জীবন সফরের ইতিবৃত্তান্ত

'সফর' এর বাছাই আমাদের পৌছে দেয় মন সফরের এক ঝরোখা দর্শনে।সেই দেখার চোখ দিয়ে আমরা নিয়ে আসি মনের শান্তি।প্রাণের আরাম--
 
'সফর  'পত্রিকাটি বাংলা সাময়িক পত্রের ইতিহাসে ইতিমধ্যেই আপন বৈশিষ্ট্যে নিজের ঠাঁই করে নিয়েছে। এই সময়কালে দেশে-বিদেশে ভ্রমণ পিপাসু বাঙালিদের কাছে' সফর 'পত্রিকাটি বিশেষ রকমের আদরণীয় একটি কাগজ। ঘর হতে দু পা মেলে একটি ধানের শীষের উপর একটি শিশির বিন্দু দেখবার প্রত্যাশাকে এই কাগজটি যেন দিনের পর দিন বাড়িয়ে দিচ্ছে।
               ' সফর' পত্রিকার যাবতীয় কর্মকাণ্ডের প্রাণ ছিলেন সদ্য প্রয়াতা মৌ রায়চৌধুরী ।তাঁর চিন্তা ভাবনা এই পত্রিকাটিকে বাংলা সাময়িক পত্রের ইতিহাসে একটা অক্ষয় বটের মত স্থান করে দিয়ে গেছে। মৌ রায়চৌধুরীর প্রধান উপদেশনায় পল্লব বসু মল্লিকের সম্পাদনায় এই' সফর'  পত্রিকার বেশ কিছু বাছাই প্রবন্ধ নিয়ে' সেরা সফর ' গ্রন্থটি ।
সেখান থেকেই যথার্থ নির্যাস চয়ন করে এই যে সংকলনটি তৈরি হয়েছে তা যেমন ভ্রমণপিপাসুদের পিপাসা নিবারণ করবে,  আবার তেমন ই  বহু পাঠককে মানস  ভ্রমণের মধ্যে দিয়ে একটা অন্য ধরনের উপলব্ধিতে পৌঁছে দেবে। 
সত্যম রায়চৌধুরীর ,' শীতের বিকেলে ডাক দিল বনলতা সেন 'এমন এক নস্টালজিয়া মেশানো লেখা যা একবার পড়লে  যেন তৃপ্তি হয় না ।বারবার ইচ্ছে করে বনলতা সেনের সেই  স্বপ্ন বাস্তবের দুনিয়াতে ভেসে বেড়াতে। সত্যম বাবু গণদেবতার আশীর্বাদ কে, দেবতার মাহাত্ম্যের ভিতর দিয়ে যেভাবে উপস্থাপিত করেছেন, আর  তার ই মধ্যে দিয়ে যেভাবে আবাহমান বাংলাকে তুলে এনেছেন, তা একটা দুটো শব্দ দিয়ে প্রশংসা করলে বোধহয় সবটা বলা হয় না। 
বাংলা বা বাঙালি মানে যে শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়। বাংলা বা বাঙালিকে কখনো যে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে আটকে রাখা যায় না-- এই চেতনার ভেতর দিয়েই সত্যমবাবুর এই নিবন্ধটি নাটোর রাজবাড়ি থেকে দিঘাপতিয়ার  জমিদার বাড়ি --সব যেন মিলেমিশে  এমন একটা জায়গা তৈরি করে দিয়েছে ,যেখানে বারবার আমাদের বলতে হয়;  কবি অমিয় চক্রবর্তীর 'সঙ্গতি'  কবিতার সেই লাইনটি ;' মেলাবেন তিনি মেলাবেন। ঝড়ো হাওয়া আর পড়ো বাড়িটার  ভাঙা দরজাটা মেলাবেন। " 
