বঙ্গ পুতুলের হাল হকিকৎ

ইউনেস্কো প্রচারিত সমকালের একটি জ্ঞাপন অনুসারে ভারতের মতো উন্নতিকামী
দেশগুলির প্রধান সমস্যা ‘অর্থ’ নয়, অসচেতনতা। এই দেশের অভিজাত থেকে
নিম্নবর্গীয়, সমস্ত স্তরের মানুষরাই কোনও না কোনও ভাবে অসচেতন, এটাই
নাকি এই দেশের উন্নতির মুল অন্তরায়। কথাটি যে ভাবেই বলা হোক না কেন, এটা
সত্যি যে আমরা শিক্ষিতরাও অনেক সময় প্রয়োজনীয় অনেক কিছু বিষয়ে অসচেতন
রয়ে গিয়েছি। উদাহরণ হিসাবে আমাদের প্রাচীন পুতুলনাট্য কলা বা পাপেট্রিকে আনা
যেতে পারে। ঐতিহাসিক এবং পণ্ডিতদের মতে পাপেট্রির আদি শিকড় নিহিত আছে
একদার রাঢ় বঙ্গের 'গঙ্গরিডি’ সভ্যতার নথিতে।

 

অর্থাৎ প্রাচীন ভারতের প্রাগার্য বঙ্গদেশই আমাদের বর্ণময় শিল্প পুতুলনাট্য কলার জননী। বাংলা যে
গোটা পথিবীর পুতুলনাচের উৎস-এটা কি আজকের শিক্ষিত বাঙালি জানে? বা
জানলেও এই বিষয়ে তাদের কোনও স্লাঘাবোধ আছে? নথিপত্রের সালতামামি
অনুসারে আজ থেকে কম করে সাড়ে তিন হাজার বছর আগে তাম্রলিপ্ত বন্দর থেকে
পালতোলা জাহাজে তামা,গুড়,রেশম,কাপাস, মশলা, গন্ধদ্রব্য আর গণিতের শুন্য
ধারণার সঙ্গে ছোটছোট হাতপুতুলও গুজরাতের লোথাল হয়ে প্রথমে মিশর,
পরবর্তীতে ইউরোপের গ্রিসের হাট-বন্দরে হাজির হয়েছিল। একই সঙ্গে মজা আর
মুশকিল হল আমরা, মানে আমাদের দেশ পুতুলনাচের জননী হলেও, আমাদের থেকে
গোটা পৃথিবী পাপেট্রির মন্ত্রগুপ্তি পেলেও, আমাদের এই সময়ের পুতুলনাচ আর
ইউরোপের পাপেট্রিতে কিন্তু বিস্তার তফাৎ। শিল্পটি নিয়ে তাদের বিজ্ঞানসম্মত
ভাবনা আর আমাদের জড়ভরত সুলভ অসচেতনতার পার্থক্যটি আজ প্রায় স্বর্গ
এবং নরকের মতো! আমাদের থেকে শিখে, পরে শুরু করেও কী ভাবে তারা এতটা পথ
এগিয়ে গেল, এই নিয়ে এখানে আমরা একটু যুক্তিবিজ্ঞানের নিরিখে কৌতুহলী আলো
ফেলে অনুসন্ধান করি ।

 

এখানে একটা প্রসঙ্গে বলা খুবই জরুরী। সেটা হল আমাদের পুতুলনাচ আর বিদেশের
পাপেট্রি কিন্তু একই শিল্পসম্ভার নয়। আজকাল সবার হাতে হাতেই স্মার্টফোন।
একটিবার তারা স্ক্রিনে চোখ রাখলেই বোঝা যাবে আমাদের ঐতিহ্যময় এবং গুরুভার
শিল্পকলাটি ইউরোপের বিজ্ঞানচর্চায় ঠিক কতটা অত্যাধুনিক আর নির্মেদ
হয়েছে।  বরং ইউরোপের পাপেট্রি অনুসরণ করে আমাদের থিয়েটারমনস্ক মানুষরা
পুতুলনাচের সঙ্গে থিয়েটারবিজ্ঞান মিলিয়ে একধরনের পুতুলনাটক নির্মাণ করেছেন।
অনেকে তাকে ইদানিং ‘কনটেমপোরারি’ পাপেট বলছেন । এই শিল্পকলাটি বরং
অনেকটাই বিদেশী পাপেটের কাছাকাছি । যে শিল্পের জনক ছিলাম আমরা, সেই
আমরা নতুন করে শিখে কেঁচেগণ্ডুষ করেছি । করেছি এই জন্য যে, আপডেট করে
নেওয়াটাই আজ প্রগতির প্রধান শর্ত। আমাদের এতাদৃশ নিম্নগামিতা নিয়ে
অন্যত্র্র আলোচনা করা যাবে। এখন বরং এর প্রয়োজনীয়তা আর উপযোগিতা নিয়ে
দু-চার কথা হোক।

