বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের তান্ত্রিকদের বিচিত্র কাহিনী : কয়েকটি কথা

খ্যাতনামা সাহিত্যিক, অনুবাদক ও আইনজীবী সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের (৯ জানুয়ারি ১৮৮৪ – ১৯ মে ১৯৬৬) জন্ম পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগণা জেলার ব্যারাকপুর মহকুমার ইছাপুরে। পিতার নাম হরিদাস মুখোপাধ্যায়। তাঁর পিতামহ ছিলেন কৃষ্ণসখা হাইকোর্টের ব্যবহারজীবী এবং মাতামহ ছিলেন বাংলা রঙ্গমঞ্চের পুরোধাপুরুষ নট-নাট্যকার নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। বাঙালির রামায়ণকার কবি কৃত্তিবাস ওঝার উত্তরপুরুষ সৌরীন্দ্রমোহন। তিনি ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে ভবানীপুরের সাউথ সুবারবন স্কুল থেকে এন্ট্রান্স, ভাগলপুরের তেজনারায়ণ জুবিলি কলেজ থেকে ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে এফ. এ, ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে জেনারেল অ্যাসেব্লিজ ইনস্টিটিউশন থেকে বি. এ পাশ করেন। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার আইন কলেজ থেকে আইন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর কলকাতার পুলিশ কোর্টে ওকালতি শুরু করেন। তিনি পেশায় আইনজীবী হলেও নেশায় ছিলেন সাহিত্য-শিল্পকর্মী। চোদ্দ বৎসর বয়সে এন্ট্রান্সে পড়ার সময়ই তার ‘ছেলেবেলাকার কথা’ গল্পটি কমলা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৯০১ থেকে তাঁর সঙ্গে সাহিত্যজগতের ঘনিষ্ঠতা সূচিত হয়েছিল। ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে সাহিত্য প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে ‘কুন্তলীন পুরস্কার’ লাভ করেন। ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে কুন্তলীনের দ্বিতীয় এবং ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে প্রথম পুরস্কার পান। সৌরীন্দ্রমোহনের আরো অনেক গল্প কুন্তলীন পুরস্কারের সম্মানলাভ করেছিল। ১৯২৬ থেকে বসুমতীর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয়। তিনি সতীর্থ মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়, উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখের সহযোগিতায় ভবানীপুরে ‘সাহিত্য সেবক সমিতি’ প্রতিষ্ঠা করে হাতে লেখা পত্রিকা তরণী নামে সম্পাদনা করেন। এই সময়ে ছোটদের মাসিক পত্রিকা মুকুল-এ তাঁর কয়েকটি ছোটগল্প প্রকাশিত হয়। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত ভারতী পত্রিকার পরিচালনভার গ্রহণ করেন। ১৯১৫-২৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি ও মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায় ভারতী পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে মাসিক বসুমতী-র তিনি দীর্ঘকাল যুক্ত থাকে।

