রবীন্দ্র অনুভবের এক আশ্চর্য পরশ একালের অন্যতম সেরা কবির কলমে। এই কলমের জাদু আমাদের পড়শি করে দেয় রবীন্দ্রনাথের।বিশ্বমানব হতে আমরা ভেসে যেতে থাকি বিশ্বকবির রচনায়--
কবি ই যখন অন্বেষণ করেন কালতীর্ণ কবি রবীন্দ্রনাথকে, তখন আমাদের প্রাপ্তির প্রত্যাশা হয়ে ওঠে গগণচুম্বী ।' আবার রবীন্দ্রনাথ' নামক ছোট একটি গ্রন্থে একালের অন্যতম সেরা কবি জয় গোস্বামী যখন তাঁর রবীন্দ্র অনুভবের কথা লেখেন ,সেই লেখা পড়ার মুগ্ধতা, বইটি শেষ হয়ে যাওয়া পরেও অম্লান থাকে।
জয়ের কবিতার মতই স্বাদু হলো তাঁর গদ্য। তাঁর গদ্যের অনুভব এবং অনুভূতি পাঠক চিত্ত কে নিয়ে যায় এক অনির্বচনীয় লোকে। পাঠক জয়ের অনুভূতির সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতার সেতুবন্ধন করে কেবল যে মানসিক তৃপ্তি পায় তেমনটা নয়।মানসিক তৃপ্তিকে অতিক্রম করে সে আগামীর একটা দিশা খুঁজে পায়। এখানেই যেন জয়ের গদ্যের সার্থকতা।
আলোচ্য গ্রন্থের ,'প্রথম দিনের সূর্য' এই ছোট প্রবন্ধটিতে একেবারে শুরুতেই রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়বার আগ্রহ নিয়ে যে অমঘ সত্য জয় উচ্চারণ করছেন, তা প্রায় চিরকালীন সত্য --এটা জোর দিয়ে বলতে পারা যায়।
জয় লিখছেন ; "এ কথা সত্য বলে অনুভব করেছি অনেক কবিতাচর্চাকারীদের সঙ্গে মিলেমিশে, কথা বলে, যে গত তিপ্পান্ন বছর ধরে যাঁরা কবিতা লিখতে এসেছেন, তাঁদের মধ্যে বড়জোর তিন - চার শতাংশের মনে রবীন্দ্রনাথের কবিতা কে ধারাবাহিকভাবে পরবার কোনো আগ্রহ জন্মেছিল( পৃ-১৩)।"
এই যে অমঘ সত্যটি জয় উচ্চারণ করেছেন ,তার জন্য হয়তো তিনি অনেকেরই বিরাগ ভাজন হবেন। তবু সত্য তো সত্যই। কারোর রাগ অনুরাগের উপরে সত্যের চিরকালীনতা কখনো নির্ভর করে না। রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করে যাঁরা একটা সময় কবিতার জগতে অবগাহন করতে চেয়েছিলেন ,তাঁদের প্রায় প্রত্যেককেই, জীবনের মধ্য গগনে এসে ,রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধায় ,ভালবাসায় আপ্লুত হয়ে উঠতে হয়েছে।
এই আপ্লুত হয়ে ওঠার মধ্যে কোনো তথাকথিত ভক্তিবাদ কখনো ক্রিয়াশীল থাকেনি ।থেকেছে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির প্রতি এক অনাবিল ভালোবাসা ।সৃষ্টির ধ্রুব শক্তি, যা রবীন্দ্রনাথ তাঁর গোটা জীবনের সমস্ত কর্মকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে দেখিয়েছেন ,সেই শক্তি যে কখনো প্রত্যক্ষভাবে ,কখনো পরোক্ষভাবে পরের প্রজন্মকে আপ্লুত করেছে, প্রাণিত করেছে ,এগিয়ে নিয়ে চলার শক্তি যুগিয়েছে-- সে কথা কেউ কখনো অস্বীকার করতে পারেন না।
