কল্পনা দত্ত( যোশী)-- সল্ট লেকে একটা মেলাতে তাঁর সঙ্গে জ্যোতি বসুকে সম্বর্ধনা দেওয়া হচ্ছে।জ্যোতিবাবুর অকপট স্বীকারোক্তি; স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে আপনারা কল্পনা দত্তের সঙ্গে আমাকে স্বাধীনতা সংগ্রামী বলে সম্বর্ধনা দিচ্ছেন? আপনারা জানেন , কল্পনা যোশী কে?
সময় টা ১৯৩৩। নাক টানলে বাতাসে তখনও বারুদের গন্ধ পাওয়া যায়। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখলের সূর্য প্রায় ঢলেই পড়েছে। বিচার চলাকালীন শাসকের বিচারসভায় একদিন এক টুকরো বিষণ্ণ নিবেদন - “তোকে ভালো লাগে। যদি ফিরে আসি, আমার জন্য অপেক্ষা করবি?”
তাঁর 'ফুটুদা'র কথা না লিখে পারেননি কল্পনা দত্ত -
‘‘ধরা পড়ার পর মাস্টারদা, ফুটুদা আর আমাকে নিয়ে নতুন করে মামলা শুরু হয়েছিল। আমরা কাঠগড়ায় একসঙ্গে দাঁড়াতাম। সেইসময় একদিন ফুটুদা বলেছিলেন, তোকে ভালো লাগে। যদি ফিরে আসি, আমার জন্য অপেক্ষা করবি? আমার মৌনতায় হয়তো সম্মতি ছিল।'' (চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার আক্রমণকারীদের স্মৃতিকথা -কল্পনা দত্ত)
কল্পনা দত্তের বর্ণনা দিতে গিয়ে অনেকে লিখেছেন, তাঁকে দেখলে অবাঙালি বলে মনে হতো। সাধারণ বাঙালি নারীদের থেকে অনেক বেশি লম্বা, ছিপছিপে সুন্দর গড়ন, বলিষ্ঠ ঋজুদেহ, গায়ের রং কাঁচা হলুদ; আর হাসি ছিল ভীষণ মিষ্টি। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখলের নেতা বীর শহীদ সূর্য সেন, পূর্ণেন্দু দস্তিদারের নামের সঙ্গে যে দুজন নারীর নাম জড়িয়ে আছে, তাঁদের একজন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, অন্যজন কল্পনা দত্ত।
১৯১৩ সালের ২৭ জুলাই চট্টগ্রাম জেলার শ্রীপুর গ্রামে কল্পনা দত্তের জন্ম। তাঁর বাবা বিনোদবিহারী দত্ত ও মা শোভনবালা দত্ত। কল্পনা দত্তের ঠাকুরদা ডাক্তার দুর্গাদাস দত্ত ছিলেন চট্টগ্রামের একজন বিশেষ প্রভাবশালী ব্যক্তি। ইংরেজ সরকার তাঁর ব্যক্তিত্বকে সম্মান দিত। ফলে তাঁদের বাড়ি পুলিশের নজরের বাইরে ছিল। শৈশব থেকেই কল্পনা মানসিক দিক থেকে ব্যতিক্রমী ছিলেন। শৈশবে তিনি কামনা করতেন সংসারে যেন দুঃখ না থাকে, সবাই যেন সুখে দিন কাটাতে পারে। এই যে চাওয়া এই চাওয়াই তাঁকে দেশের প্রয়োজনে বিপ্লবী করে তুলেছে।
বিপ্লবী দলের তৎকালীন নেতারা মনে করতেন স্বভাবে দরদি ও কোমল মেয়েরা বিপ্লবী কাজে অনুপযুক্ত। ছেলেমেয়ে পাশাপাশি থাকলে ছেলেদের নৈতিক আদর্শ খারাপ হতে পারে। এই মনোভাবের বিরুদ্ধে কল্পনা দত্ত লিখেছেন, ‘It was an iron rule for the revolutionaries that they should keep aloof from the women.’ তিনি বলেই থেমে থাকেননি। সশস্ত্র সংগ্রামে অংশ নিয়েছিলেন যারা, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন প্রথম নারী শহীদ প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ও কল্পনা দত্ত। বোমা পিস্তল নিয়ে কাজ করার দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন তাঁরা।
