'ফেরারী ফৌজ' নতুন করে পাওয়া জাতীয় আন্দোলনের আমেজ

 
নাটক টা দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, একজন সফল রাজনীতিক, সফল প্রশাসক, কী জাদুমন্ত্রে সফল একজন অভিনেতা হয়ে ওঠেন, যিনি এক ই সঙ্গে পূর্ববঙ্গীয় অ্যাকসেন্ট আর কেতাদুরস্ত ইংরেজি সংলাপে এভাবে মাত করে দেন দর্শকদের। টাঙ্গাইলের বড়বাসালিয়া আর ডাউনিং স্ট্রীট কে ,' মেলালেন' তিনি ' মেলালেন' -- পার্থ ভৌমিক---
 
রাজনীতির কোন পথটা সঠিক? নেতার না কর্মীর? নেতা রাজনীতির যে পথের অনুসারী হতে বলেন, সেই পথ যদি ভুল মনে হয়, তবে কি নেতার কাছে সেই প্রশ্নটা করা যায় না যে, আপনার এই ভাবনা ভুল ? কয়েকটা নিরীহ মানুষের মৃত্যু কখনো বৃহত্তর সামাজিক পরিবর্তন ঘটাতে পারে কি? নাকি,  সেই পথ বদলানোর  প্রয়োজন জরুরি? 
উৎপল দত্ত  'ফেরারী ফৌজ' নাটকটি লিখছেন ১৯৬১ সালে। মনে রাখতে হবে ,  জ্বলন্ত ছয়ের দশকে স্বাধীনতা সংগ্রামের আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে তিনের দশকে পূর্ববঙ্গে সশস্ত্র বিপ্লবের কার্যক্রম নিয়ে 'ফেরারী ফৌজ' নাটকটি রচনা করেন নাট্যকার উৎপল দত্ত।
                ২০২৪ এ দাঁড়িয়ে, যখন নৈহাটি নাট্য সমন্বয় সমিতি প্রযোজিত 'ফেরারী ফৌজ' দেখছি, এবং মঞ্চে অশোক, জ্যোতির্ময়, কুমুদ,মাস্টারমশাইরা নিজেদের বিপ্লবের পথ নিয়ে আলোচনা করছেন-- তখন মনে হচ্ছে, কতটা প্রাসঙ্গিক এই নাটকের প্রতিটা সংলাপ। বিপ্লবের পথ, রাজনীতির পথ নিয়ে বারবার প্রশ্ন তুলেছেন নাট্যকার উৎপল দত্ত।
 লিখেছেন, "মানুষ যদি জেগে না ওঠে তাহলে কীসের জন্য লড়ছি আমরা?” 
নাটকের চরিত্ররা  তাঁদের নেতার নির্দেশ নিয়ে সন্ধিহান হচ্ছে! প্রশ্ন করছে।  সরবে বলছে, "আপনার এই পথ ভুল!” কিন্তু দিনের শেষে সেই নেতার নির্দেশই পালন করছে! যে নেতাকে তারা কখনো দেখেই নি!  
Image preview
            নৈহাটি নাট্য সমন্বয় কে ধন্যবাদ। এই রাজনৈতিকভাবে এক অদ্ভুত অসহিষ্ণু, অস্থির  সময়ে এই নাটকটিকে আরো  একবার মঞ্চে আনবার জন্য। নাটকের নির্দেশক দেবাশিস ,  এই সময়ের বাংলা থিয়েটারের অন্যতম শ্রেষ্ঠ একজন পরিচালক। এই নাটক নির্মানেও সেই  মুন্সীয়ানা তিনি দেখিয়েছেন। অভিনন্দন দেবাশিসকে।
প্রেম না বিপ্লব? দেশ না পরিবার? বিশ্বাসঘাতকতা না ষড়যন্ত্রের স্বীকার?  বেশ কয়েকটি দ্বন্দ্বের এই নাটকের চরিত্ররা বারবার সম্মুখীন হয়েছে। বিশেষ করে  অশোক চরিত্রটি। এই  চরিত্রের প্রতিটি মুহুর্ত কে দুর্দ্দান্তভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন অভিনেতা বুদ্ধদেব দাস। অশোকের যে অসহায়তা, একদিকে তাঁর পরিবারের প্রতি ভালোবাসা  আরেকদিকে ব্রিটিশ শাসক তাঁকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তাঁর সংগঠন তাঁকে দেখা মাত্রই গুলি করে মেরে ফেলার নির্দেশ জারি করে। নিজের  পরিবারের কাছেও সে এক ঘৃণার পাত্রে পরিনত হয়। এই রকম পরিস্থিতি তে দাঁড়িয়ে অশোকের শারীরিক এবং মানসিক যে অবস্থা তা অসাধারণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন বুদ্ধদেব।     