সৌরীন্দ্রমোহন দীর্ঘকাল ধরে ভারতী পত্রিকার পরিচালনায় সংসৃষ্ট ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের পঞ্চাশ বর্ষ জয়ন্তীর বছর থেকে ভারতী পত্রিকার পরিচালনায় সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়, অসিতকুমার হালদার, চারুচন্দ্র রায়, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় প্রভৃতি তরুণ লেখক ও শিল্পীদের প্রভাব বাড়তে থাকার তিন-চার বছরের মধ্যেই পত্রিকাটির ভার সম্পূর্ণরূপে এঁদের হাতে আসে। ‘ভারতীর বৈঠক’-এর এইভাবে সূচিত হয় (হেমেন্দ্রকুমার রায়, ‘মণিলালের আসর’)। এই বৈঠকের নায়ক মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়। ভারতীর বৈঠকের পরিসর বৃহৎ না হলেও তা কখনো সঙ্কীর্ণ গোষ্ঠীতে পরিণত হয়নি। এই বৈঠকের সকলেই রবীন্দ্র-অনুরাগী ছিলেন। সুতরাং রবীন্দ্র-নিষ্ঠা ভারতীর বৈঠকের মূল সংঘনীতি ছিল। অপর সংঘসূত্রগুলি খুব সুব্যক্ত না হলেও সহজবোধ্য বলে সুকুমার সেন উল্লেখ করেছেন। সেগুলি হল – ১) সাহিত্যদৃষ্টিতে গতানুগতিকতার ঠুলি পরিত্যাগ, ২) রচনারীতিকে সরল ও সরস করা ও কথ্যভাষার কাছাকাছি আনা, ৩) আধুনিক ইউরোপীয় সাহিত্য ও সাহিত্যচিন্তার সঙ্গে সাধারণ বাঙালি পাঠকের পরিচয় ঘটানো, ৪) সমসাময়িক সমাজের গ্লানির প্রতি, বিশেষ করে পতিত নারীর দুর্দশার প্রতি-গল্প-উপন্যাসে সমবেদনা আকর্ষণ, ৫) শিল্প অনুরাগ এবং জীবনচর্যায় শিল্পানুরাগের অভিব্যক্তি ও ৬) মোগল চিত্রকলার অনুশীলনের আনুষঙ্গিকরূপে ফারসি হস্তলিপির মতো মোলায়েম ফারসি শব্দের প্রতি ঝোঁক। ১২৯৯ সালে স্বর্ণকুমারী দেবী বিলাতি পত্রিকায় একাধিক লেখকের সমবায়ে ধারাবাহিকভাবে উপন্যাস রচনা দেখে ভারতী-তে এমনি যৌথ উপন্যাস রচনার চেষ্টা করেছিলেন। ‘নববর্ষের স্বপ্ন’ নামে এই ক্ষুদ্র ‘নূতন ধরনের উপন্যাস’ পাঁচটি পরিচ্ছেদে পাঁচ সংখ্যায় বের হয়েছিল (আশ্বিন সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত)। এই উপন্যাস লিখেছিলেন সরলা দেবী, ‘শ্রী অঃ’, দীনেন্দ্রকুমার রায়, শশিভূষণ বসু, নগেন্দ্রনাথ ঘোষ ও সরলাবালা দাসী। সুদীর্ঘকাল পরে ভারতীর সম্পাদকমণ্ডলী আবার এই ধরনের ‘বারোয়ারি উপন্যাস’ (পুস্তকাকারে প্রকাশ ১৯২১) লেখান। প্রত্যেক মাসে, এক একজনের লেখা, এক কিস্তি করিয়া বের হত। এক বছরে বইটি সম্পূর্ণ হয়। লেখক ছিলেন যথাক্রমে প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়, নরেন্দ্র দেব, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, হেমেন্দ্রকুমার রায়, সুরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত এবং প্রমথ চৌধুরী। অনেক ঔপন্যাসিক মিলে বারোয়ারি উপন্যাস লিখবার একটা চল আধুনিক কথাসাহিত্যে কিছুদিনের জন্যে প্রচলিত ছিল। নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব বসু, প্রবোধকুমার সান্যাল ও শৈলজারঞ্জন মুখোপাধ্যায় লিখিত বারোয়ারি উপন্যাস বান্ধবী (জুলাই ১৯৬২) এর উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত। ভারতী-র শেষ কয় বছর প্রথমে স্বর্ণকুমারীর সহকারীরূপে (১৯০৭–১৯১৫) ভারতী গোষ্ঠীর সঙ্গে মিলে পরিচালনা ভার নেন, পরে মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের সহযোগিরূপে (১৯১৫–১৯২৩) তিনি ভারতী যুগ্ম সম্পাদনা করেছিলেন।

