শৈবালদাম 

বালির উপরে কমলা শুয়েছিল একটু দূরে পাশে বসেছিল শাওন দুজনেরই গায়ে-পিঠে বালি লেগেছিল শাওন উঠে দাঁড়াল সরাসরি জিজ্ঞেস করল, তাহলে এখন তুমি কি করতে চাও?

 

এখনও শাওনের কথা শুনলে পরেই যে কেউ ধরে ফেলবে সে এই উপকূলভূমের কেউ নয় তবুও শাওন কমলাকে ভালোবাসে ভাষার দূরত্ব তাদের মানসিক নৈকট্যে এতটুকুও প্রভাব ফেলতে পারেনি আদতে যে দুটিতেই নোনা জলের প্রাণ দুজনের ঘাম থেকেই নুনের গন্ধ পাওয়া যায় দুজনেরই গায়ে-মাথায় বালি কিরকির করে দুজনেরই হাতে পরিচিত আঙুল দুজনেই একে-অপরকে ভালবাসছে আজ এবারে কমলা শোয়া অবস্থা থেকে পিঠ সোজা করে উঠে বসল সে শাওনের দিকে তাকায় যাব আমি তোমার সঙ্গে আমি মনস্থির করে ফেলেছি

 

শাওনের বুকে কিসের যেনছলাৎশব্দ হয় সে নিজেকে সামলিয়ে রাখে সামনে এখনও অনেকগুলো ধাপ বাকি রয়েছে এই পথে শাওনের যাতায়াত নতুন নয় সে জানে এখনও কতখানি বিপদ সামনে সে কেবল কমলার বামহাতটাকে তার ডানহাতের মুঠির ভিতরে নেয় তার মনে পড়ছে কক্সবাজারের রাত সমুদ্রে উত্তাল ঢেউ ছিল সেদিন

 

কমলার সঙ্গে দেখা না হলে সামুদ্রিক শৈবালেরও যে বাজারে এমন দাম পাওয়া যায় শাওনের তা জানা হত না কেমন করেই বা জানবে শাওন? কক্সবাজারের জেলেপট্টিতে ছিল তার বাস বাপকে নিল ঝড়ে খেতে না পেয়ে, বিনা চিকিৎসায় মায়েরও মেয়াদ ফুরুল তরতর করে লোকজনেরা সব ঢাকায় গিয়ে বাসা নিচ্ছে জানতে পেরে সেই পথেই হেঁটেছিল শাওন দুকামরার ঘর আর বিশ-তিরিশজন মদ্দ-মেয়েমানুষ মিলিয়ে গাদাগাদি করে থাকা কাপড়ের কলে কাজ রাতে খাবার বলতে রুটি আর তেল-ঝোলের গোস্ত শাওন পেরে উঠছিল না সেই সময়েই তার দেখা হয় তাজভাইয়ের সঙ্গে বেমক্কা গরিব মানুষকেও নাকিফরেনে সেটলকরিয়ে দেয় এই তাজভাই ওরফে তাজউদ্দিন শেখ ইয়ার-বন্ধুদের থেকে শাওনও তেমনটাই শুনেছিল তখন সস্তার ছোট মোবাইলে ছবি বের করে শাওনকে দেখিয়েছিল একেকজন কেমন করে তাদের বেরাদরেরা সবফরেনেপাড়ি জমিয়েছে রেফিউজিনাম হলেও, সুখে-শান্তিতে সেখানে সংসার তাদের সুইডেন, ইতালি, ডেনমার্ক, এমন নামগুলো স্রেফ শুনলে পরেও বুকের ভিতরটা কেমন জানি ঠাণ্ডা বোধ হয় শাওন তার বুকের ভিতরে জ্বলতে থাকা সমুদ্র-জলের লবণাক্ত ঝালটাকে হারিয়ে ফেলে ইউরোপীয় ঘাসজমির মিষ্টতা অনুভব করে কিন্তু ঢাকা থেকে ট্রাকে উঠবার সময়েই শাওন ঠাহর করেছিল সুদিনের স্বপ্ন বয়ে আনাফরেনেরপথটুকু বোধহয় অতখানিও সহজ নয়

 

নুনজলে ঝুপ করে ডুব দিয়ে যায় কমলারা একেকজন

 