কল্পনা দত্তের জীবন বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখা গেছে বারো বছর বয়স থেকেই তিনি স্বদেশি বই পড়তে আগ্রহী হন। বিপ্লবীদের জীবনী, ’পথের দাবি’—এ ধরনের স্বদেশি বই পড়তে পড়তে তাঁর মনে হতো ব্রিটিশ সরকারকে সরাতে পারলেই দেশের দুঃখ দূর হবে। তাঁর ছোট কাকা তাঁকে আদর্শ দেশ-সেবিকারূপে গড়ে ওঠার প্রেরণা দিতেন। পড়াশোনায় মেধাবী কল্পনা চট্টগ্রামের খাস্তগীর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে ১৯২৯ সালে মেট্রিক পরীক্ষায় মেয়েদের মধ্যে চতুর্থ হন। তারপর চলে যান কলকাতায়। ভর্তি হন বেথুন কলেজে বিজ্ঞান শাখায়। সেখানে পড়ার সময়ই রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।
বিপ্লবী হিসেবে নিজেকে তৈরি করার প্রবল আকাঙ্ক্ষা জাগে তাঁর মনে। স্কলারশিপের টাকায় সাইকেল কিনে প্রতি সকালে কলেজ কম্পাউন্ডে সাইকেলে ঘুরপাক খাওয়া, প্রতি রোববার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে নৌকা চালানোর অভ্যাস করতেন তিনি। সূর্য সেনের ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির সদস্য হয়ে কল্পনা নিজের পড়ার ঘরে বসে বোমার জন্য তৈরি করতেন গান-কটন।
তারপর তিনি যোগ দেন কল্যাণী দাসের ‘ছাত্রী সংঘে’। তারপর বেথুন কলেজে হরতাল ও অন্যান্য আন্দোলনে অংশ নিতে থাকেন। চট্টগ্রামের বিপ্লবী নেতা সূর্যসেনের অনুগামী পূর্ণেন্দু দস্তিদার কল্পনার মতো একজন বিপ্লবীমনস্ক নারীকে পেয়ে সর্বতোভাবে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিলেন। এভাবেই বিপ্লবীদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ গড়ে ওঠে।
১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন হয়।১৯৩০-এর ১৮ই এপ্রিল চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার দখল আর ২২শে এপ্রিল জালালাবাদ পাহাড়ের যুদ্ধের ঘটনায় কল্পনা এতটাই অনুপ্রাণিত হলেন যে, ছুটিতে চট্টগ্রাম এসে তাঁর আর কলকাতায় ফেরা হল না। তখনও মাস্টারদার সঙ্গে তাঁর সরাসরি যোগাযোগ বা কথা হয়নি। জালালাবাদ পাহাড়ের যুদ্ধের পর অনন্ত সিংহ, গণেশ ঘোষ ও লোকনাথ বল আরও অনেকেই গ্রেফতার হন। মাস্টারদা চলে যান আত্মগোপনে। ১৯৩১ সালের মে মাসে কল্পনার সঙ্গে মাস্টারদার সাক্ষাৎ হয়।
ডিনামাইট ষড়যন্ত্রে কল্পনা দত্তের বিশেষ ভূমিকা ছিল। কলকাতা থেকে বোমা তৈরি করার মালমসলা সংগ্রহ করে চট্টগ্রামের বাড়িতে বসে গান কটন তৈরি করেন তিনি। সেগুলো চলে যেত জেলের ভেতরে। চট্টগ্রাম জেলে অনন্ত সিংদের সঙ্গে যোগাযোগ হতো কল্পনা দত্তের মাধ্যমে। ১৯৩১ সালের ডিনামাইট ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হওয়ার আগের দিনই পুলিশের নজরে আসে। তবে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কিন্তু তাঁর গতিবিধি নিয়ন্ত্রণের আদেশ দেয় সরকার। চট্টগ্রাম কলেজে বিএসসি পড়ার অনুমতি মিললেও অন্যত্র যাতায়াত বন্ধ হয়। সে সময় রাতে পালিয়ে তিনি সূর্যসেন, নির্মল সেনের সঙ্গে দেখা করতে গ্রামে চলে যেতেন। এই সময়ের মধ্যে রিভলবার চালাতেও অভ্যস্ত হন।
পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের জন্য কল্পনা দত্ত ও প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের ওপর দায়িত্ব দেন মাস্টারদা। প্রস্তুতির জন্য কল্পনাকে ডেকে পাঠান। ইতিমধ্যে চট্টগ্রামকে সামরিক এলাকা বলে ঘোষণা করা হয়। প্রতি গ্রামেই ছিল সামরিক ক্যাম্প। আত্মগোপনে থাকা অত্যন্ত কঠিন। ১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি মাস্টারদা ধরা পড়েন। কল্পনা পুলিশের ব্যূহ থেকে পালিয়ে আসেন।
