সমাজসচেতনার পাঠ কবে নেব আমরা?

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর ছয়ের দশকে লেখা উপন্যাস ,' সরল সত্য' তে শিশু মনস্তত্ত্বের একটা দিক এনেছিলেন।মধ্যপ্রদেশের রেওয়া জেলার রাভা গ্রাম দেখিয়ে দিল, ছয়ের দশকের এলাহাবাদ প্রবাসী বাঙালি জীবনের একটা খন্ডাংশের ছবি আজ কি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে ভারতীয় জীবনে--
 
 
মধ্যপ্রদেশের রেওয়া জেলার জাভা থানা-- সেখানকার একটি গাঁয়ের তেরো বছরের একটি ছেলের , নিজের নয় বছরের বোনের উপর ভয়াবহ যৌন নির্যাতন, নির্যাতনের পর বোন কে মেরে ফেলা- মায়ের কাছে স্বীকারোক্তি , মোবাইলে পর্ণোগ্রাফি দেখে এমন কাজ করেছে, মা - পরিবার ঘটনাকে ধামা চাপা দেওয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা করেও শেষ রক্ষা করতে পারে নি-- কেমন যেন মনে করিয়ে দিচ্ছে নয়ের দশকের গোড়ার দিকে , শারদ ' আজকাল' এ প্রকাশিত দেবেশ রায়ের উপন্যাস, ' দাঙ্গার প্রতিবেদন' এর একটা সংলাপ,' রেপ ভি হুয়া , খুন ভি হুয়া' ।
মধ্যপ্রদেশের খবর টা ইংরেজি- বাংলা প্রায় অনেককটা কাগজেই প্রকাশিত হয়েছে।তাই অনুমান করা যায়, অনেক মানুষ ই খবর টা পড়েছেন।পড়ে হয়তো নিজের মনে এমনটাও ভেবেছেন, একদিন এমন ঘটনার খবর , খবরের কাগজে মিলতো সাগরপারের দেশ ঘিরে। আর সেটা ভাবতে ভাবতেই নিজের দেশে এমন ঘটনা ঘটেছে দেখে ভাবছেন নিশ্চয় ই, একটা ঘটনার কথা যখন খবরের কাগজে এসেছে, তবে না জানি এমন কত ভয়ঙ্কর ঘটনাই আমাদের এই দেশে ঘটে চলেছে অহরহ।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ,' সরল সত্য' উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৯ সালের নভেম্বর মাসে। ওই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র অংশুমান দত্তকে তার বন্ধু মিহির,' ছেলেবেলায় , সেই তের বছর বয়সে মনে হয়েছিল , কী খারাপ ওইসব ছবি- কী ভয়ংকর পাপের দৃশ্য!' -- দেখিয়েছিল। 
সাতের দশকের একদম গোড়ার দিকের উত্তরপ্রদেশের এলাহাবাদের প্রবাসী বাঙালি জীবনের একটা খন্ডাংশ সেদিন এঁকেছিলেন সুনীল।
সেদিনের সমাজে এমনটা ছিল কিন্তু সত্যিই একটা ভগ্নাংশের চিত্র ।তবুও  ছিল এই ছবি। সমাজের নানা ধরনের বিধি-বিধান সেদিন ছিল আজকের তুলনায় অনেক অনেক বেশি। ভারতীয় সমাজের' মূল্যবোধ ' নামক বিষয়টি নানা ধরনের বজ্র আঁটুনি মধ্যে দিয়ে পরিচালিত হতো এ কথা সত্যি। কিন্তু সেই পরিচালন ব্যবস্থার মধ্যেও যে ফসকা  গেঁরো  ছিল‌-- তা তো আমরা উনিশ শতকের সমাজচিত্রে যেমন দেখতে পেয়েছি , তেমনি দেখেছি বিশ  শতকের প্রথমদিকে সমাজ চিত্রের নানা বিবরণের মধ্যে দিয়ে। 
রাসসুন্দরী দেবীর জীবন কাহিনী থেকে শুরু করে যখন আমরা কল্যাণী দত্তর ,'পিঞ্জরে বসিয়া ' র যুগে এসে পা রাখলাম। সামাজিক চিত্রের অন্ধকার দিকটির এই বৈশিষ্ট্যগুলোর মৌলিক পরিকাঠামোর কিন্তু খুব একটা অদল বদল যে ঘটছে তেমনটা কিন্তু আমরা একবারের জন্য দেখতে পেলাম না। বুঝতেও পারলাম না।
 আমাদের কাছে মনে হলো, সেই,' শেখ আন্দু'র যুগকে নিয়ে  যে কথাগুলি শৈলবালা ঘোষজায়া  বলেছিলেন, তার থেকে যেমন রাসসুন্দরীর সময় কালের খুব একটা ফারাক ছিল না ,তেমনি ফারাক ছিল না রোকেয়ার অবরোধবাসিনীর কালের কথার ও। তারই মধ্যে কিন্তু আমরা দেখেছি,' সেকালে আমাদের কাল' সুফিয়া কামালের এই লেখার মধ্যে পিঞ্জর থেকে বেরোনোর জন্য পাখিদের ডানা ঝাপটানোর বিষয়টিকে। আহত হয়েছে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে পাখিরা ,কিন্তু তা বলে তারা ডানা ঝাপটানো বন্ধ করেনি। পিঞ্জর কে ভেদ করে তারা মেঘে বসিবার ঠাই না থাকলেও, মুক্ত আকাশে উড়বার কথা ভেবেছে । সেই ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার   ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়ই সফল হয়েছে।
