মফস্বলের ব্যতিক্রমী প্রয়াস

ইন্টারনেট, সমাজমাধ্যমের যুগে মফস্বল থেকে এমন একটা পত্রিকা এই ভরসা দেয় না, এখনও সব শেষ হয়ে যায়নি। মফস্বল থেকে কোন পত্রিকা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করে চলা, এ ব্যাপারটি যে কতটা শক্ত সেটা যাঁরা পত্রপত্রিকা সংক্রান্ত খবরাখবর রাখেন, তাঁরা প্রত্যেকেই বিশ্বাস করেন। এই রকম একটা বিশ্বাসের ভিতর দিয়েই গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত 'নিরন্তর' পত্রিকার নিরবচ্ছিন্ন প্রকাশ আমাদের মনে ভরসা যোগায় । এখনও মফস্বলে যে মেধা চর্চার ক্ষেত্রে সদরের সঙ্গে সমানভাবে টক্কর দিতে পারে ,প্রযুক্তির এই নিত্য নতুন ভঙ্গিমায় মফস্বল যে সমান তালে তাল মিলিয়ে অত্যন্ত আধুনিক মননের একটা পরিচয় রাখতে পারে, এই পত্রিকাটি তার প্রমাণ।

নিরন্তর পত্রিকার এবারের বিষয় ,'ভারতে ধর্মীয় মৌলবাদ'। বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ এ বিষয়ে প্রকাশিত হয়েছে। নবীন প্রজন্মের লেখক থেকে শুরু করে প্রবীণ প্রজন্ম, অনেকেই এ বিষয়ে কলম ধরেছেন। মীর রাকেশ রৌশন, তরুণ কুমার দত্ত, সাহাবুদ্দিন, দেবী চট্টোপাধ্যায় ,সম্পাদক গৌতমবাবু স্বয়ং । তাঁদের লেখাগুলি মননশীলতার দিক থেকে খুবই মেধা সম্পন্ন হলেও একটা কথাই বলতে হয় ,ভারতে ধর্মীয় মৌলবাদ ,সময়ের নিরিখে  নিত্য নতুন কৌশল অবলম্বন করছে। ভারতের সংখ্যাগুরু ,মৌলবাদী ,সাম্প্রদায়িক শক্তির রাজনৈতিক প্রতিভু আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে কেন্দ্রে সরকার তৈরি করবার আগে ,সাম্প্রদায়িকতা এবং মৌলবাদের প্রশ্নে যে, কৌশল অবলম্বন করে চলত তারা,  ২০১৪ সালে একক গরিষ্ঠতা নিয়ে তারা যখন কেন্দ্র সরকার গঠন করে, তারপরে সেই কৌশলের মধ্যে বিস্তার অদল বদল ঘটতে থাকে।

শাসন ক্ষমতাকে ব্যবহার করে মৌলবাদ কীভাবে ফ্যাসিবাদের প্রয়োগের দিককে সমাজের বুকে ফুটিয়ে তোলে বিগত ১০ বছরে মোদির একক গরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার পরিচালনার সময়কালের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে ভারতবাসী সেটা প্রত্যক্ষ করেছেন। আবার অতীতে যখন এনডিএ নামক একটি নীতিবিহীন, সুবিধাবাদী জোটের মধ্যে দিয়ে বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার প্রায় তিন দফায়, সাড়ে ছয় বছর কেন্দ্রে ক্ষমতায় ছিল, তখন সমাজের বুকে মৌলবাদের বিকাশের প্রশ্নে, সাম্প্রদায়িকতার বিকাশে প্রশ্নে ,সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়িক শক্তি কি কৌশল অবলম্বন করেছিল ,সেটাও আমরা দেখেছি।

বাজপেয়ী  জামানার কৌশল এবং প্রয়োগ বা পরবর্তীকালে দুই দফার ইউপিএ সরকারের আমলে, বিরোধী আসনে বসে ,ধর্মীয় মৌলবাদ এ দেশে কীভাবে তাদের নখদন্ত বিস্তারের উপক্রম করেছিল সেসব দেশবাসী দেখেছে। কিন্তু পরবর্তীকালে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে দশ বছর একটানা মোদী শাসন ক্ষমতা পরিচালনার করবার পর কি ধরনের অদল বদল ঘটেছিল, সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট আলোচনা এই পত্রিকায় আমাদের প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু বলতে হয় ,এই তুলনামূলক আলোচনার জায়গাটি বহু প্রবন্ধের সমাহার সত্ত্বেও আমরা পাইনি ।