প্রতিনিয়ত স্থান পরিবর্তন করতে করতে কল্পনা দত্ত, তারকেশ্বর দস্তিদার, মনোরঞ্জন দত্ত, মনোরঞ্জন দে ও অর্ধেন্দু গুহ সমুদ্রের ধারে গাহিরা নামক গ্রামে আশ্রয় নেন। সেখানে কয়েক দিন আত্মগোপন করে থাকার পর ১৯৩৩ সালের ১৯ মে ভোরে সেই গ্রামে রাতে মিলিটারি আক্রমণ করে। বিপ্লবীরাও গুলি চালায়। যুদ্ধ করতে করতে বিপ্লবী মনোরঞ্জন দত্ত নিহত হন। আশ্রয়দাতা পূর্ণ তালুকদারও নিহত হন এবং তাঁর ভাই নিশি তালুকদার আহত হন। বিপ্লবীদের গুলি নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার পর সবাই গ্রেপ্তার হন। মিলিটারি সুবেদার কল্পনা দত্তকে চপেটাঘাত করেন। কিন্তু মিলিটারি সৈনিকেরা তৎক্ষণাৎ তার প্রতিবাদ করেন। বিপ্লবী তারকেশ্বর দস্তিদারের চোখে লোহার কাটাওয়ালা মিলিটারি বুট দিয়ে এমন লাথি মারে যে তাঁর চোখ দিয়ে রক্তের ধারা পড়তে থাকে। তার ওপর রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় হান্টার দিয়ে মারতে থাকে। কল্পনা দত্তকেও হাতকড়া দিয়ে কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে যায়।
এই মামলার নাম ছিল ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন সেকেন্ড সাপ্লিমেন্টারি কেস’। এর চার্জ ছিল রাষ্ট্রদ্রোহ, ষড়যন্ত্র, বিস্ফোরক আইন, অস্ত্র আইন, হত্যা প্রভৃতি। এই মামলার আসামি ছিলেন সূর্যসেন, তারকেশ্বর দস্তিদার ও কল্পনা দত্ত। মামলার রায়ে সূর্যসেন ও তারকেশ্বরের ফাঁসির আদেশ হয় এবং কল্পনা দত্তের যাবজ্জীবন দীপান্তরের আদেশ হয়। অনেক চেষ্টার পর সেই দীপান্তরের আদেশ স্থগিত হয়। মামলার রায়ে স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল জজ বলেন, ‘মেয়ে বলে এবং বয়স কম বলেই কল্পনা দত্তকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করা গেল না।’
‘দেশের মানুষ আমাদের জেলে রেখে নিশ্চিন্তে থাকবে না, আমাদের বের করে নিয়ে যাবেই’—এ বদ্ধমূল ধারণা ছিল কল্পনার। ফেলে রাখা অসমাপ্ত কাজ আবার হাতে তুলে নিত হবে। শাস্তি পাওয়ার পরই কলকাতা হিজলি স্পেশাল জেলে কল্পনাকে নিয়ে যাওয়া হয়। দুই ডিভিশনের বন্দীদের সঙ্গে থাকার সুযোগ পেয়েছিলেন। তিন মাস সেখানে ছিলেন। বইপত্র পড়ার সুযোগ থাকলেও পড়েননি কিছু। অন্য জেলে স্থানান্তরিত করা হয় পরে। তিন-চার বছর পর সব নারী রাজবন্দীদের একত্রে রাখার ব্যবস্থা হয়। সেখানে ‘পরিচয়’ নামের মাসিক পত্রিকা পড়ার সুযোগ হয়। কমিউনিস্টদের সম্পর্কে তাঁদের কাছ থেকে কিছু কিছু শুনতেন, জায়াড-এর লেখা, কোলের লেখা বার্নার্ড শ-এর স্যোশালিজম, কমিউনিজম সম্বন্ধে কিছু কিছু বইও তাঁদের কাছ থেকে পেলেন। বইগুলোর যুক্তিতর্ক মনকে ভীষণভাবে নাড়া দেয় কল্পনাকে। তিনি দেখলেন, ‘কমিউনিজমের সঙ্গে বিপ্লবীদের মতের কোনো অমিল নেই। কেউ কেউ যখন বলত টেররিস্টদের কমিউনিস্টরা শত্রু বলে মনে করে, হেসে উড়িয়ে দিতেন কল্পনা। দু দলের আদর্শ যখন স্বাধীনতা—তখন পার্থক্য কোথায়?’
