হ্যামলিন বাঁশিওলার বংশধর

‘সময় কিন্তু দ্রুত পেরিয়ে যাচ্ছে। কিছু একটা সিদ্ধান্ত নিতেই হবে।’ মেয়রের গলার গাম্ভীর্য আমাকে বাড়তি সতর্ক করে তুলল। কিন্তু সে অর্থে করণীয় বা সমাধান কোনওটাই হাতে ছিল না এই মুহূর্তে। বললাম,‘আর কয়েকটা দিন সময় দিতেই হবে। গবেষণার জন্য বৈজ্ঞানিকদেরও যথেষ্ট সময় দিতে হবে।’

‘কিন্তু শহরের ডাক্তার, সাইকোলজিস্ট বা সায়ক্রায়াটিস্টরা আমার সঙ্গে মিটিং করে যা বলেছেন, তা যথেষ্ট ভয় ধরানোর। শহরের মানুষকে যদি আর কয়েকদিনের মধ্যে না হাসানো যায়, শিয়রে বিপদ। অপরাধ আবার মারাত্মক হারে বেড়ে উঠবে। শারীরিক ও মানসিক রোগও মাথা চাড়া দেবে। সবচেয়ে বড় কথা শিল্প-কারখানা-মল-হসপিটাল-সার্ভিস-রেস্টুরেন্ট- কোথাও মানুষকে কাজ করানো যাবে না। শহর শুধু অচল হবে না। যাকে বলে সভ্যতা মুখ থুবড়ে পড়বে। শহরের পুলিশ কমিশনার হিসাবে বুঝতে পারছেন আগামী কয়েকদিনে কী ঘটতে পারে?’

নীরবে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম। একজন শিক্ষিত-সচেতন প্রশাসনিক প্রধান হয়ে ঘটনার ভয়াবহতা আর গুরুত্ব না বোঝার কথা তো নয়।

মেয়রের চেম্বারের ঘড়িটা টিকটিক করে যাচ্ছে। নীরবতার মধ্যে যেন অস্বস্তি। বললাম,‘মুখ্যমন্ত্রী কী বলছেন?’

প্রশ্নটা করার পর বুঝলাম, ভুল সময়ে ভুল প্রশ্ন করা হল। রাজ্যের আরও বেশ কয়েকটা শহরে একই সমস্যা মাথাচাড়া দিয়েছে বা দেবে, এমন আভাস নজরদারী বিভাগের তরফে আগে থেকেই ছিল। মুখ্যমন্ত্রী এরকম অবস্থায় জরুরি মিটিং-এ ব্যস্ত থাকবেন সেটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া দায়িত্ব আমরা কোনও অবস্থাতেই এড়িয়ে যেতে পারি না। মেয়রকে দেখে অবশ্য মনে হল, মুখ্যমন্ত্রী কী বলছেন, সেটা নিয়ে উনি এই মুহূর্তে ভাবছেন না।

 

‘যা বলেন। এনিহাউ স্বাভাবিক শহরের সিস্টেমকে রিস্টোর করতে হবে।’

আসলে অচলাবস্থাটা বিগত দেড় সপ্তাহের কিছু বেশি সময় ধরে। প্রায় দু-যুগ আগে যখন আমাদের দেশের বেশিরভাগ শহরের মানুষরা নিজেদের জীবনযাত্রার কারণে হাসতে ভুলে গিয়েছিল, তখন বিজ্ঞানীদের নিদান নিয়ে নিরাপদ মাত্রায় লাফিং গ্যাস বা নাইট্রাস অক্সাইডকে স্পেসিফিক কনট্রোলড ডোজ হিসাবে ব্যবহার করা শুরু হয়। বিভিন্ন ফার্মা কোম্পানি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের মাধ্যমে বাজারে নিয়ে আসে লাফিং গ্যাসের ইনহেলার। তার সেফটি রেঞ্জ টেস্ট করে করে খোলা বাজারে রাখতেও শুরু করে বিভিন্ন কেমিস্ট শপ। মূলত অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট নামে একটা রাসায়নিক থেকে লার্জ স্কেল ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রোডাকশন হত। এছাড়া পেট্রোলিয়াম প্রোডাক্টস থেকে নাইট্রিক অক্সাইড যে তৈরি হয়, তার অক্সিডেসন করেও তৈরি করা হত লাফিং গ্যাস। বছর দশেক আগে আমাদের দেশে পেট্রোলিয়াম প্রোডাক্ট শেষ হয়ে যায়। সমস্ত যানবাহন বা হিটিং সিস্টেমকে ইলেকট্রিক এনার্জির সাহায্যে কাজ করানো শুরু হয়। বিকল্প বিভিন্ন শক্তির প্রয়োগ আসে।