 

কথাটা যখন সচেতনতা নিয়ে হচ্ছে তখন এটাও সবাইকে অবহিতকরণের প্রয়োজন যে, মানুষকে যে কোনও বিষয়ে সচেতন করার জন্য
যতগুলি উপায় আছে, তার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ উপায় হল পুতুলনাচ, পাপেট্রি বা
অ্যানিমেশনের ব্যবহার। এটা আধুনিক সংস্কৃতিবিজ্ঞানী এবং মনোবিজ্ঞানীদের
মূলবান সিদ্ধান্ত এবং বলা বাহুল্য ইউনেস্কো স্বীকৃত । পাঠকরা একটু খেয়াল
করলেই বুঝবেন যে ইতিমধ্যে সমকালের সমাজবিজ্ঞানীদের তিনটি খুব গুরুত্বপূর্ণ
মন্তব্য তাঁরা জেনেছেন । ১) ভারতের গঙ্গারিডি সভ্যতাই সারা পৃথিবীর পুতুলনাট্য
কলার মাতৃভূমি । ২) পৃথিবীর সর্বত্র জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে যে কোনও
মানুষকে সচেতন করার কাজে পুতুলনাট্য কলার প্রয়োগ হল আজও অমোঘ এবং
সর্বশ্রেষ্ঠ। ৩) আমাদের দেশে উন্নতির প্রধান অন্তরায় হল সার্বিক
অসচেতনতা । গুরুত্বপূর্ণ এই সিদ্ধান্ত তিনটিকে মাথায় রেখে আমরা যদি বলি,
আমাদের দেশে অসচেতনতা যদি প্রধান সমস্যা হয়, পুতুলনাট্য যদি পৃথিবীর তামাম
মানুষকে সচেতন করার সর্বশ্রেষ্ঠ হাতিয়ার বা উপায় হয়, আর আমরাই যদি এই
মহতী শিল্পমাধ্যম সমষ্টির উৎসভূমি হই, তাহলে আমরা এখনও অপেক্ষা করছি
কেন? আমাদের হৃতগৌরব প্রতিষ্ঠার জন্য , আমাদের দেশের প্রতিটি
নাগরিককে সচেতন করার জন্য, কেন আমরা পুতুলনাট্য কলাকে ব্যবহার করছি না? বিষ্ময়ের বিষয় হল, পরস্পর বিরোধিতার হলেও এই দুই প্রান্তিক তথ্যই সত্য।


অতঃপর আসুন এই স্ববিরোধিতার কার্যকারণ, তার সমাধানের পক্ষে যুক্তিপূর্ণ
দিকগুলি নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক।

 

আমরা প্রথমে এই ঐতিহ্যময়
শিল্পকলাটির উৎপত্তি ও বিস্তার, পরে এর সমস্যা, সংকট এবং বিজ্ঞানময়
সম্ভাবনার দিকগুলি নিয়ে আপনাদের তথ্যায়িত করার চেষ্টা করব। আধুনিক
ইতিহাসবিদরা বলেনঃ আর্য আগমনের আগে, মহেঞ্জোদাড়ো সময়কালে
আফগানিস্থানের মুন্ডিগাক থেকে রাঢ়বঙ্গের বেড়াচাঁপা ও তাম্রলিপ্তের নাটশাল
পর্যন্ত কম-বেশি ১৫ লক্ষ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত ছিল একটি সুসভ্য
গ্রামবেষ্টিত নাগরিক সভ্যতা। এরাই ছিল এতদাঞ্চলের আদিম জনজাতি যারা
তৎকালে শিল্প বাণিজ্য প্রতিরক্ষা এবং গণতান্ত্রিক প্রশাসন ব্যবস্থাপনায়
স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল। ডক্টর সুকুমার সেনের মতে, আর্য আগমনের অনেক আগেই
পুর্বভারতের গঙ্গারিডি অঞ্চলে একটি অনার্যসভ্যতা বিদ্যমান ছিল। সমাজে
লোকনাট্যের প্রচলন ছিল। আসলে সেটাই ছিল তৎকালীন লোকযাপনের
নিত্যদিনের একটি অনিবার্য আচরণ মাত্র। লোকনাট্যের একটি অন্যতম শাখা হল পুতুলনাট্য কলা। এই নাট্যই তৎকালীন বঙ্গদেশীয় নাবিক এবং বণিকদের সঙ্গে মিশর হয়ে পরে গ্রিসে পৌঁছেছিল। যার সমর্থন পাওয়া যায় গ্রিক মহাকাব্য
এবং ওই দেশীয় নাবিকের লেখা “পেরিপ্লাস অফ দি এরিন্থিয়ান সি’’ গ্রন্থে এবং
রোমান কবি ভেলেরিয়াস ফক্কাস প্রনীত “অরগানিটিকা’’ কাব্যে। ড.অতুল সুরের
মতে, এই ঘটনাগুলি ঘটেছিল ১৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের সময়কালে। প্রগার্য সেই গঙ্গারিডির হাতপুতুলগুলি প্রথমদিকে হাত পা ছুড়ে দেহের কসরৎ করে কৌতুকরস পরিবেশন করত শুধু। পরে তাল যুক্ত হয়ে তাতে নৃত্য সন্নিবেশিত
হয়। অর্থাৎ পোতলাবাজি পরিনত হলো ”পুতুলনাচে”। কয়েকশতক পরে এই
পুতুলনাচেই নাট্যরস প্রযুক্ত হয়ে তা পালাধর্মী হয়। আগেই বলেছি যে আমাদের
লোকনাট্য আজও একটি সহজাত সামাজিক ও মৌলিক আচরণ, যা কয়েক হাজার
বছরের প্রাচীন এবং পুতুলনাট্য তারই একটি বিচিত্র আর কৌতূকস্নিগ্ধ শাখা।

