সকাল সকাল ভাদ্র মাসের রোদটা চিড়বিড়করছে। ছিদাম চিৎপুর এর কাছে যেখানে মারাঠা খালটা শুরু হয়ে হেলে সাপের মত একটু বাঁক নিয়ে কলকাতার পেটের ভিতরে ঢুকে গেছে সেখানে নতুন গড়ে ওঠা ঘাটটার মুখে দাঁড়িয়ে ছিল। সপ্তগ্রাম থেকে মিহি-কাউন্ট এর বেশ কিছু সুতোর নুটি নৌকা করে প্রথমে এখানে এসে ভিড়বে। মাঝি এবং তাঁতী দুজনেইকলকাতায় নতুন আসছে। ছিদামের উপর তাই দায়িত্ব পড়েছে এখান থেকে তাদের সঙ্গে নিয়ে শোভাবাজারের ঘাটে পৌঁছানোর। সেখান থেকে সুতানুটিতে শোভারাম বসাকের গদিতে।
ছিদাম কিছুটা সকাল সকাল ইএসে দাঁড়িয়েছে ঘাটের মুখে।রাস্তায় চিত্তেশ্বরী মন্দিরের দিকে ঝুপুস হয়ে পুরো ভেজা এক আধটা পালকি মাঝে মাঝে যাচ্ছে আসছে। বড় ঘরের মেয়ে বউরা ওই পালকিতে গঙ্গাস্নান সেরে মন্দিরে পুজো দিতে যাচ্ছে। বনেদি বাড়ীর বউ মানুষরা আব্রু রেখে গঙ্গাস্নান করবার জন্য পালকি সমেত ই গঙ্গায় নেমে যায়। বেহারারা কোমর জলে দাঁড়িয়ে তাদের পালকি সমেত গঙ্গায় একবার চোবায় একবার তোলে। পালকির ভেতরে বসেই আব্রু রক্ষা করে মা জননীরা গঙ্গাস্নানের পুণ্য লাভ করেন।
এই বেহারারা এখন মোটামুটি উৎকল বাসী অধিকাংশ। কলকাতা
কিংবা সুতানুটির অধিকাংশ সম্পন্ন গৃহস্থ বাড়িতে পালকি রাখে। পালকি রাখলে বেহারাও রাখতে হয়। বেহারাদের পালকি বওয়া ছাড়া আর একটা অতিরিক্ত দায়িত্ব থাকে বাড়িতে বাড়িতে উনুনে জ্বালানোর জন্য কাঠ চেরাই করা।
ডিহি কলকাতায় কাজের ধান্দায় যখন ছিদাম প্রথম এসেছিল বেলেঘাটার কাছে খালের ধারে
কেলে সাহার কাঠের গুদামেও কাজ করেছে কিছুদিন। সুন্দরবনের দিক থেকে নদী করে বিস্তর পরিমাণ কাঠ মাতলা বিদ্যাধরী নদী হয়ে বেলেঘাটায় আসে। সেখান থেকে মেলা লোক কাঠ বিক্রি করে ফেরে নতুন গড়ে ওঠা শহরে। সেই কাঠ লোকের বাড়িতে বাড়িতে চেরাই করবার দায়িত্বটাপালকি বেহারাদের।
যাদের পালকি পোষার ক্ষমতা নেই তাদের অবশ্য নিজেদের ব্যবস্থা নিজেদেরই করতে হয়।
ছিদাম ইংরেজদের রবরবার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে ওঠা এই শহরটায় গ্রাম ঘরে যে অসংখ্য মানুষ রোজ এসে ভিড়ছে রুটি রুজির খোঁজে তাদের একজন।
ছিদমের তিন কুলে কেউ নেই।
তাই পিছুটান বলতেও কিছু নেই।
নদীয়ার একজমিদার বাড়িতে আশ্রিত হিসেবে শ্রীদাম ঘাঁটি গেড়েছিল। ইংরেজরা জমিদারিতে সূর্যাস্ত আইন চালু করবার পর অনেক পুরনো জমিদারের জমিদারি লাটে উঠেছে। ছিদামের আশ্রয়দাতা জমিদার বাবুর ভাগ্যেও তাই ঘটেছে। অগত্যা আশ্রয়চ্যুত আরো অনেক ভাসমান মানুষের মত খরকুটোর খোঁজে কলকাতায় এসে ভিড়েছে।
ছিদামের অনুষ্ঠানিক পড়াশোনা বিশেষ নেই। কিন্তু বাস্তব বোধ
প্রখর।
ছিদাম টের পাচ্ছিল শুধু ইংরেজদের কারণে নয় ।হুগলির সপ্তগ্রামের দিনও পুরোপুরি ফুরিয়ে এসেছে। বড়বাজার গায়ে গতরে বাড়ছে। হাওড়ার সাঁকরাইলের দিকে বেতরের বন্দরের রমরমা। সুতরাং নতুন করে মাথা গোঁজার জায়গা খুঁজতে হলে ডিহি কলকাতা এবং সুতানুটি সরেশ স্থান বটে।
অসুবিধে এখনো বিস্তর। কিন্তু কিছু করবার নাই।
ছিদাম যে শোভারাম বসাকের গদিতে আশ্রয় পেয়েছে, সেই শোভারামও কলকাতার আদিবাসিন্দা কেউ নয়।
শোভারাম ছিলেন মকসুদাবাদে।