'৩৩ এর ১৬ই ফেব্রুয়ারি গৈরালা গ্রামে ইংরেজ ফৌজের সঙ্গে সংঘর্ষে মাস্টারদা ও তারকেশ্বর দস্তিদারের সঙ্গী ছিলেন কল্পনা। মাস্টারদা আর ব্রজেন সেন পরে পুলিশের হাতে ধরা পড়লেও কল্পনা পালিয়ে যান। কিন্তু তিন মাস পর ১৯ মে গৈরালা গ্রামে এক সশস্ত্র সংঘর্ষের পর কল্পনা সহ তাঁর সতীর্থ বিপ্লবীরা ধরা পড়েন।
১৯৩৮-এর প্রথম দিকে কল্পনার বাবা জেলে এলেন মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে, জানলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ অগ্নিকন্যা কল্পনার মুক্তির আবেদন জানিয়ে গভর্নরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। কল্পনা দত্তের বাবাকে লেখা রবীন্দ্রনাথের একটা ছোট্ট চিঠি দেখালেন, ‘‘তোমার কন্যার জন্যে যা আমার সাধ্য তা করেছি, তার শেষ ফল জানাবার সময় এখনো হয়নি, আশাকরি, চেষ্টা ব্যর্থ হবে না।’’ রবীন্দ্র বন্ধু সি এফ এন্ডরুজও কল্পনাকে জেল থেকে বের করার জন্য অপরিসীম পরিশ্রম ও আন্তরিক উদ্যোগ নিয়েছিলেন। গভর্নরের কাছে গিয়েছিলেন এবং কল্পনার বাবাকে অনুরোধ করেছিলেন ‘‘কল্পনা যেদিন মুক্তি পাবে সেদিন যেন তাকে টেলিগ্রাম করা হয়।’’
প্রায় ৬ বছর কারাভোগের পর, ১৯৩৯ সালে মুক্তি পান। মামলা চালাতে গিয়ে তাঁর বাবা সহায় সম্বলহীন হয়ে পড়েন। হারালেন বাড়িটাও।
জেল থেকে ছাড়া পেয়ে কল্পনা কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। জেলে বসে কল্পনা কমিউনিস্টদের সম্পর্কে কিছু কিছু শুনেছিলেন। জায়াড, কোলে, বার্নাড শ'র লেখা, সোশ্যালিজম, কমিউনিজম নিয়ে বইও পড়ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন কমিউনিস্টরা অনেক বেশি শিক্ষিত, পড়াশোনা করে, জানে অনেক বেশি। রম্যাঁ রল্যাঁর ‘আই উইল নট রেস্ট’ পড়লেন, 'সোল এনচান্টেড' আর ‘জা ক্রিস্তোফ’ পড়ে শুরু করলেন লেনিন পুজো।
কারাবাস থেকে মুক্ত হবার সাতদিন পরেই কল্পনা চলে আসেন চট্টগ্রামে। শুরু হয় তার অন্য জীবন। সে সময়ে নিষিদ্ধ থাকা কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকেন। দলের মহিলা ও কৃষক সংগঠনকে চাঙ্গা করেন। সাঁওতাল পাড়ায় গিয়ে কুলিদের পড়াতেন, মালিপাড়া, ধোপাপাড়ায় গিয়ে গোপন সভা করতেন। সাম্যবাদই প্রকৃত দেশপ্রেম এবং সেই দেশপ্রেম মানে জনগণের মনে আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলার কাজে আত্মনিবেদন করেন।
১৯৪০ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। তারপর তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন চালিয়ে যান। ইতোমধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। কল্পনাকে কলকাতা থেকে বহিষ্কার করে চট্টগ্রামে পাঠানো হলো। ১৯৪১ সালে চট্টগ্রামে জাপানী আক্রমণের আশঙ্কায় জাপান বিরোধী প্রচারকাজে অংশগ্রহণ করেন কল্পনা দত্ত।