কিন্তু এর মধ্যে আমরা দেখিনি অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের ভান্ডার শেষ হয়ে গিয়েছে। অন্যান্য রাসায়নিক পদ্ধতিতে বা বাতাসের নাইট্রোজেনকেও লাফিং গ্যাসে রূপান্তর করা মারাত্মক ব্যায়ের হয়ে গেছে। আশেপাশে সেভাবে জমিই নেই যেখানে মটরগাছ বসিয়ে নাইট্রোজেন তা থেকে পাওয়ার ব্যবস্থা করা যায়। মোটমাট দেড় সপ্তাহ হল আমাদের তো বটেই, দেশের অনেকগুলি শহরে মানুষ আর হাসছে না। স্বাভাবিকভাবে যেহেতু তারা হাসতে ভুলে গেসল, হাসার জন্য যে শারীরবৃত্তিয় প্রক্রিয়ার দরকার ছিল তাও বিবর্তন ও অভিব্যক্তির নিয়মে লোপ পেয়েছে। প্রত্যেকেরই জীবনযাত্রায় এই ইনহেলার ঢুকে যাওয়ায় আমাদের সবার মধ্যেই এক ধরনের নির্ভরতা তৈরি হয়েছে। কারণ লাফিং গ্যাসের নেশাগ্রস্ত ও ঘুমঘুম ভাব তৈরি করারও একটা সাধারণ ক্ষমতা ছিল।

 

আর এখান থেকেই শহরে জীবনযাত্রা নিয়ে বড়সড় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কারণ শেষ কয়েক দশকে আমাদের সমস্ত সেক্টরকেই তিন শিফটে কাজ করতে হয়। আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সকে কাজে লাগিয়ে সভ্যতার চরম গুণগতমান তৈরি করতে গিয়ে তাকে বশে রাখতে মানুষকে তার থেকেও বেশি কৃত্রিম আর যান্ত্রিক হতে হয়েছে। একটা সময় ওয়ার্ক সেক্টরে ব্যাপক ছাঁটাই শুরু হয়েছিল। অর্থনীতি বিপর্যস্ত হচ্ছিল কাজের সেক্টরে মানুষ কাজ হারাচ্ছিল বলে। ক্রয়ক্ষমতা বাজারের কমে যাচ্ছিল। মাত্র কিছু সময়ের মধ্যে সভ্যতায় সমতা আনতে মানুষ জনসংখ্যাকে সুন্দর করে নিয়ন্ত্রণ করে নেয় সারাদেশে। বিবাহের হার শূন্যতে নেমে আসে। কঠোর জীবনযাত্রাও অস্তিত্বরক্ষার বশে প্রেম, অনুভূতি, বন্ধুত্বর মতো শব্দকে প্রায় বর্জন করে মানুষ নিজের যান্ত্রিক হওয়া স্বাভাবিক করেছে।

অবশ্য এর মধ্যে ভাল বলে যদি আদৌ কিছু হয়, সেসবও ঘটেছে। দূষণের হার বেশ কমে গেছে। সাধারণ চুরি, ডাকাতি প্রায় নেই। শরীরী চাহিদা কমে গেছে বলে ধর্ষণের রিপোর্ট নেই। বেশিরভাগ থানা এখন শহরের হাইফাই সাইবার হানা ও অপরাধ নির্ণয়ে ব্যস্ত। আশ্চর্যের ব্যাপার রাজনৈতিক ইস্যু, একদম তৈরি হচ্ছে না। সমাজের এই অবস্থা থেকে বর্তমান রাজনৈতিক দল খুব একটা ফায়দা তুলতে পারছে না। সব সেক্টরে চরম শিক্ষিত ও প্রযুক্তি জ্ঞানের লোক থাকলেও রাজনীতিতে এই অভাবটা থেকে গেছে। মানুষের মধ্যে আবেগ যেহেতু নেই, তাতে সুড়সুড়িও দেওয়া যাচ্ছে না।