জায়গাটা পাম্বান দ্বীপের খুব কাছেই, পূর্ব-ভারতের তামিলনাড়ু উপকূল দুহাতের দশ-আঙুলের উপর কাপড় আর রবারের হাতে-হাতে বানিয়ে নেওয়া নামমাত্র প্রোটেকশন তার ভরসাতেই তাদের সমুদ্রের জলে ডুব দিতে হয় আজকাল সামুদ্রিক আগাছা বা শৈবালেরও দাম বেড়েছে খুব কোথাও বা পুনর্নবীকরণযোগ্য কাপড়ের ব্যাগ তৈরিতে সেই আগাছা বা শৈবাল ব্যবহার করা হচ্ছে, আবার কোথাও বা শৌখিন মানুষের খাবার হিসেবেও তাদের দর চড়ে বসেছে কমলার মতো মেয়েরা তাই ভোর না হতেই ভটভটি ভাড়া করে চলে আসে সমুদ্রের প্রবালপ্রাচীরের কাছাকাছি এই দ্বীপগুলোয় তারপর জোয়ার বাঁচিয়ে চলে উদয়াস্ত পরিশ্রম মাসে মাসে দুই সপ্তাহের বেশি এই কাজ করা যায় না কারণ পূর্ণিমা-অমাবস্যার কাছাকাছি সময় জোয়ার বাদ দিয়েও সাগর-জলের টান থাকে বেশি এছাড়াও ঋতুর ভিত্তিতে বছরে পাঁচ থেকে ছয় মাস মাত্র এই শৈবাল তোলা যায় তবু কমলারা এর উপরেই নির্ভরশীল বিশেষত এপ্রিল থেকে জুন মাস, এই সময়ে যখন গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়া বারণ হয়ে যায় কমলাদের ঘরের জোয়ান-মদ্দরাও একেবারে বেকার হয়ে পড়ে সরকার থেকে তাদের ভাতা দেয় বটে, মুষ্টিভিক্ষে মাত্র কয়েক গ্রাস, কিন্তু তাতে পেট চলার ব্যবস্থা হয় না উলটে এখন গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতোই তৈরি হয়েছে মান্নার সামুদ্রিক ন্যাশনাল পার্ক নাকি সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র বাঁচাতে শ্যাওলা তোলার উপরেই পুলিশি কড়াকড়ি শুরু হয়েছে ধড়পাকড় মানুষ যাবে কোথায়? খাবে কি? নিজেকে অসহায় মনে হয় কমলার এদিকে তো গরম বাড়ছে প্রতি বছর তারই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শ্যাওলার মান-পরিমাণ দুইই কমছে ভগবান না কে যেন আছেন ওই আকাশটায়? তিনি তো বোধহয় আমাদেরই মতো মানুষদের গলা টিপে ধরে মারতে চান একা বালির উপরে শুয়ে কমলা প্রায় চিৎকার করে ওঠে!

 

ইণ্ডিয়ার ভিতর রাতে কোথাও হাইওয়েতে গাড়ি দাঁড়াতেই, কোনওমতে ট্রাক থেকে নেমে পড়ে পাঁইপাঁই করে ছুটেছিল শাওন মিথ্যে, মিথ্যে, মিথ্যে তার পাঁজরের কলকব্জাগুলো সব হাপরের মতো ওঠানামা করছিল তবুও সে একবারের জন্যও দাঁড়ায়নি কোথাও ঠিক যেমন ভাবে ঢাকা থেকে গভীর রাত্তিরে রওয়ানা হওয়ার পর, বলে দেওয়া হয়েছিল ইরান-ইরাক-লেবানন, যেখানেই তাদের মরুভূমির উপর দিয়ে পায়ে হেঁটে সীমানা পার হয়ে যেতে হবে, সেখানেই কোনওদিকে না তাকিয়ে স্রেফ সামনের দিকে ছুটে যেতে হবে অবিশ্রাম সীমান্তরক্ষীবাহিনীর হাতে গুলি খেয়ে তখন কেউ হঠাৎ লাশ বনে গেলেও, তাজউদ্দিনের সেই বিষয়ে কোনও দায়িত্ব নেই তারও পরবর্তীতে আসবে রবারের ভেলায় চেপে সাগর পাড়ি দিয়ে গ্রিস অথবা ইতালির উপকূলের কাছাকাছি ভেসে গিয়ে সাঁতরে জমিতে ওঠার প্ল্যান এরই নাম মানুষপাচার হিউমান ট্র্যাফিকিংয়ের জাল নিজেদের সবটুকু সঞ্চয় এইশেখতাজউদ্দিনেদের মতোই একেকজনের হাতে সঁপে দিয়ে শাওনের মতো মানুষেরা নরউজিয়ান বনেসেটলকরতে চায় ট্রাকের ভিতরটা মানুষের ময়লার গন্ধে ভরে উঠেছিল

 