 

নাট্যগবেষকগণ মনে করেন কেবল পুতুলনাট্য নয়, আমাদের গঙ্গারিডির
খোলামঞ্চের লোকনাট্যই আদি প্রসেনিয়ামহীন গীতবহুল গ্রিক থিয়েটারের উৎস।
তবে থিয়েটার নয়, আমাদের আলোচ্য বস্তু যেহেতু পুতুলনাট্য, তাই প্রসঙ্গে
ফিরি। গঙ্গারিডির বঙ্গপুতুল প্রথমে মিশর ও পরে ইউরোপকে মুগ্ধ করার পরে
স্বদেশে, বিশেষ করে অভিজাতদের সংস্কৃতিচর্চার মূল স্রোতে নীত হয়েছিল।
সম্ভবত সেই প্রথম প্রশাসনের প্রধান স্বয়ং সম্রাটের নজরে আসে শিল্পটি
এবং রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষণায় এর ব্যাপক চর্চা আর ব্যবহার শুরু হয়। ডানে বামে
সুদূর আফগানিস্তান থেকে জাভা-সুমাত্রা, অন্যদিকে উত্তরে কাশ্মীর থেকে
দক্ষিণে কন্যাকুমারী পর্যন্ত যে সুবিশাল রাষ্ট্রীয় মানচিত্র সম্রাট অশোকের
কালে নির্মিত হয়েছিল, তা হয়েছিল মহামতি অশোকের উদ্যোগে তথাগত
বুদ্ধদেবের অহিংসার জীবন আর বাণী প্রচার করে। আধুনিক বৌদ্ধ মহাসংঘ ও
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র ইত্যাদি সূত্রে জানা যায়, এই ধর্ম প্রচারকার্যে কয়েক
হাজার ভিক্ষু ও শ্রমণদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, ছোটছোট পুতুলনাট্যের মাধ্যমে
বৌদ্ধধর্মের মানবকল্যাণী সারাংশ বোঝানোর জন্য। আধুনিক কালের এ্যাজিটেশন-
প্রোপাগান্ডা কর্মসূচি নেওয়া গোষ্ঠীদের মতোই, সেইসব দলে স্বয়ং সম্রাটের
ভ্রাতা-ভগিনী এবং পুত্র-কন্যারাও দায়িত্বে থাকতেন।

 

সত্যি কথা বলতে এটাই ছিল ভারতীয় পুতুলনাট্য কলার সুবর্ণময় যুগ, কারণ খোদ
সম্রাটই শিল্পটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং শিল্পটির ব্যবহারে চূড়ান্ত
কৃতকার্য হয়েছিলেন। তার মানে রাষ্ট্রের প্রয়োজনে, প্রজাকল্যাণে বা সাম্রাজ্য
বিস্তারে নাট্যকলার ব্যবহার - এটা মৌর্যযুগেই প্রথম শুরু হয়। এর পরে আরও
একবার ধর্মের মাধ্যমে সমাজ সংস্কারের কাজে পুতুলকে ব্যবহার করা হয় স্বয়ং
চৈতন্যদেবের দ্বারা। শংকরদেবের আগ্রহে চৈতন্যদেব অসম, সিলেট ও ত্রিপুরা
ভ্রমণে যান। সঙ্গে নেন বড়ু চন্ডীদাসের পুতুলপালা “শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন“।

