত বাংলা কথাসাহিত্যের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের (১৮৭৬–১৯৩৮) দেনাপাওনা-য় (১৯২৩) ষোড়শী ভৈরবীর কথা স্মরণযোগ্য। তন্ত্র আধারিত ছোটগল্পের জন্যে সর্বাপেক্ষা খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৮৯৪–১৯৫০) ‘তারানাথ তান্ত্রিকের গল্প’ ও ‘তারানাথ তান্ত্রিকের দ্বিতীয় গল্প (মধুসুন্দরী দেবির আবির্ভাব’) ও ‘রঙ্কিণীদেবীর খড়্গ’ অবিস্মরণীয় হয়ে রয়েছে। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৮৯৮–১৯৭১) অনেকগুলি ছোটগল্প ‘সর্বনাশী এলোকেশী’ (উপাসনা, পৌষ ১৩৩৯), ‘খড়্গ’ (ভারতবর্ষ, আশ্বিন ১৩৪০), ‘ছলনাময়ী’ (বঙ্গশ্রী, মাঘ ১৩৪০), ‘ট্যারা’ (প্রবাসী, মাঘ ১৩৪০), ‘পুত্রেষ্টি’ (প্রবাসী, শ্রাবণ ১৩৪২), ‘প্রতিধ্বনি’ (প্রবাসী, আষাঢ় ১৩৪৩), ‘চণ্ডী রায়ের সন্ন্যাস’ (দেশ শারদীয়া, ১৩৪৩), ‘রায়বাড়ি’ (ভারতবর্ষ, অগ্রহায়ণ ১৩৪৩), ‘ট্রিটি’ (শনিবারের চিঠি, আশ্বিন ১৩৪৬), ‘ডাইনী’ (প্রবাসী, আষাঢ় ১৩৪৭), ‘এক রাত্রি’ (শনিবারের চিঠি, কার্তিক ১৩৪৭), ‘ডাইনী’ (মৌচাক, বৈশাখ ১৩৫৮), ‘প্রহ্লাদের কালী’ (শিলাসন, মাঘ ১৩৫৮), ‘শঙ্করীতলার জঙ্গলে’ (যুগান্তর, পূজাসংখ্যা ১৩৭৩), ‘সখী ঠাকরুন’ (আনন্দবাজার পত্রিকা, পূজাসংখ্যা ১৩৭৭), প্রভৃতি গল্প ও রাধা (১৯৫৯) উপন্যাসে তন্ত্রাচারের সার্থক সাহিত্যিক রূপায়ণ লক্ষ করা যায়। তারাপ্রণব ব্রহ্মচারী (১৮৯৮–২০০৪) রচিত অসংখ্য তন্ত্র আধারিত উপন্যাসের মধ্যে তান্ত্রিকসাধনা ও তন্ত্রকাহিনী (১৩৪১), আবার আমি (১৩৫৭), সুদূরতম (১৩৫১), আজও যা ঘটে (১৩৬২), অনজান (১৩৬৩), সে কি এলো ফিরে (১৩৬৪), তন্ত্রতপস্যা (১৩৬৮), অবিশ্বাস্য (১৩৬৯), মম-অন্তর (১৯৬৩), তন্ত্র-প্রভাব (১৩৭০) সীমান্তের সুর (১৩৫৪), যক্ষিণী (১৩৬৪), নীল সায়রে (১৩৬৬), সনিচরি (১৩৬৮), তনুমন (১৩৭২) উল্লেখযোগ্য। গজেন্দ্রকুমার মিত্রের (১৯০৮–১৯৯৪) সাধুসঙ্গ (১৩৬৭) গ্রন্থে তান্ত্রিক সাধুসঙ্গের অনেকগুলি কাহিনি স্থান পেয়েছে। কালিকানন্দ অবধূত (দুলালচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, ১৯১০–১৯৭৮) শুভায় ভবতু (১৩৬৪) ও ক্রীম (১৩৬৬) ছোটগল্পগ্রন্থে যেমন তন্ত্রের ব্যাপক প্রস্থানভূমি রয়েছে; তেমনি দেবারিগণ (১৯৫৯), তাঁহার দুই তারা (১৯৫৯), উদ্ধারণপুরের ঘাট (১৩৬৩), সাচ্চা দরবার (প্রকাশকালহীন), বশীকরণ (১৩৬৩), বহুব্রীহী (১৩৬৪), কলিতীর্থ কালীঘাট (১৩৬৫), পিয়ারী (১৩৬৮), টপ্পা ঠুংরী (১৯৬৯), কৌশিকী কানাড়া (১৩৭০), দুর্গম পন্থা (১৯৬১) প্রভৃতি উপন্যাসে ও মরুতীর্থ হিংলাজ (১৩৬২), হিংলাজের