চরম অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ তারই মধ্যে শাওনকে আরও শাসিয়েছিল তাজ তার নাকি কুড়ি হাজার টাকা মতো বাকি পড়ে রয়েছে দিল্লি পৌঁছনোর আগেই সে টাকা মিটিয়ে দেওয়া চাই চোখে অন্ধকার দেখেছিল শাওন তার সবটুকু সঞ্চয় বরবাদ হয়ে গিয়েছে

 

যে জায়গায় ট্রাক থেকে নেমে পড়ে ছুট দিয়েছিল শাওন, সে জায়গার নাম মোকামাঘাট সময়ের স্রোতে ঘুরপাক খেতে খেতে একদিন শাওন চেন্নাইতে এসে উঠেছিল সেই থেকেই এই পাম্বান উপকূল ডাব-নারকেলের দোকানঘর কিন্তু কমলাকে নিয়েই এবারে সে এখান থেকেও পালাতে চায় শ্যাওলা আর আগাছার উপর নির্ভর করে এই অর্থনীতি আর বেশিদিন চলবে না আগেভাগেই তাই কমলাকে বেচে দিয়েছে তার বাপ মুখে অবশ্যবেচে দিয়েছেবলেনি বলেছে কেবল মুম্বাইতে কাজের ব্যবস্থা হয়েছে তিন সপ্তাহেই নাকি রওয়ানা হওয়ার দিন রোজ এই কদিনের মধ্যে শাওনের সঙ্গে দেখা করে কথা বলেছে কমলা ক্রেতালোকটিকেও চিনতে পারা গিয়েছে শাওন কমলাকে আশ্বস্ত করতে চায় লোকটির ড্রাইভারের সঙ্গে তার ষড় রয়েছে কমলাকে যে করেই হোক সে বের করে আনবে আজ সেই রওয়ানা হওয়ার রাত

 

-“কি রে মেয়ে! এত বেলাতে তুই এখানে একা একা বালিতে বসে আছিস?

 

ধমক খেয়ে নিমেষের মধ্যে বালি থেকে পিঠ তুলে সোজা হয়ে উঠে বসে কমলা লক্ষ্মীআম্মাকে ভয় পায় না এমন মেয়েমানুষ এই চত্বরে কেউ নেই আশির কাছাকাছি বয়স তাঁর সেই বারো বছর বয়স থেকেই নাকি সমুদ্রে ডুব দিয়ে দিয়ে তিনি এই কাজ করে এসেছেন তখন অবশ্য শ্যাওলার দাম ছিল না তেমন মাছের খাবার হিসেবেই অল্প দামে কিছু কিছু বিক্রি করা যেত ক্রমে দাম বাড়ল, লোক বাড়ল প্রায় সত্তর অবধি, এই সেদিনেও তো জলে নেমেছেন লক্ষ্মী নায়কন তিনি আবারও জিজ্ঞেস করেন, জবাব দিচ্ছিস না যে বড়!”

 

-“এই মানে আজ একটু তাড়াতাড়ি চলে এলাম,আমতা আমতা করে কমলা জবাব দেয়

-“তা বলে এই এত বেলার সময় একা একা বিচে বসে থাকবি? কোনও বেয়াড়া মদ্দের নজরে পড়ে গেলে কি থেকে কি হয়ে যেতে পারে কোনওদিন ভেবে দেখেছিস?

 

তা আর জানে না কমলা? কিছুদিন আগেই তো লীলার সঙ্গে যা হয়ে গেল মুখে বলতে নেই লীলা এখনও পুরোপুরি সুস্থ নয় থানা-পুলিশের ঝামেলায় যেতে চায়নি লীলার পরিবার লোকটাকেও সবাই চেনে তাই মিটমাট করে নিতে হয়েছে সামনের ফাগ-মাসেই লীলার বিয়ে হয়ে যাবে লোকটাও রাজি হয়েছে এই অনেক কমলার গা ঘিনঘিন করে লক্ষ্মীআম্মা কোমর ভেঙে কমলার পাশে উবু হয়ে বসে পড়েন কমলার মাথায় হাত রাখেন

 

-“ঘর যা বেটি আজ তোকে অনেকদূর যেতে হবে, খবর জানি সব,লক্ষ্মীআম্মা কথাটা যেন ঠিক শেষ করে উঠতে পারেন না তাঁর কি গলা ভাঙছে? কমলা চমকিয়ে উঠে চকিতে তাঁর দিকে তাকায় দুজনেরই চোখে জল টসটস করে মেয়েজন্ম কদাকার জন্ম এক!” অস্ফূটে লক্ষ্মী বলে ওঠেন কমলার মাথায় হাত রেখে বিড়বিড় করে কি যেন এক মন্ত্রোচ্চারণ করেন সূর্য ডুবে আসতে চায়

