শাড়ি বাঙালি নারীর অনেকটা জুড়ে আছে আর তাঁত শিল্পের জন‍্য কেবল গহীন অন্ধকার

‘অনেক রাত্রে গফুর মেয়েকে তুলিয়া কহিল, আমিনা, চল আমরা যাই-
সে দাওয়ায় ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল, চোখ মুছিয়া উঠিয়া বসিয়া কহিল, কোথায়
বাবা?

গফুর কহিল, ফুলবেড়ের চটকলে কাজ করতে’।

১৩২৯ বঙ্গাব্দে ‘বঙ্গবাণী’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের
‘মহেশ’ গল্পটি। আজ অবধি এই গল্পের জনপ্রিয়তায় কোনও গ্লানি আসেনি। গল্পের
একদম শেষে এসে শরৎবাবু জানিয়ে দিলেন পুঁজি এসে কীভাবে গ্রামের এক স্বাধীন
কৃষক সত্ত্বাকে শ্রমিকে রূপান্তরিত করে দিল। আর এই পুঁজির দালাল যেমন জমিদার
তেমনই ধর্মে ধ্বজাধারী তর্করত্নও। আমাদের বিষয় ‘মহেশ’ গল্প নয়, শতাব্দী প্রাচীন
শান্তিপুর ও ফুলিয়ার তাঁতশিল্প। যা আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রায়, শুধু তার কঙ্কালটুকু
দাঁড়িয়ে আছে। যা এককালে ছিল ক্ষুদ্র পুঁজি ও শিল্পসন্মত, তাকে গিলে খেয়ে নিল
বৃহৎ পুঁজি। আগে বলা হত তাঁতশিল্পী এখন বলা হয়, তাঁত শ্রমিক। শান্তিপুরের তাঁত
শিল্পের ইতিহাস নিয়ে বহু চর্চা হয়েছে। কিন্তু তাঁতী ও এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত
অসংখ্য মানুষের কান্না কোথাও লিপিবদ্ধ নেই। এই নিবন্ধে আমরা সেই কান্নাটুকু
ধরবার চেষ্টা করব। খুব বেশি অতীতে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। রবীন্দ্রনাথ তো
বটেই, ঠাকুর পরিবারের কাছে আমাদের বাঙালির ঋণ অশেষ। একদিকে যেমন
রবীন্দ্রনাথের মেজোবৌদি জ্ঞানদানন্দিনী নতুনভাবে শাড়ি পরা শিখিয়েছিলেন
বাঙালি মেয়েদের, যা সেদিন তুমুল জনপ্রিয় হয়েছিল, তেমনই অনেকটা পরে
হলেও সবিশেষ উল্লেখ করতে হয় সুভো ঠাকুর অর্থাৎ সুভগেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম।
দেবেন ঠাকুরের প্রপৌত্র সুভো ঠাকুর ১৯৫৭ সালের আগে-পরে হস্তশিল্পের অগ্রগতির
জন‍্য প্রচুর উল্লেখযোগ্য কাজ করেন। প্রখ‍্যাত তাঁত শিল্পী অক্ষয় দাস-কে
সঙ্গে নিয়ে শুরু করেন Jacquard Weaving, শাড়ির পাড়ের নক্সা তৈরি শুরু হয়
নতুনভাবে। যা সেদিন তাঁতশিল্পে একটি নতুন দিগন্ত খুলে দেয়।

বেঁচে যায় প্রচুর তাঁতশিল্পীর শ্রম-সময়-অর্থ। তাঁর এই কর্মদক্ষতার জন‍্য ভারত সরকার
তাঁকে ‘সর্বভারতীয় হস্তশিল্প বোর্ড’-এর পূর্ব আঞ্চলিক পরিচালক নিযুক্ত করেছিলেন।