পরে (১৯৬২), নীলকণ্ঠ হিমালয় প্রভৃতি ভ্রমণকাহিনি তন্ত্রময় বলা চলে। প্রমোদকুমার চট্টোপাধ্যায়ের (১৮৮৫–১৯৭৯) গল্পগ্রন্থ পঞ্চমা (১৯৫৪) ছাড়া তাঁর লেখা ভ্রমণকাহিনি হিমালয়ের পারে কৈলাস ও মানস-সরোবর (১৩৫৫), হরি যাকে রাখেন (১৩৫৬), যমুনোত্তরী হতে গঙ্গোত্তরী ও গোমুখ (১৯৫০), হিমালয়ের মহাতীর্থে (১৯৫০), একাল ও সেকাল (১৩৫৮), জলাধারের অন্তরীক্ষ (১৩৬০), তন্ত্রাভিলাষির সাধুসঙ্গ (১৩৬৫), অবধূত ও যোগিসঙ্গ (১৩৬৭) ও স্মৃতিকথা প্রাণকুমারের স্মৃতিচারণ (১৩৬৭) প্রভৃতিতে তন্ত্রের প্রেক্ষাপট সর্বজনবিদিত। তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৯৪৭–২০১০) তারানাথ তান্ত্রিক (১৩৯২) গল্পগ্রন্থ ও অলাতচক্র (২০০৩) উপন্যাসে বিভূতিভূষণের উত্তরাধিকার রক্ষিত হয়েছে। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাপ্রণব ব্রহ্মচারী, কালিকানন্দ অবধূত, প্রমোদকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ সাহিত্যিক ব্যক্তিগত জীবনে তন্ত্রসাধক হওয়ায় তাঁদের লেখা একদিকে যেমন ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাজাত, তেমনি রসোত্তীর্ণ।
তন্ত্রবিষয়ক কথাসাহিত্যের ধারায় সৌরীন্দ্রমোহনের তান্ত্রিকদের বিচিত্র কাহিনী (১৩৫৪) শিশির পাবলিশিং হাউস, ২২/১, বিধান সরণী, কলিকাতা-৬ থেকে প্রকাশিত হয়। গ্রন্থ থেকে প্রাপ্ত তথ্য হল – “তপনকুমার মিত্র, কর্তৃক কলিকাতা, ২২/১, বিধান সরণীস্থ। শিশির পাবলিশিং হাউস স্থানে অবস্থিত শিশির পাবলিশিং হাউস হইতে প্রকাশিত ও উক্ত স্থানে অবস্থিত শিশির প্রিণ্টিং ওয়ার্কস্ হইতে মুদ্রিত।” তন্ত্র সম্পর্কে মানুষের আকর্ষণ অমোঘ। নিন্দা হোক বা প্রশংসা, ভীতি বা উৎসাহ – সবক্ষেত্রেই তার প্রতি মানুষের বক্তব্যের অন্ত নেই। ‘শব-সাধন’ গল্পে স্পিরিটের সঙ্গে ইহলোকের জীবের সংযোগসাধনের কথাপ্রসঙ্গে বাণমারা, তন্ত্রমতে শবসাধনার কথা এসেছে। বাণমারা প্রসঙ্গে জরুরি সতর্কতা বার্তাও উঠে এসেছে – “বাণ মারলে মুখ দিয়ে ঝলকে ঝলকে রক্ত উঠে মানুষ মারা যায়! অবষ্য তা করলে যাদুকরের অমঙ্গল একদিন হবেই।” পিশাচসিদ্ধ বা বেতালসিদ্ধ হওয়ার পিছনে মূলত মানুষের স্বার্থের তাড়না – বিপুল ক্ষমতা, ইন্দ্রিয় সম্ভোগ বা প্রতিহিংসা চরিতার্থ থাকে। হিন্দু শবসাধনার রেখাচিত্র কথক দিলেও গল্পের মূল আকর্ষণ অন্য। হিন্দু শব-সাধনার মতো অন্য জাতিরও অনুরূপ ব্যবস্থার মিল কথক তুলে ধরতে ‘মুশ্লিম কালচার’-এর পারস্যের একটি কাহিনি তুলে ধরেছেন। সাধনায় কী কী বাধা আসতে পারে পূর্বজ্ঞাত হয়েও মৃতামায়ের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে প্রায় সাফল্য পেতে চলা সাধনাকে সহকারী কীভাবে পণ্ড করে দেন – এ কাহিনি সেই ব্যর্থতাকে একদিকে যেমন তুলে ধরে, তেমনি লোকান্তরিত মায়ের প্রতি ভালোবাসাও এতে ব্যক্ত হয়েছে।