যে বিষয়গুলি এখানে আলোচিত হয়েছে, সেগুলি কিন্তু বহু চর্চিত বিষয়। সাম্প্রদায়িকতা স্বাধীন ভারতে কী ভাবে বিস্তার লাভ করেছে বা জাতীয় আন্দোলনের কালে তার বিস্তারের গতি প্রকৃতি কি ছিল, তা নিয়ে বহু আলাপ-আলোচনা, বহু সন্দর্ভ  রচনা ইতিমধ্যে হয়ে গেছে। কিন্তু সেই আলাপ আলোচনাগুলির মধ্যে যে সমস্ত নতুন ডাইমেনশন আমরা দেখতে পাই, সেগুলি কিন্তু এখানে খুব একটা আলোচিত হয়নি।

মুসলিম মৌলবাদের ভারতে বিস্তার সম্পর্কে সাহাবুদ্দিনের প্রবন্ধটি অত্যন্ত মূল্যবান। কিন্তু সংখ্যালঘু মৌলবাদ কিভাবে সংখ্যাগুরু মৌলবাদের পাল্টা একটা ধারণা হিসেবে ভারতীয় রাজনীতির প্রেক্ষিতে বিভিন্ন সময়ে  বিভিন্নভাবে বিস্তার লাভ করেছে, আর তার নিরিখে সংখ্যালঘু মনস্তত্ত্বের মধ্যে কি ধরনের টানাপোড়ন চলেছে সাহাবুদ্দিনের প্রবন্ধটিতে সেটা  আমরা আশা করেছিলাম। সংখ্যালঘু মনস্তত্ত্বের দিকটি সংখ্যাগুরু সমাজ সাধারণভাবে এড়িয়ে যায়। আর সংখ্যালঘুরই যেন একটা দায় থাকে নিজেদের মানসিক যন্ত্রণা জানানোর। সংখ্যালঘুর মনের চাবিকাঠি খোলা তো দূরের কথা, খোঁজবার চেষ্টাও যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সংখ্যাগুরু করে না, এই চরম সত্য প্রকাশের অভাব আজকের দিনে সারস্বত দুনিয়াতেও খুব প্রকট হয়ে উঠছে ।

বাংলা ভাষায় সাম্প্রদায়িকতা ঘিরে আলোচনার ক্ষেত্রে অন্নদাশঙ্কর রায় যে পথ দেখিয়েছিলেন, যে পথের পথিক ছিলেন সুরজিৎ দাশগুপ্তর মত মানুষ , সেই ধারাবাহিকতা রক্ষার জায়গাটি যেন নিরন্তর ভাবে কোথাও একটা থমকে রয়েছে। যে কোনও দেশেই ধর্মীয় মৌলবাদ সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে ক্ষমতার রাজনীতির একটা সম্পর্ক থাকে। সেই ক্ষমতার রাজনীতির দ্বান্দ্বিকতার প্রশ্নে, শাসকের মধ্যে কোনও মৌলিক চরিত্রগত ফারাক কখনও দেখতে পাওয়া যায় না। সাম্প্রতিক কালে বা সাম্প্রতিক অতীতে ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িকতার পাল্টা হিসেবে যেভাবে নরম সাম্প্রদায়িকতা, নরম হিন্দুত্ব এবং প্রতিযোগিতামূলক সম্প্রদায়িকতা ভারতের রাজনীতিকে ক্রমশঃ জটিল থেকে  জটিলতর করে তুলছে, সে বিষয়ে  আলোচনার অভাব এই পত্রিকাটিতে দেখে একটু মর্মাহত হলাম ।

সাম্প্রদায়িকতার গতিপ্রকৃতি ঘিরে সুচারু আলোচনার ক্ষেত্রে প্রয়োজন লেখকের নির্মোহ মন ও মানসিকতা। সেই মানসিকতায় কখনো কোনো দলীয় রাজনীতির ছাপ থাকলে তবে সেটি একদেশদর্শিতা দোষে দুষ্ট হবে। দেবী চট্টোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ , 'হিন্দু মৌলবাদের উত্থান ও ভারতের ঘনীভূত সংকট' একদেশদর্শিতা মুক্ত একটা নিরপেক্ষ মূল্যায়ন। যে মূল্যায়ন আমাদের কেবলমাত্র ধর্মীয় মৌলবাদ ঘিরে সুচিন্তিত একটা ধারণাকেই তৈরি করবে তা নয়। আগামী দিন সম্পর্কে আমাদের চেতনার জগতকেও একটা সুনির্দিষ্ট বোধে উপনীত হতে সাহায্য করবে।