প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী শুভাপ্রসন্ন যখন কলম ধরেন তখন তাঁর কলম হয়ে ওঠে তাঁর তুলির মতনই অনিন্দ্য কান্তি ।পারিপার্শ্বিক ভারতকে তিনি যেভাবে এক অসামান্য মুগ্ধতা এনে উপস্থাপিত করেছেন ,সেই মুগ্ধতার ভেতর থেকে উঠে আসে হরপ্পা, মহেঞ্জোদারো থেকে শুরু করে জিন্না ।তার সঙ্গে যেন মিলে যায় অমৃতসর ,লাহোর ,পাঞ্জাব, দিল্লি ,বেনারস-- আর সেই সরলরেখায় সে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় আমাদের প্রাণের শহর কলকাতায়  উচ্চবিত্ত এলিট মানুষদের পাশাপাশি সেখানে স্ব মহিমায় বিরাজ করে খেটে খাওয়া মানুষ।
 অরূপ গঙ্গোপাধ্যায় প্যারিসের স্বপ্নের ডানা যেন আমাদের সত্যিই ডানা মেলে পৌঁছে দেয় ফরাসি দেশের এক আশ্চর্যজনক পটভূমিকায়  আমরা যেন ভাসতে থাকি সেইন নদীর জলে ।সেইন নদীতে ভাসতে ভাসতে আমরা কখন যেন পৌঁছে যায় ইফেল টাওয়ারের পদপ্রান্তে ।আমরা কখন পৌঁছে যাই মোনালিসা থেকে বাস্তিল দুর্গে।সেই সব ইতিহাসের স্বপ্ন মাখা হাওয়া পাখি হয়ে আমরা ঘুরে বেড়াই মনোলোকে।
 পার্থ প্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন যীশু খ্রিস্টের দেশের কথা ।এদেশের কথা আমাদের নতুন করে নিয়ে চলে যায় ইতিহাসের এক আদিপর্বে। নিজেদের ভাবনা বিকাশের স্তর কে নতুন ভাবে জানবার সুযোগ পাই দীর্ঘ এই নিবন্ধটির মধ্যে দিয়ে ।
ইতিহাস- সংস্কৃতি এবং সামাজিকতা কোথায় মিলেমিশে যেন একাকার হয়ে যায় শুভঙ্কর দের ফ্রাঙ্কফুট বুক ফেয়ারে যাওয়ার প্রথম অভিজ্ঞতার কথাতে।তাঁর লেখা  এত সুন্দর আর মজাদার যা বারবার পড়তে ইচ্ছে করে। শুভঙ্করের নিজেকে' গরু 'মনে করবার সেই অদ্ভুত উপমা, মনে করিয়ে দেয় তাঁর লেখনি যেন ঠিক নবনীতা দেবসেনের মতই ভীষণ ভীষণ ভালো লাগা একটা অনুভূতি। সেই অনুভৃতিতে ভাসতে ভাসতে আমরা নিজেরাও তাঁর প্রথম বিদেশ যাত্রার অভিজ্ঞতার অংশীদার হয়ে মানস  ভ্রমণে ঘুরে আসি ফ্রাঙ্কফুট বই মেলাতে। আমাদের বিশ্বাস শুভঙ্কর পরবর্তীকালে তাঁর এই ধরনের অভিজ্ঞতা আরও আমাদের পড়বার সুযোগ করে দেবেন। 
শ্যামলী আচার্য একজন খ্যাতিমান গল্পকার। তাঁর ম্যাক্লাক্সিগঞ্জের স্মৃতি যেন আমাদের উসকে দেয় বুদ্ধদেব গুহকেই। বুদ্ধদেব গুহা আর ম্যাকলাক্সিগঞ্জ যে একে অপরের পরিপূরক --শ্যামলী লেখার মধ্যে দিয়ে বারবার তা আমাদের মনকে প্লাবিত করে। কিন্তু সেই প্লাবন কখনোই আমাদের কোনো ভয়ংকর অভিজ্ঞতার সামনে এনে দাঁড় করায় না ।কারণ প্লাবন মানে তো এক ধরনের ধ্বংস-- শ্যামলী এখানে আমাদের প্লাবিত করেছেন স্নিগ্ধতার আবরণে ।সিই স্নিগ্ধতায় আমরা খুঁজে পাই তাঁর নিজের স্মৃতির মধ্যে দিয়ে তাঁর নিজের দেখার অনির্বচনীয় চোখের ভিতর দিয়ে, বুদ্ধদেব গুহ আর তাঁর স্বপ্ন কে।এটা ভারী সুন্দরভাবে উপস্থাপিত করেছেন শ্যামলী।বাঙালি পাঠকের তাঁর কাছে কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।