সৌরীন্দ্রমোহনের গল্পে তন্ত্রশাস্ত্র ও তান্ত্রিক সম্বন্ধে ভ্রান্তি অপোনদনের চেষ্টা দেখা যায়। তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে পণ্ডিত ধর্মানন্দ মহাভারতীর প্রত্যক্ষ করা তন্ত্রশক্তির অলৌকিক বিবরণের উল্লেখ করেছেন। ধৰ্মানন্দ মহাভারতী (১৮৪৫–?) প্রাবন্ধিক, চিন্তক ও তন্ত্রসাধক। তাঁর লেখা বহু বিষয়ে বহু প্রবন্ধ সেকালে (১৯০৬–১৯১০) ভারতী, বঙ্গদর্শন এবং নব্যভারত পত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত হতো। রবীন্দ্রনাথের বঙ্গদর্শন সম্পাদনাকালে তাঁর প্রবন্ধাদি প্রকাশিত হত। তিনি ভারতে, আফগানিস্থানে, সিঙ্গাপুরে, সিংহলে বহু স্থান পর্যটন করে বহু দেশে অলৌকিক বস্তু দেখেছিলেন। স্বামী ধর্মানন্দ মহাভারতীর বাংলা ও ইংরেজিভাষায় লিখিত গ্রন্থগুলি হল – প্রবন্ধ সংকলন ধর্ম্মানন্দ-প্রবন্ধাবলী প্রথম খণ্ড (১৩১০), দ্বিতীয় খণ্ড (১৯০৪), তৃতীয় খণ্ড (১৯০৭); বঙ্গের ব্রাহ্মণ রাজবংশ, মুক্ত মাধব (আধ্যাত্মিক নাটক), সিদ্ধান্ত সমুদ্র প্রথম থেকে দ্বাদশ খণ্ড, মাহিষ্য সিদ্ধান্ত, তান্ত্রিক্স অ্যান্ড তান্ত্রিজম, ইব্রিয়দিগের প্রতি সাধু পৌলের পত্র, যোগী অ্যান্ড হিজ মেসেজ, ক্রিসচানিটি অ্যান্ড ইটস রিলেশন টু পৌরাণিক হিন্দুইজম, বুদ্ধিজম : এ স্টাডি প্রভৃতি। ‘তন্ত্রের শক্তি’ গল্পে সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় পণ্ডিত ধর্মানন্দ মহাভারতী কথিত একটি অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। গোয়ালিয়র রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী স্যার দিনকর রাও তন্ত্রশাস্ত্রে সুপণ্ডিত ছিলেন। তিনি তন্ত্রোক্ত দৃষ্টিযোগ ও অলোকযোগ সম্বন্ধে সাধনা করে কিছুটা সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। রাধাস্বামী সম্প্রদায়ের প্রধান শিষ্য লালা বিহারীলাল সাহেবের সঙ্গে মহাভারতীর কর্মসূত্রে যুক্ত ছিলেন। গুণাধিপতি স্বামী নামের দক্ষিণী সাধু বিহারীলালের কাছে দৃষ্টিযোগ ও অলোকযোগ সাধন অভ্যাসের ফলে কী ক্ষমতা অর্জন করেছেন সেইকথা এই গল্পে বলা হয়েছে। ‘তন্ত্র ও তান্ত্রিক’ গল্পে রায়বাহাদুর সিতার চাঁদ নাহারের পুত্র পূরণচাঁদের স্ত্রীর অসুখ ইংরেজ ও ভারতীয় কোনো পদ্ধতিতে আরোগ্য না হলে তান্ত্রিক পদ্ধতির শরণাপন্ন হতে