জয়ের এই ছোট ছোট প্রবন্ধের মালায় গাঁথা রবীন্দ্র মালা যেখানে তিনি লিখছেন; " রবীন্দ্রনাথের কবিতা একেবারে না পড়লেও কোনো কবিতালেখকের পক্ষে চমৎকার লিপিকুশলতা দ্বারা মুদ্রণযোগ্য নির্ভুল কবিতারচনা ও কাব্যপুস্তক ছাপিয়ে খ্যাতিলাভ-- মোটেই অসম্ভব নয় ।"-- এই আঙ্গিকে তিনি আজকের বাংলা কবিতার ঐতিহ্যের সামর্থের যে গুনগান গাইছেন, জয়গান গাইছেন-- সেটিও যুক্তি এবং বাস্তবতা নিরিখে অমঘ সত্য।
'সোনার তরী ' কাব্যগ্রন্থ ঘিরে সমসাময়িক কালে রবীন্দ্রনাথকে যে দুর্বোধ্যতার অপবাদে আক্রান্ত হতে হয়েছিল, সেই পর্যায় টিকে ঘিরে কবি এখানে যেভাবে প্রায় অধুনা বিস্মিত ,'জ্যোতির্ময় রবি ও কালো মেঘের দল' শীর্ষক নিবন্ধটির কথা আলোচনা করেছেন। এটি নতুন প্রজন্মের পাঠকদের কাছে যেমন একটা নতুন আবিষ্কার, ঠিক তেমনি ই রবীন্দ্রচর্চার ক্ষেত্রে' দেশ 'পত্রিকা ধারাবাহিকভাবে কি ঐতিহাসিক অবদান রেখে এসেছে, সে সম্পর্কেও একটি অসাধারণ মূল্যায়ন ।
সংশ্লিষ্ট নিবন্ধটি যেভাবে জয় তুলে এনেছেন, বহু প্রবীণ পাঠকের স্মৃতিকে তা নতুন করে উসকে দেবে নিজেদের যৌবনকাল ঘিরে। জয়ের সুজিত কুমার সেনগুপ্তের লেখা সেই নিবন্ধটির উল্লেখ আমাদের কাছে মনে হয়, আবার যদি সেই প্রবন্ধটি নতুন প্রজন্মের পাঠক পড়তে পারতো, তাহলে হয়তো রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে কি ধরনের নিষ্ঠুরতা একাংশের মানুষ দেখিয়েছিল ,সম্পর্কে একটা সম্যক ধারণা করতে পারতো।
অনেককাল আগে রবীন্দ্র বিদূষণ ঘিরে একটা সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত তৈরি করেছিলেন আদিত্য ওয়াদেদার ।সেই গ্রন্থে সুজিত বাবুর উল্লিখিত প্রবন্ধটি কিছু কিছু উদ্ধৃত করা হয়েছিল। কিন্তু জয়ের এই নিবন্ধ গ্রন্থটি পড়তে গিয়ে বারবার মনে হচ্ছে, যদি এখনকার পাঠক, বিশেষ করে নবীন প্রজন্মের পাঠক, তাঁরা আবার সুজিত বাবুর সেই প্রবন্ধটি পড়তে পারতেন, তাহলে বুঝতেন কি মানসিক যন্ত্রণা রবীন্দ্রনাথকে গোটা জীবন ধরে বয়ে বেড়াতে হয়েছিল মানুষেরই কাছ থেকে।
রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির গহীনে ডুব দেয়ার ক্ষমতা সমকালে কতজনের হয়েছিল ,আজকেই বা কতজনের আছে সেই জায়গাটা বুঝতে পারা যায় যখন জয় লিখছেন;
" কিন্তু আমি প্রথম ওই ধারাবাহিক রচনাটির মাধ্যমেই জেনেছিলাম 'সোনার তরী' বিষয়ে কতখানি দলবদ্ধ ভাবে আক্রমণ ঘটেছিল রবীন্দ্রনাথের উপর।" ( পৃ-১৪)
এমনকি রেডিওর রম্যগীতিতে পর্যন্ত কিভাবে রবীন্দ্রনাথকে আক্রমণ করা হয়েছিল ,তার একটি উদাহরণ জয় উপস্থাপিত করেছেন। জয় লিখছেন ;
" এরকম গান তখন লেখা হয়েছিল : আমি লিখছি যেসব কাব্য মানবজাতির জন্যে/ নিজেই বুঝিনা তারই মানে বুঝবে কিতা অন্যে..." ( পৃ-ঐ)।
