এই মেরুদন্ডই কমিউনিস্ট পার্টি এবং রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে সুচিত্রা পেয়েছিলেন

আর অল্প ক'টা দিন পরে তাঁর এই পৃথিবীর ধুলোকণা মাখবার সূচনা পর্বের শতবর্ষের শুরুয়াত।  ১৯ সেপ্টেম্বর ১৯২৪ সালে গঞ্জাম রেলস্টেশনে এক চলন্ত রেল গাড়িতে তাঁর জন্ম। বারবার বলতেন;  চলন্ত গাড়ির গতি জাড্যই বোধহয় তাঁকে কখনও স্থির হতে দেয়নি। জীবন মানে থমকে যাওয়া নয়।  জীবন মানে উপনিষদের সেই বাণী; চরৈবেতি। এগিয়ে যাও। এগিয়ে যাও। গোটা জীবন ধরে সেই এগিয়ে যাওয়াকে আত্মস্থ করা মানুষ। যাঁকে অনেকে রবীন্দ্র মন্ত্র উচ্চারণের ক্ষেত্রে একটা সময়ে কিছুটা রক্ষনশীল বলেই মনে করে নিয়েছিলেন। সেই মানুষটি কিন্তু জীবন উপান্তে ,বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির, সঙ্গীতের, সংস্কৃতির উপর নবতম সংযোজন ঘিরে ছিলেন মুক্তকণ্ঠে প্রশংসাবাহী  এক ব্যক্তিত্ব । যে মানুষটি তখন উচ্চারণ করেছিলেন, গুরুদেবের গানে সিন্থেসাইজার ব্যবহার ঘিরে তাঁর কোনওরকম আপত্তি না থাকবার কথা।
তাঁর সঙ্গীত গুরু আচার্য শান্তিদেব ঘোষ, যিনি গুরুদেবের পায়ের কাছে বসে তাঁর মন্ত্রগুলি অন্তস্থ করেছিলেন। সেই শান্তিদার কাছে গুরুদেবের মন্ত্র উচ্চারণের ক্ষেত্রে দু'টি হাতকে হারমোনিয়াম সহ কোনA যন্ত্রের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখার ব্যাপারে ছিল যথেষ্ট নৈব্যক্তিক একটা ধারণা। আসলে গুরুদেবের গানকে শান্তিদার কাছে মনে হয়েছিল, সাধনার একটি মাধ্যম। অনেকটা যেন বাউলদের গুপ্ত সাধনার মতো। শান্তি বাউল তাই তাঁর 'বাওড়া' জীবনের ইষ্ট মন্ত্র, রবীন্দ্রনাথের গান যখন জপমন্ত্রের মতো উচ্চারণ করতেন, তখন তাঁর কোনও মানুষের সংস্পর্শে আশা ঘিরে ছিল একটা প্রবলতম আপত্তি । আমরা যাঁরা শান্তিদার রেওয়াজ  শুনবার পরমতম সৌভাগ্যের অধিকারী, আমাদেরও লক্ষণ রেখা ছিল তাঁর রেওয়াজ ঘরের বাইরে, মাটির দাওয়ায়  বসে বসে সেই গান শোনা।
শান্তি দা বলতেন,  গুরুদেবের গান গাইবার সময় আমি কারও মুখ, সে আমার যত প্রিয়তম মানুষই হোক না কেন, দেখলে পরে নিজের আত্মস্থ চেতনা থেকে যেন একটা কোথায় সরে যাই। তাই শান্তিদা যখন রেওয়াজ করতেন, তখন তিনি ছিলেন আত্মমগ্ন এক ঋষি। শান্তি দা  তাঁর প্রিয়তম শিষ্য সুচিত্রাকে ঘিরে অনেক সময় বলতেন ; আমার গুরুদেবের গান নিবেদনের ভাবময়তা থেকে একটা আলাদা আঙ্গিক সুচিত্রা তৈরি করেছে।
আজকের দিনে যখন গুরু -শিষ্যের সমন্ধ এবং সম্পর্ক  একটা মেকানিক্যাল ধারায় পরিচালিত হচ্ছে,  তখন একজন গুরু, তাঁর শিষ্যের সাধন এবং সেই সাধনার ধারাবাহিকতার ব্যতিক্রমী এবং মৌলিক দিকটা মুক্তকন্ঠে স্বীকার করছেন --এমনটা বোধহয় সেকাল-একাল -কোনও কালে, এমনকি ভাবি কালেও দেখতে পাওয়া যাবে না ।
সুচিত্রা মিত্র  শততম জন্মদিনের  কয়েকটা মাস আগে, আজ সেই অনন্য সাধারণ শিল্পীর কথা মনে পড়লে আমাদের বারবার মনে হয়, অন্নদাশঙ্কর রায় যে অর্থে গুরুদেবকে জীবনশিল্পী বলে তাঁর কপালে কালের অভ্রান্ত টিপছাপ এঁকে দিয়েছিলেন, এই টিপছাপ, সুচিত্রার ক্ষেত্রেও বিশেষভাবে প্রযোজ্য। রবীন্দ্রনাথের গানে যথার্থ জীবনশিল্পী বলে যে হাতে গোনা কয়েকজনকে সর্বজনমান্যতা দিতে পারা যায়, শান্তিদেব ঘোষ, সুবিনয় রায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, কলিম শরাফি প্রমুখ, তাঁদের সঙ্গে একই বন্ধনীতে উচ্চারিত এক চির শ্রদ্ধেয় নাম সুচিত্রা মিত্র।