সারাদিন-রাত কাজ করেমানুষ একটু কৃত্রিমভাবে হাসত। সেটার রাস্তাও বন্ধ। সবকিছু ঠিকঠাক এ যাবত চলছিল বলে, শহরের কমিশনার হিসাবে আমার দিন খারাপ কাটছিল না। মেয়রকে বললাম,‘শাসকদলের এগেনস্টে বিরোধীদলের কোনও চক্রান্ত নয় তো?

‘ধূস। চক্রান্ত করার জন্য যে বোধ আর সংগঠন লাগে, তা আর আছে নাকি ওদের? এত বছর ক্ষমতায় থেকে, কী যেন বলে, বিজ্ঞানের আর যুগবদলের সাহায্য নিয়ে ওসব অনেক আগেই ধ্বংস করে দিয়েছি।’

 

ভাবলাম, একবার বলি ওরাই কিন্তু বিজ্ঞানের প্রয়োগ জীবনে করা দরকার, বলেছিল। আপনারা তো অপপ্রয়োগ করলেন। বললাম না। যান্ত্রিকভাবে কাজ করে নয়, আমি এনাদের সাপোর্ট সিস্টেমেই আজ এ শহরের কমিশনার। তাছাড়া এটা এখন বলার সময়ও নয়। শহরের শাসক, সরি, প্রশাসক হিসাবে আমাকে এখন এ শহরকে হাসাতে হবে আবার।

মেয়রের অফিস থেকে বেরিয়ে উঠলাম নিজের গাড়িতে। সামনের সিটে আমার দেহরক্ষী। অফিসটাইম হলেও শহরে এসময় কোনও যানজট নেই। প্রোডাকসন, সার্ভিস, হেলথ আর কনজিউমার ছাড়া যেহেতু সব সেক্টরেরই বাড়িতে বসে কাজ এখন, মানুষকে বেরোতে হয় না সেভাবে।

উঁচু উঁচু বিল্ডিং, যেন স্বর্গে চলে গেছে তার ছাদগুলো। এসব বাড়ি তৈরি করেই তো আমাদের সভ্যতা এখন স্বর্গসুখ নামিয়ে এনেছে। এক একজনের কাছে শ’খানেক করে ফ্ল্যাট থাকলেও অবাক হই না। জনসংখ্যা কমলেও ফাঁকা জমি, মাঠ সে অর্থে নেই। গাছ খুবই কম। ফ্রেশ বাতাসের অভাব হলে প্ল্যান্ট থেকে অক্সিজেন তৈরি করে ছেড়ে দিই বাতাবরণে। মাঠ-স্টেডিয়াম-ক্লাব সব আলাদা আলাদা করে রাখা আছে। তবে সব খেলাই এখন ছোট ভার্সনে হয়। ধৈর্য ব্যাপারটা মানুষের মধ্যে নেই। পাঁচ দিনের টেস্টক্রিকেট এই সভ্যতায় ঐতিহাসিক যুগে খেলা হত।

 

গাড়ি রাস্তা থেকে উড়ালপুলে উঠল। শহর জুড়ে এখন উড়ালপুল, যার একেকটায় একেক স্পিডের গাড়ি চলে। যার আরও তাড়াহুড়ো, তাদের শক্তিচালিতপার্সোনাল কপ্টার আছে। এত কিছু থেকেও অবশ্য আমাদের নাগরিক কোলাহল নেই। বড় নিঃশব্দ, নীরব। মানুষ চরম বিচ্ছিন্ন। বহু বছর কোনও আন্দোলন নেই। সব দেশই অসীম শক্তিধর। তর্জন-গর্জন চললেও যুদ্ধ হয় না। হলে তার ফল কী হবে, সব পক্ষই জানে। এইসব নৈঃশব্দের মধ্যে, এত যান্ত্রিকতায়ও আমি ক্লান্তিকে শ্বাস ফেলতে শুনি। হাঁ করে আনমোনা হয়ে বাড়িগুলোর দিকে তাকিয়েছিলাম। আমার দেহরক্ষী বলল,‘একটা কথা বলব স্যার?’