 শিমুলতলা একটা সময় বাঙালির কাছে নিত্য বেড়াতে যাওয়ার একটা জায়গা ছিল  সেই জায়গা কে যেন আবার নতুন করে আমরা খুঁজে পেলাম তাপস কুমার দত্তের এই লেখার ভেতর দিয়ে ।
প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক প্রচেত গুপ্তর ,'কাঁকড়াঝোড়ের দিনরাত্রি 'আমাদের নিয়ে চলে যায় এক অদ্ভুত ভালো লাগা জগতে ।প্রচেত গুপ্তের  লেখা মানেই  একটা অন্য ধরনের প্রাপ্তি ।লেখার  শুরুতেই তিনি যে 'খসখস, খসখস'--  এই শব্দ দুটি দুবার উচ্চারণ করলেন, তার মধ্যে দিয়ে যেন আমরা পৌঁছে যাচ্ছি একটা অজানা অচেনা জগতে। যেখানে আমাদের রোমাঞ্চ তৈরি হচ্ছে। আবার সেই রোমাঞ্চের ভেতর দিয়ে তৈরি হচ্ছে লেখক কি দেখলেন, লেখক কি জানলেন ,সে সম্পর্কে একটা অধীর আগ্রহ। অতনুর চাপা গলার গোঁ গোঁ আওয়াজ ,চোখ কপালে ওঠা --এ সমস্ত কিছুই আমাদের 'চৌকিদার দাদা --চৌকিদার কাকা-- চৌকিদার মামা'--- এক অদ্ভুত ভালোলাগা ফ্যান্টাসির  জগততে পৌঁছে দেয়। প্রচেতর ভ্রমণ আমাদের তাঁর অভিজ্ঞতার সঙ্গে এত সুনিবিড় ভাবে আবদ্ধ করে দেয়, সে বন্ধন যেন একটা চিরস্থায়ী বন্ধনে পরিণত হয়, বাঙালি পাঠকের সঙ্গে এই সময়ের অন্যতম সেরা কথাকারের।
পরিশেষে শেষ নিবন্ধ আলিপুর জেল মিউজিয়াম ।কৌশিক রায়ের লেখা ।আমাদের ইতিহাস চেতনার এক নির্মাণ- বিনির্মাণের পরীক্ষাগার এই জেল মিউজিয়াম ।
 প্রত্যেকটি বাঙালির নিজের অতীতকে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বাঙালির ভূমিকা কে জানবার, বোঝবার জন্য দেখা দরকার-- সেই শিক্ষাটা ,রুচিবোধ তৈরির সেই বিষয়টা লেখার মধ্যে দিয়ে বারবার উঠে এসেছে। পরিশেষে ঘরে বসে হোটেল বাছাইয়ের বেশ কিছু সুযোগ সন্ধান কৌশিক রায় দিয়েছেন ।যেটা এই বইয়ের একটি অন্যতম বড় প্রাপ্তি ।
বইটি পড়ে শেষ করে আলোচনা লিখতে বসলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে মৌ রায়চৌধুরীর কথা। নশ্বর  শরীরে তিনি না থাকলেও আমাদের বিশ্বাস ,অনন্তলোক থেকে এই ধরনের বই প্রস্তুতিতে তিনি তাঁর অনির্বচনীয়  উৎসাহ স্নেহ এবং আশীর্বাদ করে যাবেন চিরকালের জন্য, চিরদিনের জন্য।
 
 
সেরা সফর
প্রধান উপদেষ্টা
মৌ রায়চৌধুরী
সম্পাদনা
পল্লব বসুমল্লিক
আজকাল
২৫০ টাকা

  • সুব্রত ভট্টাচার্য