সম্পাদক গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়ের ,'গীতা,মনুস্মৃতি ভারতকে ভিখিরি করেছে', অত্যন্ত সুখপাঠ্য প্রবন্ধ। তবে একটা কথা বলতেই হয় , ভাববাদী দর্শনের ক্ষেত্রে গীতার যে অবস্থান, সেই অবস্থানকে ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তি রাষ্ট্র পরিচালনার একটি প্রায়োগিক দিক হিসেবে ছদ্মভাবে তুলে ধরবার চেষ্টা করে ।এই ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তির গীতাকে প্রয়োগ করবার দিক তুলে ধরবার বিষয় আর সংশ্লিষ্ট অনুধ্যান টির মধ্যে ভাববাদী দর্শনের যে বিষয়বস্তু ,বিশেষ করে সমর বিদ্যা থেকে শুরু করে পরলোক ইত্যাদি নিয়ে যে ভাবনাচিন্তা, তার দার্শনিক প্রবাহ ,দুটি ভিন্নধারার বিষয়।

এই ধারাকে ভিন্নতায় প্রবাহিত করা ভারতের বুকে ঘটছে। সেটা ঘটছে একাংশের  রাজনৈতিকদের দ্বারা । বিশ্বের সমস্ত দেশেই সেটা ঘটে। রাজনীতিকদের দ্বারা বাইবেলকে ও তার দর্শনের মূল লক্ষ্য থেকে অন্য খাতে বইয়ে দিয়েছিলেন ধর্মের রাজনৈতিক কারবারিরা। সাম্প্রদায়িক বিকৃতি ঘিরে আসমাউল সেখের প্রবন্ধটি বেশ মৌলিকত্বের দাবি রাখে । বিকৃতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রশ্নে এই প্রবন্ধটি শুধু সমকালে নয় ,ভাবি কালের ক্ষেত্রেও একটি বড় রকমের হাতিয়ার হয়ে উঠবে বলে বিশ্বাস রাখা যায়।

এই প্রবন্ধের ডালির পাশাপাশি দুটি ছোট গল্প ইভান অনিরুদ্ধ এবং শতদল দেবের লেখা-- যথেষ্ট সুখ পাঠ্য ।বিশেষ করে উল্লেখ করতে হয় ,'অণুভবনা'  হিসেবে তটিনী দত্তের লেখা,' এক ভ্রমণ জীবনে'র কথা ।

লোকসংস্কৃতিবিদ সুধীর  চক্রবর্তীকে ঘিরে জয়ন্ত কুমার ঘোষালের,'মেলা থেকে মেলায়'নিবন্ধটি কেবল সুখ পাঠ্য বললেই কম বলা হবে। এত স্বল্প পরিসরে সুধীর চক্রবর্তীর মতো মানুষের সৃষ্টির একটি  বিশেষ দিক তুলে ধরা অত্যন্ত মুন্সিয়ানার একটি কাজ । সুকুমারী ভট্টাচার্যকে নিয়ে কনিষ্ক চৌধুরীর নিবন্ধটি যথেষ্ট চিন্তার খোরাক যোগায়। অনামিকা তেওয়ারির অনুবাদ কবিতা এবং তটিনী দত্ত ,সোমদত্তা চট্টোপাধ্যায়ের অনুবাদ একটা অন্য রকমের স্বাদ এনে দেয় ।

সর্বোপরি বারবার একটা কথাই বলতে হয় ,মফস্বল থেকে এমন একটি সর্বাঙ্গ সুন্দর, ছাপা, বাঁধাই ইত্যাদির ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ একটি পত্রিকা পাঠক সমাজকে উপহার দিয়ে পত্রিকার সম্পাদক গৌতম বন্দোপাধ্যায়, আমাদের কাছে একটা বড় সামাজিক দায় পালনের কারিগর বলেই ভালোবাসা এবং অভিনন্দন যোগ্য মানুষ হিসেবেই  নিজের প্রতিষ্ঠাকে আরো সুনিশ্চিত করলেন। নিরন্তরের জন্য আমাদের রইল নিরন্তর শুভেচ্ছা।
নিরন্তর
১৪ বর্ষ, ২য় সংখ্যা, মে -'২৪
বি -৪/২৮৬
কল্যাণী
নদিয়া
৯১৬৩২০৮২৪১
সম্পাদক
গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়
৮০ টাকা

  • সুব্রত ভট্টাচার্য
  • পত্রিকা সংবাদ