কবি সুশীল মণ্ডল জন্মেছেন সুন্দরবনের এক অখ্যাত গ্রামে। জলজঙ্গলের দেশের কাদামাটি গায়ে মেখে আপন মেধা ও মননের জোরে নরেন্দ্রপুরের রামকৃষ্ণ মিশনের স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন দীর্ঘকাল। তবে তাঁর মনোজগতের আকাশ জুড়ে ছিল কবিতা এবং কবিতা। তারই নিরন্তর প্রতিফলন ঘটে চলেছে তাঁর লেখায়। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘আমার সামনে সমুদ্র (লবণাক্ত প্রকাশনী) প্রকাশিত হয় ১৯৭৮ সালে। তারপর থেকে অতি অল্প সময়ের ব্যবধানে প্রায় অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে তাঁর বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থের প্রকাশ। অত্যন্ত সুখের কথা এখন অব্দি প্রকাশিত ২১টি কাব্যগ্রন্থের ১৭টিই প্রকাশিত হয়েছে কলকাতার প্রখ্যাত প্রকাশন সংস্থা ‘দে’জ প্রকাশনী থেকে। এমনকী আলোচ্য ‘নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ কবিতা’ও ওখান থেকেই প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৭৮ থেকে ২০২৪, এই দীর্ঘ ৪৬ বছরের কাব্য সাধনার ফসল নিয়ে অক্ষমের সামান্য কিছু আলোকপাতের চেষ্টা এই লেখায়।
শ্রেষ্ঠ কবিতা একজন কবির মনোগহনের এক দর্পণ ছাড়া আর কিছুই নয়, বিশেষ করে সেই চয়ন যদি হয় স্বনির্বাচিত। এই নির্বাচন প্রসঙ্গে লেখকের অকপট বয়ান, “লেখালিখির মধ্যে কোন কবিতা শ্রষ্ঠত্বের দাবি রাখে তা নির্বাচন করা যে কোনো কবির পক্ষে একটি দুরূহ কাজ। মায়া-মমতা দিয়ে গড়া কবিতার শরীরে যে সকল শব্দরা ঘনীভূত হয় কিংবা মাথা তুলে দাঁড়ায় তা কতখানি কবিতার রসে সিক্ত, সে কথা সময় বলতে পারে। কখনো প্রকৃতি, কখনো বাস্তব চাক্ষুষ করা ঘটনাপঞ্জি, আবার কখনো মানবজীবনের কোনো অনুভূতি কবিতার জন্মদাত্রী হয়ে ওঠে।“ বস্তুত কবির এই স্বকৃত আত্ম-পরিচয় আমাদের তাঁর কবিতার ভুবনে নিয়ে যেতে প্রভূত সাহায্য করে। একটার পর একটা পর্দা উন্মোচনে আমরা আবিষ্কার করি একজন প্রকৃত ভালোবাসার কাঙ্গাল এক আলোর পথযাত্রীকে। যিনি অনায়াসে লিখতে পারেন,
“যে মেয়েটি বলেছিল
আমার শরীরে এখন দুপুর
সে বৃষ্টির পরে না আর
পায়ে থোকা থোকা নূপুর।
মেয়েটি আমায় দেখিয়েছিল চোখের মধ্যে আকাশ
তার ঠোটের তৃষ্ণা পান করে
আদৌ মেটেনি আমার আশ।
আমার মধ্যে মেয়েটি
জ্বেলেছিল মস্ত বাতিঘর
হঠাৎ সেদিন ধর্মতলায়
তিরিশ বছর পর।“
( যে মেয়েটি বলেছিল, কাব্যগ্রন্থ : অনন্ত আশ্বিনের শিশিরে )
আবার এই প্রেমিক মানুষটিই প্রকৃতির খেয়ালি আচরণের নিবিড় অবলোকন করে কষ্ট পান। একদা গ্রামের আবহে বেড়ে ওঠা মানুষ শহরের ইট কাঠ আর পাথরের মধ্যে তাঁর চিরচেনা প্রকৃতিকে খুঁজে না পেয়ে কষ্টবোধে আক্রান্ত হন। বৃষ্টি আসে, চলে যায়। তার মধ্যে কবি আর খুঁজে পান না সেই রোমাঞ্চকর আনন্দের স্বাদ। তাই তো সেই বিষাদের সুর ভেসে আসে তাঁর লেখায়,
অনেকদিন বৃষ্টি আর কোনো গল্প বলে না
বৃষ্টি আসে চলে যায়
শোনায় না ছড়াগান।
এখন বৃষ্টি ছড়িয়ে পড়তে লজ্জা পায়