 

পন্ডিতদের মতে স্বয়ং চৈতন্যদেব এই পালাতে অংশ নিতেন। অশোকের কাল থেকে
প্রাকচৈতন্য যুগটিই হল আমাদের পুতুল নাট্যচর্চার গৌরবময় সময়। এরপরে
সুলতানী আমলে প্রশাসনিক অনাগ্রহে আমাদের জাতীয়সংস্কৃতি চর্চায় নামে এক
অন্ধকারের যুগ। প্রশাসনিক নিষেধাজ্ঞার ফলে চিরকালের অবগুন্ঠনের শিল্প
পুতুলনাট্য আশ্রয় নেয় তার প্রকৃত উৎসভূমি লোকসংস্কৃতির আঁচলের নিচে।
প্রকৃত প্রস্তাবে তারপর থেকে সমাজের মূল স্রোত হতে সরে যায় ভারতের
ঐতিহ্যময় আদিম লোকনাট্যধারা পুতুলনাচ। পরবর্তীকালে নাটক এবং সংস্কৃতির
অন্যান্য রূপগুলি আবার মূলস্রোত বা অভিজাতদের মনোরঞ্জনের জন্য ফিরে
এলেও পুতুল নাটক কিন্তু অদ্যাবধি শিক্ষিত ভদ্রলোকদের কাছে একটি
অত্যন্ত নিম্নবর্গীয়দের সংস্কৃতি হিসাবেই ট্রিটমেন্ট পায়। আজও এলিট সমাজে
উপেক্ষিত আমাদের পুতুল নাট্যকলা ।

 

অর্থাৎ এই দেশ পুতুল চর্চার মাতৃভূমি হলেও, স্বদেশেই আজ বর্ণময় শিল্পটি
অবহেলায় মুমূর্ষু। ইউরোপে শিল্পটি নিয়ে ব্যাপক চর্চা হলেও আমরা পিছিয়ে
পড়লাম কেন? সমস্যা বা সংকটের কীটটি ঠিক কোনখানে বাসা বেঁধেছে? এর
প্রতিবিধানই বা কী? এখানে বিস্তৃত বলার পরিসর নেই। তবে একটু বলা যায় যে,
ইউনেস্কোর মন্তব্য এবং জ্ঞাপনটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। আমরা আমাদের
মানবসম্পদ এবং মহার্ঘ শিল্পসম্পদ সম্পর্কে আদৌ ওয়াকিবহাল বা সচেতন নই।
ফলে শিল্পটি কোনওভাবে আমাদের প্রান্তিক সংস্কৃতিতে তার অস্তিত্ব বজায়
রাখলেও, তা নিয়ে আমাদের মধ্যে কোনও উন্নততর যুক্তিভাবনার প্রতিফলন নেই।
যে ভূখণ্ডে শিল্পটির জন্ম, সেই দেশের এত বড়বড় মেগাসিটিগুলাতে কোথাও
পুতুলনাট্য প্রদর্শনের উপযোগী নিজস্ব নাট্য়মঞ্চ নেই। আমাদের স্কুলকলেজ
বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে তো দুর অস্ত, এমন কী ফলিত শিল্পকলার শিক্ষা
প্রতিষ্ঠানগুলির কোনওটিতেই পুতুল নাট্যকলার কোনও পাঠ্যসূচি নেই। এ দেশের
রাজনীতি সংস্কৃতি সামাজিক মিডিয়া কর্পোরেট, কোনও অংশের মাতব্বরদেরই
পুতুল নাট্যকলা সম্পর্কে কোনও ধারণাই নেই। একটা বিষয় নিয়ে সবাই যার যার মতো
স্বাধীন ভাবে ভাববে, তবে তো তা নিয়ে এগোনো সম্ভব? পুতুলনাট্য নিয়ে আমরা
আদৌ কেউ সামান্যতমও ভাবি না। ফলে সার্বিক এই অসচেতনতার কারণে গোটা
বিষয়টাই এক অনন্তকাল ধরে উপেক্ষার শিকার।

 