হয়। সৌরীন্দ্রমোহন ‘শব-সাধনার মোদ্দা কথা’ পাঠককের কাছে সহজ ভঙ্গিতে বর্ণনা করেছেন – “সাধক যদি শব সংগ্রহ করতে পারেন, তাহলে অমাবস্যার রাত্রে সেই শব নিয়ে তিনি যান নির্জ্জন ভয়ঙ্কর শ্মশানে... শ্মশানে নিয়ে গিয়ে শবকে শোয়াতে হবে চিৎ করে উত্তর-দক্ষিণে লম্বিত করে... তারপর কালীপূজা – প্রতিমার প্রয়োজন নেই... শ্মশানে একজন অনুচর আনবার ব্যবস্থা... একজন ছাড়া দুজন নয়! একজন অনুচর আনার হেতু, সাধনার সময় যদি বিভীষিকা দেখে (বিভীষিকা নাকি দেখতেই হয়), মূর্চ্ছা হতে পারে... অনুচর তাহলে সে-সময় সেবা-শুশ্রূষা করে সচেতন করে তুলবে। শোনা যায়, সাধনকালে ভূতপ্রেতের দল কখনো সাপ, বাঘ, বরা প্রভৃতি রূপ পরিগ্রহ করে... কখনো কন্ধকাটা, প্রেতিনী, শাঁখিনী প্রভৃতির মূর্ত্তি ধরে ভয়ানক ভয় দেখায়... কখনো বা মায়ের রূপ ধরে মিনতি জানায়, ঘরে যাও বাবা! কখনো পত্নীর রূপ ধরে... কখনো পুত্রকন্যার রূপ ধরে মিনতি জানায়, মমতার আহ্বানে নিবৃত্ত করবার প্রয়াস পায়... কখনো বা রূপসী কিশোরীর বেশে উদয় হয়ে নানা প্রলোভন দেখায়। এ-সব কাটিয়ে উঠতে পারলেই তবে এ-সাধনায় সিদ্ধিলাভ ঘটে। কখনো ভূত-প্রেত বা অদৃশ্য নানা মূর্ত্তি বলে, বড় খিদে... খেতে দাও... পানীয় দাও – তখন সাধককে কিছু কিছু ভোজ্য দিতে হয় বাতাসে ছুঁড়ে। এজন্য সাধনা-কালে ভোজ্য-পানীয় কিছু সঙ্গে নিয়ে যেতে হয়। তারপর সিদ্ধিলাভ অর্থাৎ ঐ শবের দেহে হয় ভূত-প্রেতের ভর... তখন তাকে যে-হুকুম দেবে, একান্ত বশীভূতের মতো সে তা পালন করবে।” রায়বাহাদুর পুত্রবধূর আরোগ্যের জন্যে আয়োজিত শ্মশানে তান্ত্রিক সাধনায় বসা মহাভারতী রাতের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। এই বর্ণনার সঙ্গে বিভূতিভূষণের ‘তারানাথ তান্ত্রিকের দ্বিতীয় গল্প’ (মধুসুন্দরী দেবীর আবির্ভাব)-এর বর্ণনার কিছু মিল রয়েছে। শেষ রাতে দীর্ঘ কুচকুচে কালো রঙ, দীর্ঘ চুল, আগুনের ভাটার মতো জ্বলন্ত চোখের লোহার ডাণ্ডাধারী মূর্তি আবির্ভূত হয়ে সাঁইত্রিশ দিনের মাথায় রায় বাহাদুরের পুত্রবধূর মৃত্যুর কথা জানান। মহাভারতী মিনতি করায় মূর্তিটি তাঁর মাথার চুলের ঝুঁটি ধরে এমন জোরে টানেন যে তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। পরের দিন সকালে শ্মশান থেকে বহুদূরে গাছতলায় সাধককে পাওয়া যায়। এই গল্পটি এক অর্থে ব্যর্থতার গল্প। সাঁইত্রিশ দিনের মাথায় উক্ত মৃত্যুকে রোধ করা যায়নি। মৃত্যুকে রোধ করবার আবেদনে বরং সাধককে নিগৃহীত হতে হয়। মৃত্যুর অমোঘতাই বরং স্পষ্ট।