৬০ এর  দশকের শেষ সময়কালের প্রেক্ষিতে লেখা সেই উপন্যাসের মধ্যে সুনীল,' সরল সত্য'  হিসেবে শিশু মনস্তত্ত্বের অনেক দিকগুলি নিয়ে এসেছেন। যেমন নিয়ে এসেছেন সমকামিতার বিষয়টিকেও ।বোধহয় বাংলা সাহিত্যে এতটা সাহসী মানসিকতা সুনীলের আগে সেভাবে খুব কম মানুষই দেখাতে পেরেছেন।
 যৌনতা ঘিরে অনেক ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা সমরেশ বসু করেছেন। তার জন্য কখনো তিনি অভিনন্দিত হয়েছেন। বুদ্ধদেব বসুর মত মানুষ ,যিনি ও এককালে যৌনতার সৌন্দর্যকে বিকশিত করবার লক্ষ্যে 'রাতভরে বৃষ্টি'র মতো উপন্যাস সৃষ্টি করেও সামাজিক বিচ্যুতিকে তোল্লাই  দিচ্ছেন-- এমন অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন ।সেই মানুষটিও সমরেশকে যখন বিদীর্ণ করা হচ্ছে যৌনতাকে আড়ালে না রেখে, প্রকাশ্যে তাকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসার জন্য,  তখন তিনি সমরেশের পাশে দাঁড়াচ্ছেন।
              আজকের দিনে দাঁড়িয়ে গত শতকের পাঁচ ছয়ের  দশকের সেইসব বিতর্কগুলোকে আমাদের কেমন একটা জোলো অসার বিতর্কে বলে মনে হয়। বিশেষ করে বাজার অর্থনীতি, মুক্ত হওয়া --এইসব বিষয়গুলি, পশ্চিমের শহর থেকে যখন আমাদের পূবের আকাশকে ছেয়ে ফেলে, তখন আমরা অনেক ধরনের আধুনিকতাকে যেমন বরণ করে নিই, ঠিক তেমনি ই আধুনিকতার নাম করে অনেক কদর্যতাকেও আমাদের চলমান জীবনের অঙ্গ করে নিতে চেষ্টা করি।
 এইরকম একটা সময় সুনীল যে শিশু মনস্তত্ত্বের সেই ভয়াবহ দিকটি প্রকাশ্যে নিয়ে আসলেন, সেটি কিন্তু বাংলা সাহিত্যের জগতে কেবল একটা মাইলফলক ছিল না ,শিশু মনস্তত্ত্বেও যে একটা বদল আসছে, আর সেই বদলের পেছনে যে নানা আর্থ-সামাজিক- সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল একটা বড় ধরনের অনুঘটকের ভূমিকা পালন করছে ,সেটা দেখাবার ক্ষেত্রেও সুনীল কিন্তু পিছ পা হন নি।
আজ যখন মধ্যপ্রদেশের রেওয়া জেলার জাভা গ্রামের ওই শিশুটির ঘটনা খবরের কাগজে আমরা পড়ছি ,তখন কিন্তু এটা মনে রাখা দরকার যে, সময়ের উপযোগী করে যদি শিশু মনস্তত্ত্বকে আমরা পরিচালিত করবার চেষ্টা না করি, তবে কিন্তু নিজের অজান্তেই একটি শিশু নানা ধরনের বিকারের রোগী হয়ে উঠবে ।
এই যে শিশুটির অপরাধের ঘটনাটি এখন সকলের সামনে এসেছে, তাকে কেন্দ্র করে এই প্রশ্নটি প্রথমেই তুলতে হয় যে ,শিশুটি তো একদিনে এন্ড্রয়েড মোবাইলে নানা ধরনের পর্ন ছবি দেখবার অভ্যাস তৈরি করেনি। একদিনের ঘটনার জেরে তো আর সে নিজের ছোট বোনকে ধর্ষণ করে ,খুন করবে না। একাধিক দিন সে ওই ধরনের নীল ছবি দেখতে দেখতে তার মনস্তত্ত্বে যে পরিবর্তন ঘটছে ,সেই পরিবর্তনের আভাস ইঙ্গিত কিন্তু তার নিত্য দিনের চলাফেরার মধ্যে ,যাপন চিত্রের মধ্যে ফুটে উঠবেই ।
এখানেই প্রশ্ন হল অভিভাবকদের ভূমিকা র।
যদি শিক্ষামূলক প্রয়োজনে সন্তানের হাতে এন্ড্রয়েড ফোন যুগোপযোগী ধারায় তুলে দিতেই হয়,  তাহলে সেই ফোনটি সে কিভাবে ব্যবহার করছে, তার উপরে কি কোন লক্ষ্য  অভিভাবক রাখবে না? 