গল্পলেখক হিসাবে সৌরীন্দ্রমোহনকে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের শিষ্য বলা যায়। তবে গল্পের বিষয়ে খুব বৈচিত্র্য নেই। এঁর অধিকাংশ গল্পের বিষয় হল অবিবাহিত প্রেমপ্রত্যাশা কিংবা নববিবাহিতের লাজুক প্রেমপিপাসা। করুণ রস জমাবার দিকেও বিশেষ লক্ষ্য দেখা যায় যা তখনকার দিনের কোনো কোনো গল্প-লেখকের একটা বিশেষ প্রবণতা ছিল। তাঁর রচনারীতি সাদাসিধা ও সরস, সংহত ও পরিমিত, বুদ্ধিবিদ্যা-প্রকাশের আগ্রহ তাতে অনুপস্থিত। তাঁর উপন্যাসের ভাষা প্রসাদগুণসম্পন্ন এবং ভাবাতিশয্যবর্জিত। কোন কোনটি কথ্যভাষায় লেখা। অনেক গল্পের প্লটই বিদেশি মূল থেকে অল্পবিস্তর নেওয়া। তিনি শতাধিক গ্রন্থের রচয়িতা। সৌরীন্দ্রমোহন প্রকৃত অর্থে সব্যসাচী লেখক ছিলেন। গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, চলচ্চিত্র কাহিনি, বেতার নাট্য, জীবনী, অনুবাদ-সাহিত্য, রম্যরচনা, ব্যঙ্গকৌতুক, ভ্রমণকাহিনি, প্রবন্ধ, পরলোকতত্ত্ব প্রভৃতি সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তাঁর অবাধ বিচরণ ছিল। তাঁর গানের উৎস ছিল কলকাতা বেতার কেন্দ্র ও গ্রামোফোন কোম্পানি। তাঁর সবকটি জনপ্রিয় গান এই দুই প্রকার মাধ্যমেই বিকশিত হয়েছিল। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে মুক্তিপ্রাপ্ত দেবকী বসু পরিচালিত নিউ থিয়েটার্সের সঙ্গীতবহুল চলচ্চিত্র চণ্ডীদাস চলচ্চিত্রের ‘ফিরে চলো আপন ঘরে’ – তিনি এই জনপ্রিয় গানটির গীতিকার ছিলেন। তিনি অনর্গল রায়, অপ্রকাশ গুপ্ত, বৈকুন্ঠ শর্মা, সত্যব্রত শর্মা প্রভৃতি ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন।

সৌরীন্দ্রমোহনের কিশোরপাঠ্য মৌলিক উপন্যাসের মধ্যেও কখনো বিদেশি ছায়া অলক্ষ্য নয়। তাঁর রচিত কিশোর সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য অবদানগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হল – বর্ম্মায় যখন বোমা পড়ে (শ্রাবণ ১৩৫২), নিঝুম পুরী (ছেলেমেয়েদের উপন্যাস, আশ্বিন ১৩৪১), অনেক দূরে (ছেলেমেয়েদের উপন্যাস, বৈশাখ ১৩৪৭), তিন চোর (ছোটদের গল্প, শ্রাবণ ১৩৪৭), ইতিহাসে নেই (ছেলেমেয়েদের গল্প, বৈশাখ ১৩৪৮), সর্গের সিঁড়ি (মাঘ ১৩৪৯), রাজ্যের রূপকথা (বলকান্‌ দেশের রূপকথা, প্রথম খণ্ড, আষাঢ় ১৩৬১), পূজার দিনের উপহার (প্রকাশকালহীন), চির নতুন গল্প (শ্রাবণ ১৩৬৬), ভারতের রূপকথা (জ্যৈষ্ঠ ১৩৬৭)। এছাড়াও অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে লাল কুঠি (সচিত্র উপন্যাস), মা-কালীর খাঁড়া (উপন্যাস), তারার মালা, ফুলের পাখা, সাঁঝের বাতি, ময়ুরপুচ্ছ, বনের পাখী, পাঠান মুলুকে, চালিয়াৎ চন্দর প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। তাঁর গল্পগ্রন্থগুলির মধ্যে নির্ঝর (ভাদ্র ১৩১৮), পুষ্পক (১৩২০), পিয়াসী (আষাঢ় ১৩২৯), মৃণাল (অগ্রহায়ণ ১৩২৯), মণিদীপ (শ্রাবণ ১৩), খাট্টা ও খোট্টা এবং আরো গল্প (আষাঢ় ১৩৩৯), সচকিতা গৃহিণী এবং আরো গল্প (১৯৩২), কঙ্কণা (ফাল্গুন ১৩৪০), সুপর্ণা (প্রকাশকালহীন), পুনশ্চ (পৌষ ১৩৪১), অবন্ধনা ও লালু (ম্যাক্সিম গোর্কি রচিত মালভাও বেড় গল্পের মর্মানুবাদ, পৌষ ১৩৫৭), তরুণী,  পুষ্পক, বৈকালী, চাঁদমালা, রঙের টেক্কা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। পরদেশী (১৩১৭) বিদেশি গল্পের অনুবাদ।