দেশভাগ আমাদের সবার হৃদয়ই রক্তাক্ত করেছে নিশ্চিত। তবে আজও
শান্তিপুর-ফুলিয়া এলে শুনতে পাবেন, কোনও পাড়ার নাম নোয়াখালি-ঢাকা-পাবনা
ইত‍্যাদি। আসলে প্রচুর মানুষ এইসব অঞ্চলে তখন আস্তানা গড়েন। তাদের
মধ‍্যে অনেকেই ছিলেন সুদক্ষ হস্ত বা তাঁতশিল্পী। পূর্ববঙ্গের এইসব মানুষের
সহযোগিতায় শান্তিপুর ও ফুলিয়ার তাঁতশিল্প সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। আজ থেকে
আঠারো কিংবা কুড়ি বছর আগেও সজীব ছিল এই শিল্প। কুড়ি-ত্রিশ বা পঞ্চাশ
নয়, মাত্র সাত-আটটি হস্তচালিত তাঁত ও তাঁতীদের নিয়ে কাজ করে অনেকেই
ব‍্যবসা করতেন। এদের বলা হতো মহাজন। একজন তাঁতি যদি সপ্তাহে পাঁচটির
জায়গায় সাতটি কাপড় কাটতেন খুশি হতেন মহাজন। ঘরের মেয়ে-বউ বা বয়স্ক
মানুষেরা চরকায় সুতো কাটতেন; হয়তো খুব বেশিকিছু নয়, তবে সামান্য হলেও
নিয়মিত উপার্জন ছিল তাঁদের। চরকায় সুতো কাটার পরের পর্ব ছিল ড্রাম
মেশিনের। ড্রাম মেশিন বসিয়ে বা চালিয়ে ভালই উপার্জন হতো অনেকের। আজ
সবই অতীত। আগে শান্তিপুর বা ফুলিয়াতে বেড়াতে এলে, হস্তচালিত তাঁতের
খটাস-খট শব্দ শোনা যেত, এখন সেসবও অতীত। মাঠা বা জ‍্যাকেট সেইসব
তাঁত এখন বিরলপ্রায়। হস্তচালিত তাঁতের স্থানে বেশ কিছু বছর আগে এল
পাওয়ার লুম। পঞ্চাশ থেকে আশি হাজার টাকা দিয়ে প্রচুর মানুষ এইসব লুম
স্থাপন করলেন ও, কিন্তু তখনও তারা মনে হয় বুঝতে পারেননি, কী কালো দিন
আসতে চলেছে সামনে। যেখানে একজন হাতে একটি শাড়ি তৈরি করতে সময় নিতেন
এক বা দেড় দিন, সেখানে পাওয়ার লুম পাঁচটি শাড়ি তৈরি করতে লাগল। একসময়
অতীত হয়ে গেল পাওয়ার লুমও। এল রেপিয়ার মেশিন, এই মেশিন আরও সহজে
কম শ্রম ও অর্থে আরও বেশি উৎপাদন শুরু করল। দীর্ঘদিন হস্তচালিত
তাঁতশিল্পের সঙ্গে যুক্ত আছেন অঞ্জন বিশ্বাস, আমাদের জানালেন –‘হস্তচালিত শাড়ির বাজার প্রায় নেই বললেই চলে, তার প্রধান কারণ হল-
একটি হস্তচালিত শাড়ি উৎপাদন করতে যে অর্থ ব‍্যয় হয়, তার থেকে অনেক কম খরচে মেশিনে শাড়ি তৈরি হচ্ছে। ফলে বাজারে ওরা কম দামে শাড়ি বিক্রি
করতে পারছে। এখন মানুষ যদি দেড়শো টাকায় শাড়ি পায়, তাহলে কে ছ'শো টাকা
দিয়ে শাড়ি কিনবে? বস্ত্র ব‍্যবসায়ী ও বিভিন্ন হাটে শাড়ির স্টল দেন তরুণ
দত্ত। ওর কথায়-‘ এখন প্রতিটি কর্পোরেট সংস্থা এই শাড়ির ব‍্যবসায় ঢুকে
পড়েছে, তার ফলে ক্ষুদ্র পুঁজি নিয়ে আমরা যারা ব‍্যবসা করি আর পেরে উঠছি
না। ওরা যে রেটে প্রোডাকশন করবে বা শাড়ি বেচবে, আমাদের পক্ষে কার্যত
তা অসম্ভব। যে কোম্পানি সুতো তৈরি করে, সে যদি শাড়ি তৈরি করে, তাহলে
আমরা কেন কেউ এঁটে উঠতে পারবে না। যেখানে-যেখানে শাড়ি সম্পর্কিত
ব‍্যবসা আছে, এই বৃহৎ পুঁজির অনুপ্রবেশে সবাই সমস‍্যায় ভুগছে। আমরা
হাটে বসে ব‍্যবসা করি, সেখানেও দেখছি মানুষ কম দামে শাড়ি কিনতে চাইছে।
যেটা যন্ত্রচালিত তাঁতের শাড়ি। হস্তচালিত শাড়ির বাজার প্রায় নেই বললেই
চলে’।