চোখ, মাথা ঘুরিয়ে তাকাই ওর দিকে। ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলি।

‘একটা খবর কানে এসেছে। শহরের প্রান্তে একটা লোক এসেছে। লোকটা নাকি দাবি করেছে আমাদের সমস্যার সমাধান আছে ওর কাছে।’

আমাদের শহরে গুজবও বহুদিন রটেনি। ওসবে আমাদের কোনও ইন্টারেস্ট নেই। আমার দেহরক্ষী আমাকে বেশ কিছুদিনসমস্যায় দেখছে। চিন্তায় রয়েছি দেখে এরকম একটা কিছু বলতে পারে কি! তবে কোনওদিন বলেনি। যন্ত্রের মতো কাজ করে যায়। বললাম,‘কীরকম?’

‘ও নাকি বাঁশি বাজিয়ে মানুষকে হাসিয়ে দিতে পারে।’

‘এরকম হয় কখনও? মনে হচ্ছে, এই মওকায় কেউ কিছু রোজগার করে নিতে চাইছে।’

‘না স্যার। আমার পাশের ফ্ল্যাটের ছেলেটা গিয়েছিল। সে নাকি নিজের চোখে দেখেছে।’

‘তোমাকে আমার দেহরক্ষী কেন রেখেছি বলো তো? সেভাবে  যখন এ শহরে অপরাধই নেই।’

চুপ করে থাকল দেহরক্ষী।

 

আমি বললাম,‘তোমাকে আমার পাশে রেখে মানুষকে বা সরকারকে আমি দেখাই, হচ্ছে না মানে অপরাধ যে নেই এমন নয়। এই লোকটার হয়ে দু-চার জন বলতে শুরু করলে তখন অনেকেরই মনে হবে বাঁশিতে হয়তো সত্যিই কাজ হয়।’

কোনও উত্তর নেই দেহরক্ষীর থেকে। বুঝতে পারছে, বলাটায় গুরুত্ব দিলাম না। অফিসে ঢোকার একটু আগে মনে হচ্ছিল লোকটাকে একবার বাজিয়ে এলে খারাপ হয় না। আর কিছু না হোক উল্টোপাল্টা গুজব রটানো বন্ধ করা যাবে। তবে খুব বেশি ফোর্স নিয়ে গেলে হবে না। গোটাকয়েক সিনিয়র অফিসার আর কনস্টেবলই যথেষ্ট। তবে আমাকে যেতেই হবে। শহরে এরকম প্রচার করতে গেলেও যে সাহস লাগে,  লোকটার আছে।

#  #  #

মেয়র ভ্রু কুঁচকে বললেন,‘এরকম হওয়া সম্ভব নয়। এ রকম হয় না।’

লোকটার মুখে মৃদু হাসি। এই একই হাসি কাল রাতে যখন দেখা করতে গেছি ঠোঁটে ঝুলে ছিল। বলল,‘এই একই কথা আমার পূর্বপুরুষকেও শুনতে হয়েছিল। আপনারই মতো এক মেয়র বিশ্বাস করতে পারেননি যে তিনি স্রেফ বাঁশি বাজিয়ে কোনও শহর থেকে সব ইঁদুর তাড়িয়ে দিতে পারেন। কিন্তু তিনি দিয়েছিলেন।’

দু’হাতের তালু ঘষছেন মেয়র। কোনও ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবার আগে তিনি এরকম করেন। ঘষতে ঘষতেই বললেন,‘যতদূর জেনেছি আপনি এ শহরের বাসিন্দা নন।’

 

‘ঠিকই শুনেছেন। আমি যেখান থেকে এসেছি সেখানকার পরিচিতিপত্র আপনার কমিশনারকে দেখিয়েছি। তিনি জাল বলেননি তা।’

‘শুনেছি। কিন্তু আপনি এ শহরে এলেন কেন হঠাৎ?’

‘কারণ আমার বাঁশি যে শহরে মানুষ হাসতে ভুলে গেছে, শুধু সে শহরেই কাজ করবে।’

‘তাহলে এরপর আপনি সেসব শহরেও যাবেন?’

‘ঠিক করিনি। হয়তো।’

‘আপনার বাঁশি কি আপনাকে আপনার পূর্বপুরুষরাই দিয়েছেন?’