রবীন্দ্রনাথকে উপহাসের মাধ্যম হিসেবে যেভাবে রেডিওতে রম্য গীতি আসরকে ব্যবহার করা হয়েছিল এই তথ্যটি উপস্থাপিত করে রবীন্দ্রবিদূষণের ক্ষেত্রে ষড়যন্ত্রের জাল যে কতটা বিস্তৃত ছিল, তার একটা করুণ উপস্থাপনা ঘটিয়েছেন কবি জয় গোস্বামী। ভাবতে অবাক লাগে যে কালে এই রম্য গীতির আসর রেডিওতে খুব জনপ্রিয় ছিল, সে কালটি ছিল কিন্তু বেতারের স্বর্ণযুগ। আর সেই স্বর্ণযুগের বেতারের সবকিছু পরিচালনার ক্ষেত্রে সরকারি বিধি নিষেধের, নিয়ম কানুনের একটা প্রাবল্য ছিল।
পন্ডিত জওহরলাল নেহরু। কেরালায় ই এম এস নাম্বুদ্রিপাদের সরকারের পতন ঘটবার অববাহিত পরে কলকাতায় এসেছেন। রেডিওতে লাইভ ব্রডকাস্টিং এ সুচিত্রা মিত্র গেয়েছেন বাল্মিকী প্রতিভার অংশ সরকার ধরে নিল ,সেটা নেহরুকে উপহাস করে গাওয়া হয়েছে। বেতারে নিষিদ্ধ করা হলো সুচিত্রাকে।
এই রকম কাণ্ড যদি ঘটতে থাকতে পারে ,তবে রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে ওই ধরনের উপহাসে রেডিওর কর্তারা কি করছিলেন? জয়ের নিবন্ধ থেকে এই প্রশ্নটাই আমাদের সামনে খুব বড় হয়ে দেখা দেয়।
আসলে চলতি বাঙালি প্রবাদ ,'বজ্র আঁটুনি ফসকা গেড়ো', সেটি যেন চোখে আঙুল দিয়ে কবি জয় গোস্বামী আমাদের দেখিয়ে দিলেন।
কিশোর কবি রবীন্দ্রনাথ ,ভানুসিংহের পদাবলীতে কিভাবে নতুন ভাষার উদ্ভাবন ঘটালেন বাংলায় ,তার বর্ণনার ভেতর দিয়ে উচ্ছ্বসিত জয় যখন পৌঁছে যাচ্ছেন , সেই কবির হাত থেকেই পাওয়া গীতাঞ্জলিতে ,আর সেই কাব্যের বিশ্বজয়ের প্রসঙ্গের অবতারণা করছেন ,তার জন্য এক আশ্চর্য ভালোলাগা অনুভূতি পাঠকদেরও পৌঁছে দিচ্ছে অনিন্দ্যলোকে।
ভানুসিংহের পদাবলী লেখবার কাল থেকে গীতাঞ্জলির কাল হয়ে আজ এই একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকের প্রায় মধ্যবর্তী সময়ে এসে, যখন এ যুগের অন্যতম সেরা এক কবি র লেখনীতে উঠে আসে ,সেই অনুরণনের কথা, যেখানে রবীন্দ্রনাথের শারীরিক অনুপস্থিতির পর দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাংলা অনুবাদে ,বিদেশী কবিতার সেই নামকরণ ,'রবীন্দ্রনাথের চিতাভস্ম'-- এসব অনুভূতি আজকের এই ত্রস্ত সময় আর ধ্বস্ত সংস্কৃতির যুগে, পাঠকের কাছে ,বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের পাঠকের কাছে একটা অন্য ধরনের অনুভূতি নিয়ে আসে। এ অনুভূতির যেন কোনো আলাদা স্বাদ হয় না ।
সেই স্বাদ কে ভাগ করে নিচ্ছেন জয় রবীন্দ্রনাথের' বলাকা'র সেই আশ্চর্য পঙতি দিয়ে ;" মেলিতেছে অঙ্কুরের পাখা /লক্ষ লক্ষ বীজের বলাকা" ।
কবিতার নতুনত্ব রবীন্দ্রনাথের হাতে কিভাবে অঙ্কুরিত হচ্ছে, তার এক মনোরম সংক্ষিপ্ত আলোচনা জয় এখানে করেছেন। 'কথা ও কাহিনী' কাব্যগ্রন্থের কাহিনী মূলক কাব্যের নিদর্শন থেকে রবীন্দ্র কাব্যের যে বিবর্তনের ধারা, অত্যন্ত সুখ পাঠ্য শব্দাবলীর মধ্যে দিয়ে জয় আলোচনা করেছেন ,তা সাধারণ পাঠকদের কাছে একটা বিশেষ রকমের মনোনিবেশের দাবি রাখে।