 

[***]

 

অনেক রাত গাড়িটা হেঁচকি তুলে মাঝরাস্তায় স্থির হয়ে গিয়েছে আশেপাশের মেয়েগুলো সব গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন কারোরই মুখ দেখেনি কেউ গলা অবধি কালো কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে সবাইকে ট্রাকে তোলা হয়েছে একেকজনকে বোধহয় কোনও নেশার বস্তুও খাওয়ানো হয়ে থাকবে ট্রাকে তোলবার সময়েই তারা ঝিমিয়ে ছিল কেমন কেবল সজাগ হয়ে বসেছিল কমলা ট্রাক থামতেই সে আরও আড়ষ্ট হয়ে সন্তর্পণে মাথা তুলে দেখতে চায় একেবারে গাদাগাদি না হলেও, পাশাপাশিই মেয়েরা শুয়ে আছে খুব সাবধানে উঠে পালাতে হবে

 

যদি বা পালানো যায়

 

হঠাৎই কেমন ভয় করে ওঠে কমলার গাড়ি থেমে গেছে অনেকক্ষণ এখনও কেউ আসছে না কেন? তাহলে কি শাওনও? ভিনদেশিরেফিউজি সাথে ঢলাঢলির সম্পর্ক বলে কমলাকেও কম কথা শুনতে হয়নি এত তাড়াতাড়ি মুম্বইয়ের বিষয়টা বাস্তবায়িত হওয়ার পিছনেও পরোক্ষে শাওনেরই সঙ্গে তার সম্পর্কের বিষয়টা কাজ করেছে বাপ তাকে ঝেড়ে ফেলতে চায় স্পষ্ট বোঝে কমলা কিন্তু শাওনও কি? আড়ষ্ট হয়ে কমলা অপেক্ষা করে

 

-“কমল, কমলি?

 

এসেছে খুব আলতো করে হলেও চেনা গলার স্বর ট্রাকের মুখে চাপা দিয়ে রাখা ত্রিপলটা অল্প ফাঁক হয়ে যায় শাওনের মুখ ধীরে ধীরে উঠে আসে কমলা একেকটা করে ঘুমন্ত শরীর পেরিয়ে যায় কিন্তু শেষবারেই!

 

মেয়েটা উঠে বসেছে মুখ থেকে কাপড় সরিয়ে কমলার শরীরে বিদ্যুৎ খেলে যায় সে পায়ে ধরে শাওনকে বলতে চেয়েছিল

 

রাজি হয়ে গাড়ির ড্রাইভারকেও শাওন বরাদ্দ টাকার চেয়ে আরও বেশি কিছু দিতে রাজি হয়েছিল ট্রাক থেকে অনেকটা সরে এসে, অনেকক্ষণ ধরে মেয়েটাকে, ড্রাইভারকে বুঝিয়েছিল কমলা ড্রাইভারটা পয়সা চেনে কেবল তার পকেটে কেবল মাল হাসিল হলেই হলো, তার আর কোনও আপত্তি কোথায়? কিন্তু লীলাই তো রাজি হল না স্পষ্ট করে সে শেষ উত্তরে কমলাকে বলেছিল, বাপ তো তোকে বেচেই দিয়েছে কেবল মেরে তো ফেলেনি তোর কপালে তুই শাওনের মতো হৃদয় পেয়েছিস আমি সেখানে গিয়ে কি করব? একবার যখন ওই জানোয়ারটার পা আমাকে ঠেলে দিতে পেরেছে সবাই, আমি আর বাঁচতে চাই না আমাকে জোর করিস না আর -”

 

আমি কিন্তু চিৎকার করব ঠিক!” লীলা বলেছিল

 

শাওনের সঙ্গে হাত ধরে ছুটতে ছুটতে কমলা ভাবছিল লীলা বোধহয় পাগল হয়ে গিয়েছে

 

এর আরও কয়েক মাস পর জুহু বিচের কাছে লীলারই মতো দেখতে একটি মেয়ের লাশ জোয়ারের সময় পাড়ে ভেসে এসেছিল তার দেহের কোথাও আঘাতের চিহ্ন ছিল না কেবল তার দুই পা জড়িয়ে সামুদ্রিক শ্যাওলা-আগাছাতে সবুজ হয়ে ছিল পোস্টমর্টেমের সময় ডাক্তার যা হাতের আঙুলের ডগায় তুলে নিয়ে বলেছিলেন, মাছের খাদ্য প্ল্যাঙ্কটন

  • অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়