‘এত কথা বলা যাবে না। আপনি আমাকে এত কথা বলতে বাধ্য করতে পারেন না।’

 

মেয়র লোকটার দিকে একদৃষ্টিতে মেপে নেওয়ার ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছেন। মাঝে মাঝে পা নাড়াচ্ছেন। অস্থির থাকার লক্ষণ। বিরক্ত হচ্ছিলাম। এসব কথা লোকটার সঙ্গে কাল রাতে আমার একপ্রস্থ হয়ে গেছে। প্রথমে ভেবেছিলাম, কাছে গিয়ে ভালমতো কড়কে দিলে বেবাক ফালতু কথা বন্ধ হয়ে যাবে। লোকটার নামটাও অদ্ভুত হামলাল সারেং। এটা নাকি তার বাবার দেওয়া নাম। পরিচয়পত্রচেক করে দেখে ফেক মনে হয়নি।

আমার আশেপাশে গোমড়ামুখো রোবটশরীর আর মুখের পুলিশ বাহিনী ওকে প্রথম দেখাতেই গুলি করে দিতে চেয়েছিল। আমি আটকাই। লোকটা আজকের এই কথাগুলো বলার পর নিজের ঝোলা থেকে একটা খুব সাধারণ বাঁশি বের করে বাজাতে শুরু করে। আমরাও হেসে উঠি। অনেকক্ষণ হেসেছিলাম। নেশাগ্রস্তের মতো। সবাই হেসেছিল। বাজানো থামতেই বুঝতে পেরেছিলাম, লোকটার মারাত্মক ক্ষমতা। দু’জন কনস্টেবলকে রেখে ফিরে এসেছিলাম। সকালহতেই লোকটাকে ধরে নিয়ে চলেএসেছি মেয়রের অফিসে।মুখ্যমন্ত্রী জানতে পেরে স্পেশাল ইন্সট্রাকশন দিয়ে দিয়েছেন। ডিসিশনটা এবার আমাদের এ শহরের সিনিয়র অফিসিয়ালদের নিতে হবে।

ছেঁড়া, ঝোলা বর্ষাতির মতো জামা আর ফুলপ্যান্ট দাড়িওলা লোকটার দিকে মেয়র একভাবে তাকিয়ে। নিশ্চুপ, স্থির ভঙ্গিমায় নিজের বাঁশিটার দিকে তাকিয়ে বসে আছে সে।

 

মেয়র আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,‘যদি এ শহরের লোককে এ বাঁশির আওয়াজ শোনাতেই হয়, কীভাবে কী করবেন ভেবেছেন?’

আমি বললাম,‘সহজ। এক একটা জায়গায় লোক জমায়েত করে আমাদের ইমপ্রুভড লাউডস্পিকার-’

‘না, না,’ মেয়রের চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে উঠল,‘এর বাঁশি আমরা রেকর্ড করব। তারপর শহরের মানুষের কাছে পরিষেবার নাম করে বিক্রি করব। সরকারের রাজস্বের কথাটা ভাবতেই হবে।’

আইডিয়াটা আমার ভাল লাগছে না। মানুষের হাসি নিয়েও সরকার ঘৃণ্য খেলা খেলবে! চুপ করে থাকলাম।

আমাদের কথার মাঝখানে লোকটা  বলে বসল,‘সেটা আপনাদের ব্যাপার কী করবেন! কিন্তু আমি একজন শিল্পী। আমাকে কিন্তু অর্থমূল্য দিতেই হবে।’

মেয়রের মুখে বরাভয় হাসি,‘বলুন। আপনাকে কত দিতে হবে?’

‘বেশি না। সারাজীবন ভাত-কাপড় হয়ে যায় এমন কটা টাকা দিলেই হবে।’

‘ঠিক আছে। আমরা রাজি। এমএলএ, এমপি, মন্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই। আপনাকে আমরা পাঁচ কোটি দেবো। তার বদলে মানুষ যাতে হাসতে পারে প্রাণখুলে এমন কিছুটা সময় আপনি বাঁশি বাজাবেন। আমরা রেকর্ড করে নেবো।’

লোকটার মধ্যে এবার চাঞ্চল্য,‘কখন দেবেন টাকাটা?’