এখন বৃষ্টি গড়িয়ে পড়তে লজ্জা পায়।
……এখানে বৃষ্টির কোনো গল্প নেই
এখানে বৃষ্টির কোনো কবিতা নেই
এখন বৃষ্টিতে ভেজে না ভালোবাসার দহন। ( বৃষ্টির কোনো গল্প : নেই নির্জনতার বৈভবে)
পড়ন্ত বিকেলে মন্থর বারান্দায় মহাশূন্য থেকে খসে পড়ে অজানা পাখির পালক, আকাশের গুহাচিত্রে মেঘেদের অনন্ত যাপন আমার মধ্যে জন্ম দেয় এক নিবিড় প্রেমিক। মুগ্ধ প্রেমিক কখন যে ঈশ্বর হয়ে ওঠে তা জানিয়ে দেয় প্রতিটা পাখি, মজা নদী, শ্মশানের চিতাকাঠ আমি দু’হাতে গড়তে থাকি ভাসমান পৃথিবী এবং তার অতল জলের মানুষ।
আমার ঈশ্বরসত্তা মানুষ গড়তে না পেরে শিশির গড়তে না পেরে গড়ে তোলে মস্ত একটি সমুদ্র।
(ঈশ্বর এবং : বসন্ত দিনের বৃষ্টি)
এই কবিতার মধ্যে এক ধরনের সূক্ষ্ম অতৃপ্তি উঁকি মারে। বুঝতে পারি মনের মানুষ খুঁজতে এসে আশাহত কবি প্রকৃতির মধ্যে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন। তাঁর ভিতরের সৃজনসত্তার এক অশ্রুত বিলাপ যেন কথা বলে ওঠে। মানুষের মধ্যে মানুষকে খুঁজে না পেয়ে তিলতিল করে শিশির কণা দিয়ে সমুদ্র গড়ার অলীক স্বপ্ন দেখে।
দীর্ঘদিন ধরে কবিতা লিখছেন সুশীল মণ্ডল। কবিতার হাত ধরে তাঁর পথচলা এখনও থামেনি। জীবিকার সূত্রে শহরবাসী হতে বাধ্য হলেও তাঁর আবাল্য স্মৃতিবিজড়িত জন্মগ্রাম তাঁর সত্তার গভীরে কথা বলে। তাই তো তাঁর কবিতায় বারবার ফিরে আসে ‘অলৌকিক রোদ্দুর’, ‘খেতখামার’, দ্বিতীয়ার চাঁদ’, ‘স্বাতী নক্ষত্র’, ‘শ্যামলী পাতার ছাপ’,’ জ্যোতির্ময় মানুষ’ আর ‘মেঘলা চুলের প্লাবন’। ঠিক এইখানেই তিনি হয়ে যান কবি জীবনানন্দ দাশের প্রকৃত উত্তরসূরী।
“কবিতা হলো পাখির মতো, এটি সকল সীমান্ত উপেক্ষা করে” ইয়েভগেনি ইয়েভতুশেঙ্কোর এই আপ্তবাক্যটি মনে পড়ে কবি সুশীল মণ্ডলের কবিতাবলি পড়ে। তাঁর কবিতা তাঁর নিজস্ব অনুভূতির এক অকপট চিত্রকর্ম, যা অপর প্রাণের মধ্যে খুব সহজেই প্রবেশ করতে পারে। সীমানা না মানা পাখির মতো সে উড়ে বেড়ায় দেশ থেকে দেশান্তরে। প্রবেশ করে হৃদয়ের গভীরে। প্রসঙ্গত রবীন্দ্রনাথের একটি উক্তিটিও মনে পড়ে, “কবিত্ব হল নিজের প্রাণের মধ্যে পরের প্রাণের মধ্যে ও প্রকৃতির মধ্যে প্রবেশ করার ক্ষমতা, কবি নিজের কল্পনা দিয়ে শব্দের ওপর শব্দ সাজিয়ে এক অপরূপ মায়ার জগৎ তুলে ধরেন।“ শ্রী মণ্ডলের কবিতাসমূহ সত্যি সত্যি প্রাণ থেকে প্রাণের মধ্যে সঞ্চারিত হয়ে প্রকৃতির রূপ রস আর গন্ধের ডালি নিয়ে আমাদের সামনে এক অপরূপ মায়ার জগৎ তুলে ধরে। কেননা কবিতা হল তাঁর কাছে নিজের শ্বাস প্রশ্বাসের মতো এক অনিবার্য প্রক্রিয়া। তাই তো তিনি অয়ান্যাসে লিখতে পারেন।
পাখিদের মুগ্ধ কলরবে
বিস্তীর্ণ ভালোবাসার বর্ণময় আকাশে
কবিতা যখন স্পন্দিত
আমি সেখানেই দু-দণ্ড কবিতায়
আলো খুঁজে পেতে চাই। (দু-দণ্ড কবিতা : বসন্ত দিনের বৃষ্টি)
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ কবিতা * সুশীল মণ্ডল * দে’জ পাবলিশিং * বইমেলা ২০২৪ * প্রচ্ছদ- সুব্রত চৌধুরী * মূল্য – ২০০ টাকা