 এখানে যদি 'নজরদারি ' শব্দটি ব্যবহার করা হয় ,তাহলে রাষ্ট্রিক 'নজরদারি' র প্রসঙ্গের অবতারণা করে অনেকে আপত্তি করতে পারেন। কিন্তু প্রশ্ন হল , মানুষের ব্যক্তি জীবন সম্পর্কে রাষ্ট্রের নজরদারি করবার অধিকার না থাকতে পারে। কিন্তু একটি নাবালক সন্তানের জীবন গড়ে তোলবার ক্ষেত্রে তার অভিভাবকদের খেয়াল রাখা-- এই বিষয়টিকে কিন্তু আদৌ  রাষ্ট্রের নজরদারির সঙ্গে কোনো অবস্থাতেই তুলনা করতে পারা যায় না। 
রাষ্ট্র নজর রাখে রাষ্ট্র ক্ষমতাকে পরিব্যপ্ত করবার তাগিদ থেকে ।কিন্তু একজন অভিভাবক , মা ই হোন, বাবা ই হোন --তিনি কিন্তু তাঁর সন্তানের দিকে নজর রাখেন ,তার জীবনের সুস্থিতির লক্ষ্যে। সন্তানের জীবনকে সুস্পষ্ট ভাবে গড়ে তোলবার স্বার্থে। সেক্ষেত্রে এই প্রশ্নটাই বড় হয়ে দাঁড়ায় , মধ্য প্রদেশের ওই শিশুটির উপর অভিভাবকের যে দায়িত্ব, সেই দায়িত্ব কি অভিভাবকেরা পালন করছিলেন?
হঠাৎ করে এক সকালে উঠে দেখা গেল, একটি মানুষ যৌন বিকৃত হয়ে পড়েছে-- এমনটা কিন্তু বিজ্ঞান বলে না। যেকোনো ধরনের  বিকৃতি ,সেটা মানসিক হোক, যৌনজনিত নানা রকমের বিষয় ঘিরে হোক-- সেগুলি ধীরে ধীরে ডানা মেলে ।তাই প্রশ্ন হল, ওই ছেলেটি একদিনে তার নিজের ছোট বোনের উপর এই ধরনের আচরণ করতে পারি কি? 
 ছেলেটির পরিবারের পুলিশকে বলা নানা ধরনের কথাবার্তা ঘিরে পুলিশের মধ্যে বহু ধরনের সন্দেহ তৈরি হচ্ছে ।ছেলেটির অপরাধকে আড়াল করবার জন্য গোটা ঘটনাটিকেই ছেলেটির পরিবার অন্য খাতে বইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল,  সেটাও আমরা খবরের কাগজ পড়েই জানতে পারি। এখান থেকেই আমাদের এই সন্দেহটা তীব্র হয়ে উঠছে যে, নিজের বোনের প্রতি যে আচরণ ছেলেটি করেছে ,সেই আচরণের বহিঃপ্রকাশ কিন্তু হঠাৎ করে একদিনে ঘটতে পারে না 
 সে ক্ষেত্রেও ছেলেটির পরিবার,  পরিবারের সম্মানের নাম করে নিশ্চয়ই কোথাও একটা কিছু লুকোচ্ছে। তবে দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, ছেলেটির মধ্যে বিকৃতির  বিকাশ ঘটছে-- এটা জানবার -বোঝবার পরেও নিশ্চয়ই তার পরিবার সতর্কতা অবলম্বন করেনি ।মনোরোগের চিকিৎসকের কাছে ছেলেটিকে নিয়ে যায়নি। তাহলে হয়তো এত বড় বিপদ নাও ঘটতে পারতো। ফুলের মত নিষ্পাপ একটি শিশু কন্যার ওভাবে মৃত্যু কিছুতেই ঘটতো নাতাহলে ।
এই ধরনের ঘটনাগুলিকে আড়াল না করে, সামাজিক ব্যাধি হিসেবে না দেখে ,ব্যতিক্রমী ঘটনা হিসেবে দেখেও,  সামাজিক শিক্ষা নেওয়ার জন্য সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা দরকার।

  • সম্পাদকীয়