                একই সঙ্গে বাংলা থিয়েটারের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেতা দেবশঙ্কর হালদার যথারীতি তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের নজির রেখেছেন। চারিত্রিক ভাবে বিপরীত দুই চরিত্রকে তিনি অসাধারণ ভাবে উপস্থাপন করেছেন। এই অসামান্য চরিত্রায়ন একমাত্র দেবশঙ্কর হালদারের পক্ষেই সম্ভব। নাটকের প্রায় শেষের দিকে, যখন বিপ্লবী শান্তি রায় পরিচয়ে তিনি মঞ্চে আসছেন, তখন যেন গোটা প্রেক্ষাগৃহে একটা আলাদা উত্তেজনা খেলে যাচ্ছে। বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়, তদন্তকারী অফিসার হিতেন দাশগুপ্তের চরিত্রে পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম। কখনো ক্রুড়। কখনো ধূর্ত। কখনো স্রেফ হিমশীতল চাহুনি।  তাঁর অভিনয় দেখে দর্শক হিসেবে আপনার রাগ হবে। শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে যাবে। আর এখানেই একজন অভিনেতার সার্থকতা। 
এছাড়া অবশ্যই উল্লেখ করা প্রয়োজন কুমুদের চরিত্রে ঋক দেব এবং ফাদার এবং ডাক্তারের চরিত্রে অরিত্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনয়। সংগঠনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা কুমুদের চরিত্রটি অত্যন্ত সুচারুভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন ঋক।  আর ডাক্তারের চরিত্রে যে মানবিক দিক সঙ্গে শরীরী অভিনয়ে চমৎকার অভিনয় করেছেন অরিত্র। 
                  বিপ্লবী জ্যোতির্ময়ের চরিত্রে পার্থ ভৌমিক। একদিকে পূর্ববঙ্গীয় উচ্চারণে বাংলা সংলাপ , আরেকদিকে ইংরেজিতে সংলাপ  দুইয়েতেই সাবলীল জ্যোতির্ময়রূপী পার্থ ভৌমিক। মঞ্চের উপর তাঁর অনায়াস বিচরণ প্রমাণ করে তিনি কতটা পরিশ্রমী একজন অভিনেতা। জ্যোতির্ময়, অশোক কে ভালোবাসে। বিশ্বাস করে, অশোক বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারেনা! আবার সংগঠনের শীর্ষ নেতা শান্তিদা'র নির্দেশকে অমান্যও করতে পারেনা।
 আসলে 'ফেরারী ফৌজ''র প্রতিটি চরিত্রই কোনো না কোনো দ্বন্দ্বে আবর্তিত হচ্ছে। জ্যোতির্ময়ের মধ্যেও দ্বন্দ্ব আছে। সেই দ্বন্দ্ব চমৎকার ফুটিয়ে তুলেছেন পার্থ ভৌমিক। এখানেই অভিনেতা পার্থ ভৌমিকের অভিনয় কুশলতা ।
নির্দেশনার সঙ্গ এই নাটকের মঞ্চ আলো এবং সম্পাদনার কাজটিও সুচারুভাবে করেছেন দেবাশিস। মঞ্চ নির্মান করেছেন সন্দীপ বিশ্বাস।  আলোক প্রক্ষেপণ করেছেন শুভঙ্কর দে। আবহ প্রক্ষেপণ করেছেন সমীর দে। গোটা মঞ্চের স্পেসের সাথে সাথে মঞ্চের সামনে মঞ্চ এবং দর্শকের মাঝের অংশটিকেও তিনি অভিনয়ের স্পেস হিসেবে ব্যবহার করেছেন। নির্দেশক দেবাশিস তাঁর প্রতিটি নাট্যেই এই স্পেসের ব্যবহারটিকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছেন। এই প্রযোজনাও তাঁর ব্যতিক্রম হয়নি। 
একটি নাটক তখনই সফল হয়, যখন সেই নাটকের অনুরণন দর্শকের  মনে  দীর্ঘস্থায়ী ছাপ রেখে যায়৷ এই নাটকটিও তেমন ই৷  'ফেরারী ফৌজ'  নাটকের একেবারে শেষ দৃশ্যে যখন বিপ্লবী শান্তি   তাঁর একসময়ের অন্যতম প্রিয় শিষ্য অশোক কে বলেন, বিপ্লব করতে এসে কেন তোমার পরিবারের কথা মনে পড়বে? ব্রিটিশ পুলিশের কাছে ধরা পরার আগে কেন মৃত্যু বরণ করলে না? সায়ানাইড ছিল না? 
তাঁর উত্তরে অশোক স্রেফ একটাই কথা বলে, "বিকজ্, লাইফ ইজ বিউটিফুল!” জীবন সুন্দর! 
এই বোধ ই  তো আমাদের বাঁচিয়ে রাখে। বিপ্লবে হোক বা প্রেমে বেঁচে থাকাটাই তো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ  বা বেঁচে থাকাটাই সবচেয়ে বড় অ্যাক্সিডেন্ট!

  • শমিত ঘোষ