‘বঙ্গপুতুল’ নামে একটি সমাজসেবী সংস্থার সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় ও
ক্ষেত্রসমীক্ষায় জানা গিয়েছে বেশ কিছু বিচিত্র তথ্য। জানা গিয়েছে ঐতিহ্যবাহী
পরম্পরার পুতুলনাচের দলগুলির অবস্থা খুবই খারাপ। বিগত ২০/৩০ বছর
অন্তত ৭০ শতাংশ দল উঠে গিয়েছে। উঠে যাওয়ার কারণ একদিকে এই ইন্টারনেটে সস্তার বিনোদনের যুগে,এমনকি প্রান্তিক গ্রামীণ মানুষজনও আর তেমনভাবে
সনাতনী বিনোদন, পুতুলনাচে আকর্ষিত হচ্ছেন না। তাই দলগুলি উঠে যাচ্ছে।
অন্যদিকে, গ্রামীণ উপভোক্তাদের বক্তব্য, ''হাতের সামনে বোতাম টিপলেই যখন
সারা পৃথিবীর আধুনিকতম বিনোদনের আপডেট পাওয়া যাচ্ছে, তখন কেন আমরা
সেই মান্ধাতার আমলের ভারিভাারি পুতুলসহ স্থূল বিনোদনে মজে থাকব?
গবেষকরা মনে করেন এই সকল তথ্যই সত্য, তবে বিষয়টিতে আরও বিস্তারিত
নজরদারি দরকার। কারণ ইন্টারনেট আপাতদৃষ্টিতে পুতুলনাচের বাজার খারাপ
করলেও বিজ্ঞানীরা স্বীকার করছেন যে পুরনো আঙ্গিক নিয়ে কথা উঠলেও
পুতুলনাচের প্রতি মানুষের মনোবৈজ্ঞানিক আকর্ষণ কিন্তু আজও অব্যাহত।
কাজেই এখনি ওয়েস্টবিনে নিক্ষেপ না করে শিল্পটি নিয়ে আরো মনোযোগী হয়ে
বিস্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা দরকার ।

 

এই কথার সুরে সুর মিলিয়ে বঙ্গ পুতুলের ক্ষেত্র সমীক্ষক দীপেন্দু মন্ডল জানালেন,
কেন্দ্রীয সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রকের অধীনে সিসিআরটির দায়িত্বে তাঁরা এই বিষয়ে বিশদ ক্ষেত্রসমীক্ষা
করেছেন। কাজও শুরু করেছেন বারুইপুরের বস্তির এলাকার শিশু-কিশোরদের নিয়ে।
শুনতে আপাতবিরোধী বলে মনে হলেও, এটা সত্য যে পুতুল নাট্যকলা একই সঙ্গে
উপেক্ষিত অথচ প্রবলভাবে সম্ভাবনাময়। পুতুলনাচ আসলে দুই ধরনের দল চর্চা করে চলেছেন। প্রথম দলটি সনাতন বা
পরম্পরায়। এরা বংশানুক্রমে পুতুল নাচান । এরা ট্র্যাডিশনাল । আর এক ধরনের
দল আছে, যারা অপেক্ষাকৃত শিক্ষিত এবং একটু আধুনিক। এরা বিদেশি
পাপেট্রির অনুসরণে দেশীয় পুতুলনাচের সঙ্গে একটু থিয়েটার বিজ্ঞান মিশিয়ে
পুতুল নাচান । এরা হলেন মডার্ন বা কন্টেম্পোরারি পুতুল নাটকের দল। এই
দলগুলির প্রযোজনা অপেক্ষাকৃত উন্নত মানের । রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রীয়
সরকার প্রতি বছরের এই সমস্ত দলগুলিকে নানা খাতে অনুদান ও আর্থিক
সহযোগিতা করে থাকে । কিন্তু,এটাও ঠিক কথা যে অনুদান প্রাপ্তির বিষয়ে
আধুনিক দলগুলি অনেক এগিয়ে। ক্ষেত্রসমীক্ষা থেকে জানা গিয়েছে, প্রাচীন
আঙ্গিক ও বিষয়ের পালাগুলি একঘেয়েমি দোষে দুষ্ট হওয়ায় আকর্ষণীয়তা
হারিয়েছে। চিৎপুরী পালাগানের অনুকরণসর্বস্বতাকে নাকচ করে বরং কনটেম্পোরারি
দলগুলি তাদের ক্রমশ জনপ্রিয় করে তুলেছে।

 