যোগি-যোগিনীর বিভূতি প্রদর্শনের কাহিনিতে সৌরীন্দ্রমোহনের একটি আগ্রহ ছিল। ‘তান্ত্রিকের সাধনার ফলে’, ‘যোগিনীর বায়ুচারী মন’ ও ‘যোগী ওঙ্কার দেও বাবা’ গল্পে আমরা ধর্মানন্দ মহাভারতীর তন্ত্রসাধক জীবনের নানা অভিজ্ঞতা পাই। মুখ্যত এই গল্পগুলির ক্ষেত্রে তাঁর তান্ত্রিক সাধুসঙ্গের অভিজ্ঞতার কথাই উঠে এসেছে। তিনি এখানে মুখ্যত দ্রষ্টার ভূমিকাই পালন করেছেন। ‘তান্ত্রিকের সাধনার ফলে’ মহাভারতীর তন্ত্রসাধনার অভিজ্ঞতার আরেকটি গল্প। পাঞ্জাবের আম্বালায় প্রয়াত রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় ওষুধের কোম্পানি ছিল। ক্যান্টনমেন্টের ব্রিটিশ ফৌজের ক্যাপ্টেনের স্ত্রীর কলেরায় মৃত্যু হয়। দেশি কোম্পানির বাজে ওষুধেই মৃত্যু হয়েছে এই অভিযোগে কোম্পানির মেডিকেল বিভাগের চার্জে থাকা ডক্টর ভগৎরামকে গ্রেপ্তার করা হয়। জামিন হলেও গোরা ফৌজ ও ইংরেজ বাসিন্দারা আসামীর সাজা চান। সেশন্স কোর্টে মামলা উঠলে ভগৎরামের বাবার অনুরোধে তান্ত্রিক সাধনায় সুরাহার জন্যে মহাভারতী শব-সাধনা করেন। কৌতূহলের জন্যে ভগৎরামের বাবা লুকিয়ে সাধনা দেখতে গিয়ে কাজ পণ্ড করে দেন। দ্বিতীয়বার মহাভারতী স্পিরিটের থেকে ভগৎরামের বেকশুর খালাশের কথা জানতে পারেন। ‘জীবন-দান’ গল্পে ধর্মানন্দ মহাভারতীর তান্ত্রিক্স অ্যান্ড তান্ত্রিজম গ্রন্থ থেকে তাঁর দুটি প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাজাত মৃতের বেঁচে ওঠার কাহিনি পুনর্কথিত হয়েছে। তাঁর তান্ত্রিকগুরুর নাম না জানা গেলেও লোকমুখে তিনি ‘খুটখুটে বাবা’ নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি তান্ত্রিক ক্রিয়ায় একটি জলে ডোবা ও আরেকটি সাপে কাটা মানুষের জীবন দান করেন। এই অবিশ্বাস্য ঘটনা সম্পর্কে তাঁকে জিগেস করা হলেও সাধু নিরুত্তর থাকেন। তন্ত্রচিন্তক মহাভারতীর কাছেও ‘ঘটনার রহস্য’ ‘অমীমাংসীত’। সম্বন্ধে সাধুজীকে কোনো প্রশ্ন না করলেও তিনি বিশ্বাস করেন – “তন্ত্রশাস্ত্র বুঝে রীতিমত অনুশীলন করলে জীবনের বহু আধি-ব্যাধি থেকে আমরা সহজেই মুক্তিলাভ করতে পারি!” ‘যোগিনীর বায়ুচারী মন’ গল্পে মহাভারতী জৌনপুর জেলার হরিয়াদে যোগিনীর সাক্ষাৎ পান। যোগিনী তাঁর সঙ্গে কুম্ভে দেখা করবেন বলেন। কিন্তু মহাভারতীরা তেজী ঘোড়ায় কুম্ভে পৌঁছালেও কোনো যান ছাড়াই দ্রুত যোগিনীর যথাসময়ে পৌঁছান। কীভাবে তিনি এলেন – এই প্রসঙ্গে যোগিনী বলেন – “ঘোড়ার চেয়ে জোরে চলে বাতাস... আমি এসেছি বাতাসের চেয়ে আরো জোরে ছোটে যে-মন, সেই মনের শক্তিতে। ইচ্ছাশক্তির সঙ্গে যদি ভগবানের দয়ার যোগ থাকে, তাহলে চকিতে