লাগাতার বর্গির হাঙ্গামা শুরু হলে সপরিবারে কারবার উঠিয়ে নিয়ে চলে আসেন সপ্তগ্রামের হলদিপুরে। পরে কোম্পানির সঙ্গে কারবার শুরু হতে গোবিন্দপুর এসে ডেরা বাঁধেন। কিন্তু পলাশীর যুদ্ধের পর ব্রিটিশরা যখন ঘরের মাঠে নতুন কেল্লা করবার মতলব করলে, তখন শোভারাম ফের ঠাঁই নরা হয়ে বড় বাজারের দিকে চলে যান। শোভারামকিছুদিন হল গত হয়েছেন। এখন শোভারামের ছেলেরাই কারবারের কর্তা। মূল গদি বড় বাজারে হলেও সুতানুটির বাজারেও গুদাম রয়েছে।
সরস্বতী নদীর জল শুকিয়ে আসতে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে সপ্তগ্রামের পতন ঘটতে শুরু করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও শোভা রামের বেশ কিছু দাদনি তাঁতী এবং সুতো কাটনিসপ্তক গ্রামের হলদিপুরে থেকে গিয়েছে। তাদের কাছ থেকে ফাইন কাউন্টের সুতো আসবে। আপাতত ছিদাম তারই অপেক্ষায়।
ছিদাম মারাঠাখালের দিকে একবার তাকালো। জোয়ার চলছে। কল কল করে জল ঢুকে যাচ্ছে মারাঠা খালে। ছিদাম শুনেছে বছর চল্লিশ আগেওএই খালটা ছিল না। ১৭৪০ -৪১ সন নাগাদ কলকাতা নেটিভরা নিজেদের উদ্যোগে মারাঠাবর্গীর হামলা ঠেকাতে শহর ঘিরে এই খাল কাটিয়েছে। আলিবর্দী খাঁ কাটোয়ার কাছে ভাস্কর পন্ডিতকে খতম করবার পর বর্গী হামলার ভয় কিছুটা কমেছে বটে। কিন্তু খাল টা থেকে গিয়েছে।
সাহেবদের কোম্পানি নাকি খাল কাটার জন্য কিছু টাকা কর্জ দিয়েছিল তাও সুদে আসলে শোধ করতে হয়েছে কোম্পানীকে।
গঙ্গায় জোয়ার চলছে। ভাটি থাকলে হুগলির দিক থেকে নৌকা আসতে একটু সুবিধা হত।
জোয়ার ঠেলেআসতে নিশ্চয়ই দেরি হবে।
ছিদাম কিছুপরে গঙ্গার দিকে তাকায়।
মাঝ গঙ্গায় একটা মৃতদেহ ভেসে যাচ্ছে। গঙ্গায় ভাসমানশবদেহের গতিবিধিদেখে ছিদামবুঝতে পারে এবার ভাটা শুরু হবে।
কলকাতার মানুষের এক বিচিত্র অভ্যাস। মৃতদেহ অর্ধেক পুড়িয়ে বা একেবারেই না পুড়িয়ে সোজাসুজি গঙ্গায় ফেলে দেয়।
একটা দাঁড় কাক উড়ে এসে
মৃতদেহের উপর বসে। ছিদাম চোখ সরিয়ে নেয়।
ছিদান সুতানুটিতে এখন যেখানে আস্তানা গেড়েছে সেখানেই এক রহস্যময় মানুষের সঙ্গে তার মাঝে মাঝে গপ্পো হয়। তার নাম জটাকেশ। জটাকেশ নাম কেন এটা অবশ্য ছিদাম এর কাছে পরিষ্কার হয় না। কারণ তার মাথায় জটার চিহ্ন মাত্র নেই।
বরঞ্চ বেশ ঝাঁকড়া কেশগুচ্ছ রয়েছে। রীতিমতো বাবরি স্টাইলে। জটাকেশের জীবিকা অদ্ভুত। সে বিভিন্ন রকমের পায়রাদের প্রশিক্ষণ দেয়।
সেসব পায়রা বাবুরা বহু দামে কেনে।
জটাকেশ দাবি করে বংশানুক্রমে শেখাতার নাকি কাকেদেরও প্রশিক্ষণ দেওয়ার ক্ষমতা আছে। অতীতকালে তার পূর্বপুরুষদের তালিম দেওয়া কাকেদের নিয়ে নাবিকরা নৌযাত্রায় রওনা হতো।
অচিন দরিয়ায় দিক চিহ্নের খোঁজে এবং ডাঙ্গা খুঁজে বার করবার ব্যাপারে সেই কাকেদের নাকি অদ্ভুত দক্ষতা। জটাকেশের র পূর্বপুরুষদের দেওয়া তালিম প্রাপ্ত কাকেরামহাসমুদ্রে উড়ে গিয়ে ঠিক দিক চিহ্ন এবং ডাঙ্গা খুঁজে বার করে দিত।
এই মুহূর্তে ছিদামের মনে হয়
মরার বুকের উপর বসে থাকা ওই কাকটা আপাতত যদি তাকে এইটুকু বলে দিতে পারতো
শোভারামেরগদির ওই সুতারনুটি বোঝাই সপ্তগ্রামের নৌকা কখন এসে পৌঁছবে তাহলে তার ভারী উপকার হতো।
(চলবে)