এইসব দেখে শুনে ক্ষেত্রসমীক্ষক বিশেষজ্ঞরা মনে করে্‌ন, পুতুল নাট্যকলাকে পুনরুদ্ধার করা অবশ্যই সম্ভব
যদি তাকে সমকালীন ফর্ম আর কন্টেন্টে বেঁধে ফেলা যায় । এর জন্য উপযুক্ত
সংস্কারকর্ম, তদানুযায়ী প্রশিক্ষণ আর বিষয়টি নিয়ে আমজনতা থেকে
অভিজাত সকল স্তরের মানুষ জনের কৌতূহল তথা সচেতনতা দরকার। তারা
বলেন, ''শুধু পুতুলশিল্প নয, বিষয়টি নিয়ে এগিয়ে আসা দরকার দেশের যুবসমাজ
আর ছাত্র-ছাত্রীদের। সরকারের শুধু অনুদান দিয়ে দায়িত্ব সারলে হবে না,
প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষার সর্বস্তরে পুতুল নাট্যের
পাঠক্রম শুরু করা দরকার । এই শিক্ষা যে রুটিরুজিমুখী হতে পারে, এটা
বিশ্বাসযোগ্য করা দরকার। ইউরোপের পাপেট্রি সম্পর্কিত বাস্তব বাতাবরণটি
কিন্তু ঠিক এইরকম। বিশেষ করে জাপান, জার্মানি, সুইডেন এবং রাশিয়াতে
পাপেট্রির বিস্তর কদর। সেখানে একজন পুতুল নাট্যকর্মী সেদেশের ডাক্তার বা
প্রযুক্তিবিদদের থেকে মোটেই কম রোজগার করেন না।

 

সিসিআরটি’র সিনিয়ার ফেলো ও ‘বঙ্গ পুতুল’গোষ্ঠীর সভাপতি সূত্রে জানা গেল,
তারা দক্ষিণ ২৪ পরগনার 'দন্ডপুতুল' আর পূর্ব মেদিনীপুরের 'বেণেপুতুলের' মিশ্রণে
খুব হালকা এক ধরনের পুতুল নির্মাণ করেছেন যা স্কুল-কলেজের
ছাত্রছাত্রীদের মাত্র ১০ থেকে ১৫ দিনের প্রশিক্ষণ দিয়ে বানানো ও চালানো
সম্ভব। ইতি মধ্যে, কোচবিহারের চ্যাংড়াবান্ধা, নদীয়ার চাকদহ ,বাঁকুড়ার রাধানগর
ও উত্তর ২৪ পরগনার চাঁদপাড়াতে , বেশ কিছু পুতুল নাট্যগোষ্ঠী এই নতুন
পদ্ধতিতে হালকা পুতুল নির্মাণ করে সঞ্চালনা করেছেন সাফল্যের সঙ্গে। উনি
জানালেন যে কলকাতার বেশ কিছু নামকরা নাট্যদল তাদের অভিনয়শক্তি বৃদ্ধির
জন্য এই প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন উৎসাহের সঙ্গে। তাদের অভিজ্ঞতায়
মঞ্চ প্রকরণ নির্মাণ, ব্যবহার এবং বাচিক অভিনয়কে সুন্দর বাস্তবানুগ করার
জন্য পুতুলনাট্যের প্রশিক্ষণ পদ্ধতি অনুসরণ করা অত্যন্ত কার্যকরী। অর্থাৎ
পুতুল নাট্যকলা ফের প্রতিষ্ঠা পেলে দেশে যেমন রুটি রুজির সম্ভাবনা উজ্জ্বল হবে,
ঠিক তেমনি সার্বিক সচেতনতাও বাড়বে।

 

যে গৌরবময় শিল্পটি দীর্ঘদিনের অবহেলা উপেক্ষায় মৃতপ্রায় হয়ে ছিল, তার চর্চা অনুশীলন আবারও শুরু হতে পারে।
সংকটগুলিকে যখন খুঁজে পাওয়া গিয়েছে, তখন সমাধানও নিশ্চয়ই আছে । সমাধান
এই জন্যই আছে, কারণ এগিয়ে যাওয়া দেশগুলির দিকে একটু নজর দিলেই বোঝা
যায় যে শিল্পটির আজও চাহিদা বিপুল। তবে এর জন্য দরকার রাষ্ট্রীয়
পরিকল্পকদের পক্ষ থেকে একটি যুক্তিসম্মত বিজ্ঞানভাবনার পূর্ণাঙ্গ
পরিকল্পনা। সরকারি বেসরকারি মিডিয়া থেকে সর্বশ্রেণির সবস্তরের
মানুষদের আগ্রহ আর সচেতনতা । সমাজবিজ্ঞানী আর সংস্কৃতিবিদরা বারবার
বলেছেন যে, শিল্পটির আজও সমানভাবে এই সমাজে ব্যবহারযোগ্যতা আছে ।
সমাজেই তাকে কাজে লাগাতে অদ্যাবধি পরিকল্পনাহীন। সংগীত নাটক
আকাদেমির অন্য একটি গবেষণা সূত্রে জানা গিয়েছে, ভারতবর্ষ যেখানে শিল্প আর
শিল্পীদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য সংগ্রামরত, সেখানে ইউরোপ-সহ পৃথিবীর অন্যান্য অংশের উন্নত দেশগুলি পুতুলের সহযোগিতায় মানবসমাজের উন্নয়ন
ঘটিয়েছে। অর্থাৎ বিজ্ঞানীদের মতে কেবলমাত্র বিনোদন যোগ্যতাই নয়, আধুনিক
মানবিক বিজ্ঞান সাধারণ কাজেও আজ অনিবার্য হয়ে উঠেছে পুতুলের ব্যবহার।