১৯৪৩ সালে এদেশে ঘটে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। সারা বাংলায় ৫০ লক্ষ ও চট্টগ্রামে ২ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়। কল্পনার নেতৃত্বে মহিলা সমিতি নিরন্ন ক্ষুধাতুর মানুষদের সেবায় এগিয়ে আসে। ত্রাণের কাজে তিনি ঘুরে বেড়াতেন চট্টগ্রামের সর্বত্র। কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় দফতর তখন বোম্বেতে। কল্পনা দত্ত পার্টির কেন্দ্রে যান এবং মহিলা আন্দোলনে নিজেকে যুক্ত করেন। ওই সময়ে সিপিআই-এর সাধারণ সম্পাদক তরুণ কমিউনিস্ট নেতা পি সি জোশীর সঙ্গে তার পরিচয় ও প্রণয়। ১৯৪৩ সালের ১৪ আগস্ট তিনি পি সি জোশীর সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হয়ে কল্পনা দত্ত হলেন কল্পনা জোশী। বরপক্ষের হয়ে সই করেন বি টি রণদিভে আর কন্যাপক্ষের হয়ে মুজফফর আহমেদ। বিয়ের সময় শ্বশুর বাড়ির পাঠানো লাল রেশমি শাড়ি পরেননি কল্পনা। পরে সকলে মিলে সেই শাড়ি কেটে কেটে পার্টি ফ্ল্যাগ তৈরি করেছিলেন।
এরপর তিনি চট্টগ্রামে ফিরে যান এবং দলের মহিলা ও কৃষক সংগঠনকে চাঙ্গা করেন। ১৯৪৬ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম মহিলা আসনে কল্পনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী হয়ে, কংগ্রেস প্রার্থী দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহনের স্ত্রী নেলী সেনগুপ্তার বিরুদ্ধে। খেটে খাওয়া গরিব নিম্নবর্গের মানুষদের ভোটাধিকার সে সময় ছিল না। নির্বাচনে কল্পনা জয়লাভ করতে পারেনি।
কল্পনা দত্ত রুশ ও চীনা ভাষায় দক্ষ ছিলেন । দিল্লিতে অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব রাশিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজ-এর সম্পাদক ও শিক্ষিকা হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। সক্রিয় ছিলেন পঞ্চাশের দশকে স্থাপিত ইন্দো-সোভিয়েত কালচারাল সোসাইটি ও ন্যাশনাল ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান উইমেন-এর কার্যকলাপে। রাজনীতিতে দূরে থাকলেও জীবনাচরণে ও বিশ্বাসে আজীবন তিনি থেকে গিয়েছেন কমিউনিস্ট।
১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশ বিভাজন। তখন কল্পনা দত্তের কর্মক্ষেত্র ভারতবর্ষে। ১৯৪৮ সালে সিপিআই দলের দ্বিতীয় কংগ্রেসে ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়’ বলে উগ্র লাইন গ্রহণ করা হয়। পি সি জোশী পার্টির নেতৃত্ব থেকে অপসারিত হন এবং শোষণবাদী বলে সাজা প্রাপ্ত হন। একদিকে পুলিশের হুলিয়া, অপরদিকে পার্টিতে একঘরে। এই দুর্বিষহ অবস্থার শিকার শুধু জোশী নন, এই অবস্থার শিকার কল্পনা জোশীও। কলকাতায় গোপন ভাড়াবাড়িতে বন্ধুদের সাহায্যে কোনো রকমে তারা দিন যাপন করতেন।
তারকেশ্বর দস্তিদার চট্টগ্রামের সারোয়াতলীর চন্দ্রমোহন দস্তিদারের ছেলে। তারকেশ্বরকে সাথীরা ডাকতেন 'ফুটুদা' নামে।
চট্টগ্রাম বিদ্রোহের নেতাদের মধ্যে তারকেশ্বর দস্তিদারের স্থান ছিল সপ্তম। বিদ্রোহের এক মাস আগে পাহাড়তলীতে লুকিয়ে ১৭টা বোমার জন্য পিক্রিক পাউডার তৈরির সময় ভয়ঙ্কর এক বিস্ফোরণে তিনি মারাত্মক আহত হন। হয়তো বাঁচতেনই না, বুক, হাত, মুখ পুড়ে গেছিল। শরীরের নানা অংশের হাড় পর্যন্ত বেরিয়ে পড়ে। ঐ অবস্থায় কাতর কণ্ঠে অনন্ত সিংহকে বলেছিলেন, 'আপনি আমাকে গুলি করে মেরে সংগঠনকে বাঁচান।' কিন্তু মাস্টারদার নির্দেশে তাঁকে গোপনে গ্রামে পাঠিয়ে, চিকিৎসা করে বাঁচিয়ে তুলেছিলেন সবাই মিলে। ডি-ডে তে আর অংশ নিতে পারেননি বিপ্লবী তারকেশ্বর। কিন্তু সামান্য সুস্থ হয়ে গ্রামে পার্টি-সংগঠনের দায়িত্বভার তুলে নেন।