মেয়রের চোখ হলুদ,‘এখুনি। আপনাকে এক্সাটপাঁচ কোটি নয়। তা থেকে দশ লাখ কেটে দেবো। কিন্তু বাইরে বেরিয়ে বলতে হবে, আপনি পাঁচ কোটি পেয়েছেন।’

বড় চুলের মাথাটা চুলকে লোকটা কয়েক সেকেন্ড কী ভাবল। তারপর বলল,‘তা নিন। কিন্তু এই দশ লাখ আমার কাটা যাচ্ছে কেন!’

‘ওটা কাটমানি। যেকোনও ডিলেই দিতে হয় এ শহরে। বহু বছরের নিয়ম।’

লোকটার গলায় বিষণ্ণতা,‘তাই বলে দশ!’

মেয়রের মুখে ক্রুরহাসি,‘নেতা,মন্ত্রী সবাইয়ের মধ্যে ভাগ করে নিতে হয়। অনেক হ্যাপা আছে। আপনি বুঝবেন না।’

আমার খুব বিরক্ত লাগছিল। বললাম,‘এনার রেকর্ডিং-এর ব্যবস্থাটা করে ফেলি?’

‘হবে, হবে। আগে ওনাকে টাকাটা দিয়ে দিই।’ মেয়র খুব উদার হয়ে উঠেছেন হঠাৎ।

পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখলাম, মন্ত্রী, এমএলএ, এমপি সবাই এসে ঢুকলেন। কেউ একজন টাকার ব্যাগ এগিয়ে দিল লোকটার দিকে।

মেয়র ভেতরে আসা এক চামচার দিকে ফিরে বললেন,‘পল্টু, তুই খুব ভাল বাঁশি বাজাতে পারিস না?’

দেঁতো হাসি এসে পল্টু একপাশে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।

মেয়র বললেন,‘লোকটার বাঁশিটা কেড়ে নে।’

আমি চমকে উঠলাম। লোকটার দিকে তাকিয়ে দেখলাম। কোনও বিকার নেই।এক মনে টাকা গুনে যাচ্ছে। পল্টু তার দিকে এগোতেই সে অমায়িকভাবে বাঁশিটা তার দিকে এগিয়ে দেয়।

অত্যন্ত দ্রুতগতিতে টাকার বান্ডিল দেখে মিলিয়ে উঠে দাঁড়ায় লোকটি। হাসিমুখে মেয়রের দিকে তাকিয়ে বলে,‘চলি স্যার। বাঁশিটা দিয়ে গেলাম। টাকাটা একটু বেশি নিলাম। আসলে স্যার সেবার আমার পূর্বপুরুষকে কোনও এক মেয়র এক পয়সাও ঠেকাননি।’

 

দাঁতে দাঁত চিপলেন মেয়র,‘কিন্তু অনেকগুলো বাচ্চা-’

‘তাদের কোনও ক্ষতি হয়নি। সে শহরের অভিভাবকরা তাদের আর খোঁজেওনি। কিন্তু আমাদের পরিবার অনেকদিন না খেয়ে থেকেছিল, শুনেছি। চলি স্যার।’

লোকটা নির্বিকারভাবে বেরিয়ে যায়।

পল্টু বাঁশি হাতে নিয়ে বাজাতে শুরু করে মেয়রের নির্দেশে। সুন্দর, মিষ্টি সুর। পল্টু নাকি তার দলের নির্দেশে অনেক গোপন হত্যা করেছে। তার হাতে এমন সুর! বিমোহিত হয়ে শুনতে শুরু করি সবাই। হঠাৎ কী যে হয় আমার! ভীষণ কান্না পেয়ে যায়। কাঁদতে শুরু করি। সবার দিকে তাকাই। মেয়র, মন্ত্রী, এমএলএ, এমপি, সাঙ্গোপাঙ্গো সবার চোখ দিয়ে বেরিয়ে আসছে ফোঁটা ফোঁটা জল। এমনকী পল্টুরও।

নেশাগ্রস্তের মতো আমরা সবাই অজানা কারণে এবং অনেকদিন পর কাঁদতেই থাকি।হয়তো এ শহরের মানুষেরাও কাঁদছিল।

_________________

  • মানস সরকার