 

পূর্বরেলের দক্ষিণ শাখার বারুইপুর স্টেশনের ৪ নম্বর প্লাটফর্মে ঘেঁষে বস্তি
প্যাটার্নের একচিলতে ঘর। সেখানেই সমাজকল্যাণী সংস্থা ‘ঈক্ষন ‘-এর
কর্ণধার কৃষিবিজ্ঞানী কৌশিক মুখোপাধ্যায়কে পাওয়া গেল । স্থানীয় বসতি
অঞ্চলের কিশোর কিশোরীদের লেখাপড়া আর মানবিক ইতিবাচক বিকাশের জন্য
বিনা খরচে নানাবিধ কোচিং দিয়ে থাকেন তিনি। রবিবারের সকাল। ছেলেমেয়েরা
ইংরেজি বা গণিতের পরে পুতুলনাট্যের প্রশিক্ষণ নিতে এসেছে। বঙ্গপুতুলের পক্ষে
ট্রেনিং দিতে এসেছেন দুই হবু ইঞ্জিনীয়ার কম্পিউটার আর জীববিদ্যার
স্নাতক ঈশব্রত ও দীপেন্দু । এরা সবাই মিলে সুকুমার রায়ের ‘অবাক জলপান’
তুলছে পুতুলনাট্যের মাধ্যমে, বাকি সবাইকে পরিবেশ সচেতনতার বার্তা দেওয়ার
জন্য। কৌশিক জানালেন যে, বস্তি অঞ্চলের নিম্নবর্গীয় টিনএজাররা যে যুক্তি
আর প্রযুক্তির মাধ্যমে এখানে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে, তাতে কমবেশি একমাসের
মধ্যেই তাদের একজন প্রায়-পেশাদারী পাপেটিয়ারে পরিণত করা সম্ভব । এদের
পুতুলনির্মাণ আর সঞ্চালনা পদ্ধতি এতটাই সহজ-সরল আর বাস্তবসম্মত।

পৃথিবীর সর্বক্ষেত্রে ভাল ও মন্দের অবস্থান অনিবার্য । পুতুলনাট্যের
সঙ্গেও তাই । বিষয়টির মধ্যে এখনও বাণিজ্যের গন্ধ আছে বলে, বিনোদন জগতে
আজও আকর্ষণীয় বলে, এখানেও নানান উদ্দেশ্য-বিধেয় বিদ্যমান। সম্ভাবনাময়
এই লোকনাট্য বেষ্টন করেও তাই নানা বিষয়ের মানুষজনের ভিড় । একদল
বণিকমনস্ক মানুষ আছেন যাঁরা এই শিল্পকলাকে সরাসরি বিক্রি করেন.
শিল্পটির সংকটে তাঁরা ভাবিত নন । ব্যবসা তাঁদের মুখ্য উদ্দেশ্য। আর
একদল মানুষ আছেন যাঁদের রুটি রুজি হয়তো ভিন্ন মাধ্যমে । ঐতিহ্যময়
শিল্পটিকে বাঁচিয়ে রাখা, তার উন্নতি, সংকট সমাধানেই তাঁদের বেঁচে থাকা ।
পুতুলনাট্য আসলে একটি ফলিত বা পারফরমিং শিল্পকলা । নিয়মিত চর্চা
অনুশীলন ছাড়া একে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব নয় । যত বেশিসংখ্যক মানুষ এটি চর্চা
করবে, ততই এর বাঁচার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে । তাই কেবলমাত্র ট্র্য়াডিশনাল বা
কন্টেপোরারি পুতুলশিল্পী নয়, আর পাঁচটা সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদেরও ট্রেনিং
দিয়ে, ওয়ার্কশপের মাধ্যমে এই কলাচর্চায় টেনে আনা দরকার । সেই চেষ্টাই
করেছেন কৌশিকরা, বঙ্গপুতুলের পেশাদারী ও দক্ষ প্রশিক্ষকদের কাজে
লাগিয়ে। ভারতবর্ষ তথা পশ্চিমবঙ্গের মোটামুটি চার ঘরানার পুতুলনাচ
প্রচলিত । (১) দস্তানা বা বেণে পুতুল (২) সুতোটানা পুতুল (৩) দণ্ড বা ডাংপুতুল
ও ৪) ছায়াপুতুল । এ ছাড়া শুধুমাত্র দক্ষিণ ভারতে সুতো ও ধাতুর তারের
সাহায্যে এক ধরনের পুতুলনাচ প্রচলিত।