সৌরীন্দ্রমোহন বহু উপন্যাস রচনা করলেও সেগুলির অধিকাংশই অনুবাদ, আক্ষরিক অথবা ভাবাশ্রিত। তাঁর রচিত মৌলিক উপন্যাসের মধ্যে এইগুলি উল্লেখযোগ্য – আঁধি (বৈশাখ ১৩২৯), কাজরী (প্রথম প্রকাশ ভারতী ১৩২৬ সাল), আঁধি (প্রথম প্রকাশ ভারতী, ১৩২৮-২৯ সাল), বাবলা (প্রথম প্রকাশ ভারতী,  ১৩৩০-৩১ সাল)। তাঁর অন্যান্য উপন্যাসগুলি হল – বন্দী (ভিক্টর উগো অনুপ্রাণিত পৌষ ১৩১৯), শেফালি (ফাল্গুন ১৩১৯), মাতৃঋণ (আলফন্স্‌ দোদে রচিত জ্যাক উপন্যাসের অনুবাদ, আষাঢ় ১৩২২), দরদী (পৌষ ১৩২৬), নবাব (দোদে অনুপ্রাণিত, ১৩২৮), সোনার কাঠি (ফাল্গুন ১৩২৯), নেপথ্যে (ফাল্গুন ১৩২৯), সোনার কাঠি (ফাল্গুন ১৩২৯), প্রেয়সী (অগ্রহায়ণ ১৩৩০), কালোর আলো (পৌষ ১৩৩০), মুক্ত পাখী (চৈত্র ১৩৩১), যৌবরাজ্য (চৈত্র ১৩৩৫), শাস্তি (ভাদ্র ১৩৩৭), লজ্জাবতী (আশ্বিন ১৩৩৭), রাঙ্গামাটীর পথ (আষাঢ় ১৩৪৭), ছিন্নমস্তার মন্দির (আষাঢ় ১৩৪৮), আরাম-বাগ (ডিটেক্টিভ উপন্যাস, শ্রাবণ ১৩৪৮), উপকণ্ঠ (শ্রাবণ ১৩৪৯), নব নায়িকা (বৈশাখ ১৩৫০), অস্বীকার (আশ্বিন ১৩৫০), ভবিষ্যৎ (জানুয়ারি ১৯৪৫), মরু-মায়া (১৩৫২), জলটুঙ্গি (জ্যৈষ্ঠ ১৩৫৫), মুশকিল আসান (বৈশাখ ১৩৬০), মনের মিল (প্রকাশকাল নেই), বিনোদ হালদার (প্রকাশকাল নেই), রূপছায়া (প্রকাশকাল নেই), করুণা (প্রকাশকাল নেই), দুঃখের বরষায় (প্রকাশকাল নেই), পিয়ারী, কুজ্ঝটিকা, নিরুদ্দেশের যাত্রী, স্ত্রীবুদ্ধি, অসাধারণ (তুর্গেনিভ অনুপ্রাণিত), জনৈকা (মোপাসাঁ অনুপ্রাণিত), লাল ফুল, নেপথ্যে, ছোট পাতা, পথের পথিক, গরীবের ছেলে, অকলঙ্ক চাঁদ প্রভৃতি উপনাস একসময়ে পাঠকমহলে জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। সৌরীন্দ্রমোহন সম্পাদিত রহস্য উপন্যাস অমলার অদৃষ্ট (ডিসেম্বর ১৯৪০) তাঁর সম্পাদনাকর্মের উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত। তাঁর রচিত নভেলেটগুলির মধ্যে সহযাত্রিনী, প্রায়শ্চিত্ত, বোমায় বেকুবি, দেশের জন্য, লক্ষ্মীলাভ, বৃষ্টি প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