এখন প্রচুর বেকার ছেলেমেয়ে অনলাইন শাড়ির ব‍্যবসাকে পেশা হিসাবে বেছে
নিয়েছে। সেখানেও তীব্র প্রতিযোগিতা। অনলাইন শাড়ির ব‍্যবসার সঙ্গে
দীর্ঘদিন যুক্ত সোমনাথ ভট্টাচার্য। সোমনাথের গলায় যদিও একটু ভিন্ন সুর
শোনা গেল-‘শান্তিপুর ও ফুলিয়াতে অনলাইন ব‍্যবসার সূচনা হয় মূলত ২০১২
সালের পর থেকে। মূলত দু'টি ভাবে এই ব‍্যবসা শুরু হয়। প্রথমটি B2B যেমন
Amazon, Flipkart-এইসব প্ল‍্যাটফর্মকে মেঝে রেখে শাড়ি বিক্রি, এই পদ্ধতিতে
আমাদের মুনাফা কম থাকত। তারপর সামাজিক মাধ্যম YouTube ও Facebook-এর
হাত ধরে শুরু হয় B2C পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে আমরা সরাসরি ক্রেতাকে মাল
সরবরাহ করতে পারছি। এই অনলাইনের ব‍্যবসার জন‍্য ফুলিয়া- শান্তিপুর
Reach Attraction-এর কেন্দ্রবিন্দু। একটু যদি আগের কথা বলি, ২০১৯ সালের
মার্চ মাসের পর যখন কোভিড-এর ফলে সবকিছু বিপর্যস্ত, এই ব‍্যবসা
আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছিল। সবথেকে বড় কথা এই ব‍্যবসা প্রথমে খুব স্বল্প
পুঁজি অথবা ভাল মহাজন পেলে পুঁজি বিহীন ও শুরু করা যায়’।

এই লেখাটির শুরুতে এসেছিল ঠাকুর পরিবারের কথা, শেষেও একবার ফিরে তাকাই-
ভারতের প্রথম আই সি এস সত‍্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন মুক্তামনা মানুষ।

স্বভাবতই তিনি চাননি তার স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী পর্দার নীচে থাকুন। কিন্তু
এতো যে-সে পরিবার নয়। ঠাকুর পরিবারের বধূ যে বাইরে বার হবেন, কী হবে
তার পোশাক? সত‍্যেন্দ্রনাথ ফরাসি দোকান থেকে যে পোশাক এনে দিয়েছিলেন,
তা যে বিশেষ সুবিধার হয়নি সে কথা জ্ঞানদানন্দিনী নিজে লিখেছেন। সেকালে
মেয়েদের তো অন্তর্বাস বা জুতো পরারও চল ছিল না। তা হলে সমাজের
মূলস্রোতে নেমে কী পোশাক পরে মেয়েরা কাজ করবে? মুম্বইয়ে থাকাকালীন
জ্ঞানদানন্দিনী পারসি পরিবারের সঙ্গে মেলামেশার সুবাদে ওদের স্টাইল-এর
সঙ্গে নিজের বোধ লাগিয়ে নতুন একধরনে শাড়ি পরার উপায় বের করেন।
‘ঠাকুরবাড়ির শাড়ি’ বা ‘বোম্বাই দস্তুরের’ সেসময় বেশ বাজার ছিল। তবে শাড়ির
কথা বলতে গেলে কেশবচন্দ্রের মেয়ে সুনীতিদেবীর নাম বলতেই হবে। শাড়ির
সঙ্গে সায়া, ব্লাউজ এই রীতি সুনীতিদেবীরই ভাবনা। সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে
পালটাচ্ছে পোশাক ভাবনা। তবে আজও উৎসব-অনুষ্ঠানে শাড়ি বাঙালি নারীর
অনেকটা জুড়ে আছে আর তাঁত শিল্পের জন‍্য কেবল গহীন অন্ধকার।

  • সুদীপ চক্রবর্তী
  • শান্তিপুর ও ফুলিয়া-র তাঁত শিল্প