যাঁরা রবীন্দ্রনাথকে অনুভব করতে চান হৃদয় দিয়ে, তাঁদের কাছে জয়ের এই পাঠ ব্যাখ্যা এবং অনুভব, অনুভূতির অনুরণন নিঃসন্দেহে একটা নতুন ধরনের তৃপ্তি যোগান দেবে। রবীন্দ্রনাথ যখন' লিপিকা' লিখছেন ,সেই সময়ে তাঁর কাব্য চেতনার যে বিবর্তনের ধারা, তা আরো একটা বাঁক নিচ্ছে' পূরবী'তে এসে। সেই বাঁকের জায়গাটা জয় অত্যন্ত সূক্ষ্ম পরতের ভেতর দিয়ে পাঠকদের সামনে তুলে ধরেছেন।
' লিপিকা'কে কাব্যগ্রন্থ বলে স্বীকার করতে কিছু মানুষের আপত্তি আর মৈত্রেয়ী দেবীকে বলা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের কথা ,'লিপিকা গদ্যকবিতাই '--এর মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্রনাথের নিজের লেখা সম্বন্ধে নিজের বক্তব্য এবং সমসাময়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে কিভাবে উপস্থাপিত হচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ , তা অনিন্দ্য সুন্দর ভাবনার মধ্যে দিয়ে জয় উপস্থাপিত করেছেন।
১৯৩২ থেকে ১৯৩৬-- এই কাল পর্বে রবীন্দ্রনাথের লেখার, বিশেষ করে কবিতার ক্ষেত্রে যে বিবর্তন, গদ্য কবিতায় নিজেকে রূপান্তরিত করবার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা, সেগুলির উল্লেখের মধ্যে দিয়ে জয় দেখিয়েছেন ;আজকের দিনে অরুন মিত্র ,সুভাষ মুখোপাধ্যায়, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, উৎপল কুমার বসু ,তারাপদ রায় , শক্তি থেকে ভাস্কর চক্রবর্তী পরিক্রমা।
এই সময়কালে গদ্য কবিতা লেখার যে সাধারণ স্বাভাবিক পরিক্রমা ,সেটি কিন্তু তিনের দশকের একদম গোড়ার দিকে, যখন রবীন্দ্রনাথ গদ্য কবিতা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন, তখন ব্যাপারটা আদৌ কোনো সাধারণ, স্বাভাবিক বা সহজ বিষয় ছিল না। সহজ পথকে নির্মাণের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের যে পথিকৃৎ এর ভূমিকা, সেটিও এখানে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে জয় উল্লেখ করেছেন।
তবে একটা কথা বলতেই হয় গদ্য কবিতাদের রচয়িতার ক্ষেত্রে অরুন মিত্র থেকে ভাস্কর চক্রবর্তী এতজনের নাম উল্লেখের মধ্যে একটি বারের জন্যও কিন্তু জয় উল্লেখ করলেন না শামসুর রাহমান, বেলাল চৌধুরী, মহাদেব সাহা থেকে শুরু করে হেলাল হাফিজের নাম ।বাংলা কবিতা কিন্তু বাংলা ভাষার মানুষদের জন্য।
রবীন্দ্রনাথ যেমন সর্বত্রব্যাপী, কোনো সীমান্তের কাঁটাতারের মধ্যে তাঁকে আবদ্ধ করে রাখতে পারা যায় না, ঠিক সেই রকমই বাংলা কবিতা কিন্তু কেবলমাত্র পশ্চিমবঙ্গবাসী বাঙালিদের নয়, সার্বিকভাবে বাংলাভাষী মানুষদের। সেখানে অবশ্যই আলোচিত হওয়া দরকার শামসুর রাহমান প্রমুখের নাম।
আবার রবীন্দ্রনাথ
জয় গোস্বামী
ব্ল্যাকলেটার্স
২০০ টাকা