নাটক গল্প লিখতে আরম্ভ করবার অল্প কিছুকাল পরেই সৌরীন্দ্রমোহন ব্যঙ্গ ও কৌতুকনাট্য রচনায় মন দিয়েছিলেন। এগুলির কাহিনি স্বরচিত নয়, বিদেশি নাট্য অথবা দেশি গল্প অবলম্বনে লেখা। নাট্যরচনাগুলিতে যেসব গান আছে সেগুলি সুরচিত। সংলাপও উজ্জ্বল। কলিকাতার সাধারণ রঙ্গমঞ্চে এগুলির অভিনয় ব্যর্থ হয়নি। সাবিত্রীকাহিনি নিয়ে লেখা স্বয়ংবরা (১০ জ্যৈষ্ঠ ১৩৩৮/ ১৯৩১) স্টার থিয়েটারে প্রথম অভিনয় ২ জ্যৈষ্ঠ ১৩৩৮, গোল্ডস্মিথের নাটক অবলম্বনে লেখা দরিয়া (বৈশাখ ১৩১৯/ ১৯১২) মিনার্ভা থিয়েটারে প্রথম অভিনয় ২৪ চৈত্র ১৩৩৮, মলিয়েরের নাটক অবলম্বনে লেখা যৎকিঞ্চিৎ (১৮ আষাঢ় ১৩১৫/ ১৯০৮) ষ্টার থিয়েটারে প্রথম অভিনয় ৬ আষাঢ় ১৩১৫, দশচক্র (কৌতুক-নাট্য বা প্রহসন, ২২ ফাল্গুন ১৩১৬/ ১৯১০) ষ্টার থিয়েটারে অভিনয় ১৪ ফাল্গুন ১৩১৬), পঞ্চশর (১৯২০) ষ্টারে থিয়েটারে প্রথম অভিনয় ১ মাঘ ১৩২৬, রুমেলা (প্রহসন, কার্তিক ১৩২১/ ১৯১৪) মিনার্ভা থিয়েটারে প্রথম অভিনয় ৭ কার্তিক ১৩২১, হাতের পাঁচ  (কৌতুকনাট্য বা প্রহসন, পৌষ ১৩২২/ ১৯১৫) মিনার্ভা থিয়েটারে প্রথম অভিনয় ১৬ পৌষ ১৩২২, শেষ-বেশ (কৌতুকনাট্য বা প্রহসন, পৌষ ১৩২৪/ ১৯১৭) ষ্টারে থিয়েটারে অভিনয় ৭ আশ্বিন ১৩২৪, গ্রহের ফের (১৯১১) প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘বলবান্ জামাতা’ গল্প অবলম্বনে লেখা হারানো রতন (১৯২৯), প্রহসন লাখ টাকা (১৯২৬), 'মৃত্যু-মোচন' ও রূপসী যথাক্রমে টলস্টয় ও মেটারলিঙ্কের নাটক-কাহিনী অবলম্বনে লেখা। তাঁর নাটিকাগুলির মধ্যে দু’দিক, মুক্তর মালা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। শেক্সপিয়ারের গ্রন্থাবলি ছাড়াও তিনি বিদেশি বই অনুবাদ করেছেন।

সৌরীন্দ্রমোহনের নক্সা লেখাগুলি বহুক্ষেত্রেই প্রবন্ধধর্মী হয়ে পড়েছে। ‘জাতীয় নাটকের প্লট’, ‘নয়া যুগের নাট্য-ঠাট’, ‘আধুনিক সামাজিক সমস্যা ও সমাধান’, ‘লেখার নমুনা’, ‘গবেষণা’, ‘বায়োস্কোপের শিনারিও’, ‘গার্হস্থ্য উপন্যাসের আদ্রা’, ‘যমের অরুচি’, ‘নীলামী ইস্তাহার’ প্রভৃতি রচনা প্রবন্ধগন্ধী নক্সার দৃষ্টান্ত। তাঁর স্মৃতিকথাধর্মী রচনাগুলির হল – রবীন্দ্রস্মৃতি (পৌষ ১৩৬৪), জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি (১৩৬৪), উকিলের ডায়েরি, পরলোকের বিচিত্র কাহিনী (১৩৪৯), তান্ত্রিকদের বিচিত্র কাহিনী (১৩৫৪) । তাঁর ভ্রমণকাহিনি ‘ভ্রমণ মোটরে কাশ্মীর-যাত্রা’ ও কবিতা সংকলন রৌদ্রে-মেঘে, ফুল ও কাঁটা, কবিতা ও গান। গ্রামোফোন রেকর্ডে তার রচিত গান ‘ও কেন গেল চলে’, ‘জীবনে জেগেছিল মধুমাস’ প্রভৃতি সেই সময় খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। তিনি কলকাতা বেতার কেন্দ্রের সূচনাকাল থেকে আমৃত্যু তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। রবীন্দ্র সংগীতের প্রথিতযশা ও স্বনামধন্য কণ্ঠশিল্পী সুচিত্রা মিত্র (১৯২৪–২০১১) তার কন্যা।

 

(চলবে)

  • সুমিত বড়ুয়া