১৯৩০-৩১ সালে ডিনামাইট আর ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণ করে বন্দি মুক্তি আর ব্রিটিশ প্রশাসন অচল করার উদ্যোগে তারকেশ্বরের ভূমিকাও কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। ল্যান্ডমাইন তৈরির জন্য প্রচুর পরিমাণে গানকটন তিনি তৈরি করে দিয়েছিলেন।
জালালাবাদ যুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে। সবাই যখন ছত্রভঙ্গ, দলের হাল ধরলেন তারকেশ্বর। আহত অবস্থাতেও পলাতক সঙ্গীদের জন্য ঘুরে ঘুরে ব্যবস্থা করতে লাগলেন নিরাপদ আশ্রয়ের। মাস্টারদা তখন কানুনগো পাড়ার এমনই এক আশ্রয়ে, দারোগা শশাঙ্ক সেই আস্তানা জেনে ফেলায় তাকে গুলি করে মারেন তারকেশ্বর।
কিন্তু ২রা ফেব্রুয়ারি গৈরালা গ্রামে ধরা পড়ে গেলেন মাস্টারদা। বন্দি করে তাঁকে আনা হল চট্টগ্রাম জেলে। দলের হাল ধরলেন সেই ডাকাবুকো তারকেশ্বর। সঙ্গীদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলেন, মাস্টারদাকে জেল থেকে বের করে আনতেই হবে। কৌশল খাটাতে লাগলেন জেলের ভেতর। টাকা দিয়ে ওয়ার্ডারদের বশ করে অচিরেই জেলে পৌঁছে গেল বিস্ফোরক, রিভলভার, সেলের তালা খোলার জন্য ডুপ্লিকেট চাবি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ধরা পড়ে গেলেন এই কাজে থাকা শৈলেশ রায়। ফাঁস হয়ে গেল সবকিছু, পুলিশের নজরে চলে এলেন তারকেশ্বর দস্তিদারও।
১৯৪৭ সালে দেশ ভেঙে গেল। ভারতে চলে এলেন কল্পনা। ভারত-সোভিয়েত সাংস্কৃতিক সমিতির প্রতিদিনের কাজে রুশ ভাষার শিক্ষিকা হিসেবে নাম করলেন। '৫০ এর পরে নিউ দিল্লির রুশ ভাষা কেন্দ্রের চেয়ারপার্সন নিযুক্ত হন।
আর সেই ‘ফুটুদা’? সেই কথা কল্পনা দত্ত স্মৃতিকথায় জানিয়েছেন - ‘‘দুর্ভিক্ষের পরে বোম্বেতে একটা কনফারেন্স হয়েছিল। সালটা সম্ভবত ১৯৪৩। আমি চট্টগ্রামের প্রতিনিধি হিসেবে সেই কনফারেন্সে যোগ দিয়েছিলাম। সেখানেই জোশী আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। আমি বললাম আই হ্যাভ প্রমিসড্ তারকেশ্বর দস্তিদার। জোশী বলল, তুমি জানো না ওর ফাঁসি হয়ে গেছে। ও তো আর কোনদিন আসবে না। …তাও আমি দোনামোনা করছিলাম। বিটি(বিটি রণদিভে), ডক(ড: গঙ্গাধর অধিকারী) এরা ইনসিস্ট করাতে বিয়ে করলাম।’’
১৯৩৪-এ মাস্টারদার সঙ্গেই ফাঁসি হয়ে যায় তারকেশ্বর দস্তিদারেরও।
ফাঁসির আগে বিপ্লবীদের স্লোগানের মাঝেই বীভৎস অত্যাচার চালানো হয় মাস্টারদা আর তারকেশ্বরের ওপরে। হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে দাঁত, নখ সব ভেঙে দেওয়া হয়। সমস্ত জয়েন্ট আর হাড়গোড় গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। বলা হয়, আসলে আগেই মেরে ফেলে মৃতদেহকেই ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। ফাঁসির পর লাশদুটো জেলখানা থেকে ট্রাকে করে ৪ নম্বর স্টিমার ঘাটে নিয়ে গিয়ে মৃতদেহ দুটোকে ব্রিটিশ ক্রুজার “The Renown”-এ তুলে নিয়ে বুকে লোহার টুকরো বেঁধে বঙ্গোপসাগর আর ভারত মহাসাগরের মাঝামাঝি একটা জায়গায় ফেলে দেওয়া হয়।
ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় সমান দক্ষতা ছিল কল্পনার। চলি্লশের দশকে কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন মুখপত্র 'পিপলস্ ওয়ার' পত্রিকায় নিয়মিতভাবে প্রকাশিত তৎকালীন সামাজিক বিষয়ের ওপর তার লেখাগুলো গবেষকদের কাছে মূল্যবান দলিল হয়ে আছে। 'চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার আক্রমণকারীদের স্মৃতিকথা' কলকাতা থেকে প্রকাশিত তার লেখা গ্রন্থটি এক ঐতিহাসিক দলিল। ১৯৯০ সালে ''চট্টগ্রাম অভ্যুত্থান'' নামে ভারত সরকারের উদ্যোগে আর একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি ছিলেন বাংলাদেশের সমব্যথী। দেশ ভাগের পর ১৯৭৩ ও ১৯৭৫ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের আমন্ত্রণে দুবার বাংলাদেশে এসেছিলেন কল্পনা। ১৯৯১ সালে চট্টগ্রামে যুব আন্দোলনের ইতিহাস লিখতে শুরু করেছিলেন, শেষ করতে পারেননি। তার জীবনের স্মৃতিকথার তিন হাজার পৃষ্ঠার পা-ুলিপি হারিয়ে ফেলেছিলেন সামান্য এক ভুলের কারণে।
সেই মনোবেদনা নিয়েই ১৯৯৫-এর ৮ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কল্পনা দত্ত বেঁচে ছিলেন। সব লড়াইয়ে ‘ফুটুদা’-র ঐতিহ্য, আত্মত্যাগের শিক্ষা তাঁর সঙ্গেই ছিল।
কল্পনার জীবনের আক্ষেপ ছিল, তিনি তিন হাজার পৃষ্ঠার আত্মজীবনী লিখেও সেটা হারিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু যেটুকু স্মৃতিকথা লিখে গেছেন, বিচারাধীন থাকার সময় তাঁর 'ফুটুদা'র দেওয়া নিরীহ প্রোপোজালের কথা তাতে রেখেছেন। আর সেই স্মৃতিকথাই জানান দেয় এক অসম্পূর্ণ প্রেমকাহিনির। দুই বিপ্লবীর না-হওয়া সম্পর্কের কথা। অথবা, এই অসম্পূর্ণতাই হয়তো মিলিয়ে দিয়েছে তাঁদের। অপেক্ষাই। হয়তো…
শুভ জন্মদিন তোমায় হে বিপ্লবী , তোমাকে ধারণ করতে শিখুক বাংলার নারীরা,তুমি ত মুক্তির আরেক নাম।
সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাসে কল্পনা দত্ত একটি চিরস্মরণীয় নাম। স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে অসীম সাহস ও বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে চির জাগরুক হয়ে আছেন থাকবেন এক অকুতোভয় নারী যোদ্ধা-কল্পনা দত্ত। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার অধিকার নিয়ে বলিউডে 'খেলে হাম জি জান সে' শীর্ষক একটি চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছে, যার অন্যতম প্রধান চরিত্রটি ছিল কল্পনা দত্তের। এই ছবিতে তার চরিত্রে অভিনয় করেছেন বিখ্যাত বলিউড অভিনেত্রী দীপিকা পাড়ুকোন। জাতির মুক্তি ও জাতীয়তাবাদের আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা ছিলো অসামান্য। সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই প্রতিটি সংগ্রামে নারীরা ছিলেন সম্মুখযোদ্ধা।