আমাদের বাংলায় এই চার ঘরানার পুতুলই দেখতে পাওয়া যাবে। এর মধ্যে দস্তানা বা
বেণেপুতুলের আদি ঘর হল পূর্ব মেদিনীপুরে পদ্মতামালি গ্রাম। নিজের হাতের
মধ্যে দস্তানার মতো একটি পুতুল ঢুকিয়ে সেখানকার কাহার শ্রেণির মানুষেরা
আজও এই পুতুলনাচ করেন । সুতো টানা পুতুলের আদি বাসস্থান হল রাজস্থান ।
একটি নথি থেকে জানা যায় যে দেশভাগের প্রায় ৫০ বছর আগে রাজপুতানা থেকে
পূর্ববঙ্গের পিরোজপুরের ‘রাধা পাগলের’ মেলাতে এসেছিলেন এক শিল্পী দম্পতি।

তাদের থেকে সুতোপুতুল সঞ্চালনা প্রথমে ওপার বাংলা, পরে এপার বা এপারের
বগুলার নিকটে মুড়াগাছা কলোনিতে থিতু হন প্রায় দেড়শ ঘর পুতুল শিল্পী । একটি
পুতুলের শরীরের নানা অংশ যুক্ত করে শিল্পী পুতুলের ওপরে দাঁড়িয়ে সুতোপুতুল
নিয়ন্ত্রণ করেন। ঠিক এর বিপরীত আচরণে অর্থাৎ পুতুলের নিচে দাঁড়িয়ে সেটা
সঞ্চালনা করা হয় দন্ডপুতুল বা ডাংপুতুলের ক্ষেত্রে । তৎসমে যা দণ্ড সেটাই
কথ্যভাষায় ডাং। পুতুলের দণ্ড ধরে শিল্পীরা এই পুতুলকে
নিয়ন্ত্রণ করেন বলে একে ডাং পুতুল বলা হয়। এই শৈলীর পুতুলটি দক্ষিণ ২৪
পরগনার সুন্দরবন অঞ্চলের নিজস্ব শিল্প।

তথ্যাভিজ্ঞমহল সূত্রে জানা যায় যে, অন্যান্য ঘরানার পুতুলগুলি সারাদেশে
অনুকরণ করা হলেও, সুন্দরবন অঞ্চলের সনাতন দন্ডপুতুল ঘরানাটা কিন্তু
পৃথিবীর অন্যত্র কোথাও প্রচলিত নয়। কথিত আছে ভারতবর্ষে থেকে বৌদ্ধ যুগে
এই পদ্ধতির পুতুলগুলি বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারের কাজে ইন্দোনেশিয়া থেকে শ্রীলঙ্কা
অবধি যাতায়াত করত। ইন্দোনেশিয়ার প্রবীণ পুতুলনাট্য ব্যক্তিত্ব চতুরঙ্গ
মন্ত্রীশাস্ত্রী বলেন, দক্ষিণ ২৪ পরগনার ডাংপুতুল আর তাদের পুতুলনাট্য মূলত
একই ঘরানার শিল্প। এই নানান ধরনের পুতুলগুলি মূলত ট্র্যাডিশনাল বা সনাতন
প্রকরণের । এদের থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই, সামান্য আধুনিকীকরণে
কন্টেম্পোরারি পুতুল নাটক নির্মিত। যা মূলত সনাতন দন্ডপুতুল ঘরাণাকে
অনুসরণ করেছে।

আমাদের পুতুল নাট্যকলার প্রেক্ষাপটটি খুবই উর্বর এবং সম্ভাবনার। দরকার
একটু সর্বস্তরের মানুষের আর এজেন্সিগুলির যুক্তি নির্ভর সচেতনতা এবং
তৎজনিত সহযোগিতার । পুতুল আসলে প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের কল্যাণের
কারণেই পথে নেমেছে । পুতুল যদি অন্ধকার রাতে বর্ষা হাতে মানুষের ঘর পাহারা
দেয়, তাহলে মানুষটি কি তার নিজের ভালোর জন্যই সেই অসহায় পুতুলকে আরও
একটু বুকের কাছে টেনে তোলার জন্য সচেতন হতে পারে না? এটাই দেখার।

  • শুভ জোয়ারদার