মানুষ সাত সমুদ্র পার হতে পারে।... ইচ্ছাশক্তি সব মানুষের আছে... তবে এ-শক্তিকে বাড়ানো চাই। বাড়াতে হলে সাধনা করতে হবে... দু দিন চার দিন দু বছর চার বছরের সাধনা নয়... নিত্য দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর... তাহলে ইচ্ছাশক্তির দৌলতে চকিতে মানুষ ত্রিভুবন বিচরণ করতে পারবে। সব মানুষের মন... জেনো, উর্ধ্বর ক্ষেতের মতো... যে-ফশল ফলাতে চাও... বীজ বুনে একাগ্র সাধনা করো, যত্ন করে।... অভীষ্ট ফশল পাবে প্রচুর। মনে রেখো, ভগবান চোখ দিয়েছেন... সে-চোখে দৃষ্টি দিয়েছেন... সে দৃষ্টিতে পৃথিবী দেখতে হয় কী করে, মানুষ তা জানে না... মানুষের দুর্ভাগ্য!” ‘যোগী ওঙ্কার দেও বাবা’ গল্পে কুরুক্ষেত্র যাত্রী মহাভারতী। থানেশ্বরের সরকার সাহেবের বাড়িতে অতিথি রূপে তিনি যখন ছিলেন, তখন তাঁর সংস্কৃত গ্রন্থ, পুস্ত ভাষায় লেখা ইসলামী পাণ্ডুলিপি, টাকা, ওষুধ সমেত ঝোলাটা চুরি যায়। মহাভারতীর সঙ্গে ভারতীয় ধর্মতত্ত্বে অনুসন্ধিৎসু এক দম্পতির (আমেরিকান স্ত্রী ও ইংরেজ স্বামী) সাক্ষাৎ হয়। তাঁরা ভালো সাধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে উৎসাহী দেখে খোঁজ নিয়ে ওঙ্কারনাথ বাবার সঙ্গে দেখা করতে যান। তাঁর ভবিষ্যৎ দৃষ্টি ঔদার্য ও আতিথ্য উল্লেখযোগ্য। ওঙ্কারনাথ বাবার প্রথম দর্শনের বর্ণনা আকর্ষণীয় ও উদ্ধারযোগ্য – “...কুরুক্ষেত্রে আছেন এক সাধু-যোগী... ওঙ্কার দেও বাবা... তাঁর অসাধারণ অলৌকিক শক্তি! অনেকে তাঁর এ-অলৌকিক শক্তির পরিচয় প্রত্যক্ষ করেছেন। ইনি আগুনের উপর দিয়ে হেঁটে চলেন... সরবতের সঙ্গে সাপের বিষ মিশিয়ে পান করেন। বন্ধ সিন্দুকের মধ্যে সাতদিন অনাহারে কাটিয়েছেন একবার... সকলে প্রত্যক্ষ করেছে। কুরুক্ষেত্র সহরের প্রান্তে ঝোপঝাড় এবং প্রান্তর... সেইখানে একখানি পর্ণকুটীরে তিনি থাকেন। অবারিত দ্বার... রাজা-মহারাজা থেকে দীন দুঃখী ভিখারী সকলকে তিনি সমান দেখেন।” একথা শুনে সাধু-দর্শনের অভিজ্ঞতা নাটকীয় – “চালাঘর... তার সামনে বড় একটা গাছের উঁচু ডালে দুপা দড়িতে বাঁধা... মাথা নীচের দিকে... ঝুলচেন যোগী। আমাকে দেখে যোগী তখনি দড়ির বাধন খুলে ঐ উঁচু ডাল থেকে ঝাঁপ খেয়ে মাটীতে নামলেন। যেটুকু দেখলুম... বুঝলুম, ইনিই বাবা ওঙ্কার দেও।” আমেরিকান ভদ্রমহিলার বাবার মৃত্যু বিষয়ক, সম্পত্তি সংক্রান্ত বিষয়ে সমস্যা সমাধানের সঙ্গে মহাভারতীর চুরি যাওয়া ঝোলার অতর্কিত অপ্রত্যাশিত প্রাপ্তিযোগের ভবিষ্যৎবাণী করেন। ‘ওঙ্কার দেও বাবার কথা কী করে ফললো!’ – এই বিস্ময়েই গল্পটির পরিসমাপ্তি।