ব্যক্তি জীবনের ঝড়ঝাপটা সামলাতে সুচিত্রার কাছে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একান্ত আপনার জন্য। ব্যক্তি জীবনে তিনি যত যন্ত্রণায় বিদ্ধ  হয়েছেন, তত বেশি করে তাঁকে স্নাত করেছেন রবীন্দ্রনাথ ।খুব আত্মস্থ ভাবে যদি সুচিত্রা কন্ঠের রবীন্দ্র মন্ত্র গুলি আজ আমরা শুনি, তাহলে আজও আমাদের মনে হবে ,এক একটা স্লাইডের পর স্লাইড চলে যাচ্ছে। যেখানে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা চিন্তা, চেতনার আরোহীনি সুচিত্রার অনবদ্য উপস্থাপনার মধ্যে দিয়ে আমাদের সামনে ফুটে উঠছে।
অনেকটা কবীর  সুমনের , 'খাতা দেখে গান গেয়ো না ,উল্টে খাতা যেতেও পারে'-র মতো করে, নিজে এবং ছাত্র-ছাত্রীদের রবীন্দ্রনাথকে আত্মস্থ করে তারপর তাঁকে উপস্থাপিত করবার উপদেশ দিতেন সুচিত্রা। যদি কোনও ছাত্র বেশ কিছুদিন শিক্ষানবিশি থাকবার পরেও গীতবিতান বা নিজস্ব ডায়েরী বা খাতা খুলে রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে যেতেন , সুচিত্রা খুব অসন্তুষ্ট হতেন।
যেন সেই প্রাচীন ভারতের গুরু  পরম্পরার, শ্রুতি পরম্পরার মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে আত্মস্থ না করে ,তাঁকে উপস্থাপিত করবার ক্ষেত্রে খুব বেশি রকমের দ্বিধা ছিল সুচিত্রার। সংগীত পরিবেশনের ক্ষেত্রে ঠিক রবীন্দ্রনাথের মতোই রবীন্দ্রনাথের গান ঘিরে সুচিত্রার মধ্যে ছিল একটা অদ্ভুত খুঁতখুঁতেপনা ছিল । পারফেকসনিস্ট হিসেবে গানকে উপস্থাপিত করবার ক্ষেত্রে সুচিত্রার যে নিষ্ঠা, সেটা তাঁর জীবনের প্রথম দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত বজায় ছিল । আর সেই নিষ্ঠা পালনে  তাঁর কাছে খুব বড় রকমের ভূমিকা পালন করতো, 'উচ্চারণ' ।
মনে আছে ,একবার একটি মহলাতে অতি উৎসাহ ভরে ,'আহ্বান' শব্দটি কে 'আহবান'  বলে উচ্চারণ করেছিলাম। সুচিত্রা যখন একটু রেগে যেতেন  বিশেষ করে পছন্দের মানুষজনদের রবীন্দ্রনাথ নিবেদন সম্পর্কে একটু বিরক্ত হতেন, দুঃখ পেতেন, তখন সেই ব্যক্তিটি কে ' তুই'  এর বদলে,' তুমি ' করে বলতেন ।
আর সুচিত্রা যখন ,'তুমি'  করে বলছেন, তখনই বুঝতে পারে যেত কোথাও একটা ত্রুটি ঘটছে বড় রকমের । 'আহবান' উচ্চারণ শুনে যখন উনি বললেন ,'অত পাকামি মেরে দরকার নেই তোমার। 'আহ্বান'ই  উচ্চারণ  কর।'
তখন বুঝতে পেরেছিলাম ,রবীন্দ্রনাথের গানে 'সন্ধ্যা'  আর 'সোন্ধ্যা' উচ্চারণের ক্ষেত্রেও যে পারফেকসনিজম সুচিত্রা চিরকাল দেখিয়ে গিয়েছেন, সেটা কত সাধনার দ্বারা তিনি আত্মস্থ করেছিলেন।
'শ্যামা'  চিত্রনাট্যে ভৈরবী রাগিনীতে রবীন্দ্রনাথ সংযুক্ত করেছিলেন একটি গান। 'জীবনে পরম লগন  কোরো না হেলা/  হে গরবিনী '  তিনি কবি অমিয় চক্রবর্তীকে লেখা একটি চিঠিতে বলছেন ; "এই গরবিনীকে সংসারে দেখেছি বারম্বার। কিন্তু গানের সুর শুনলে বুঝবে এই' বারম্বারে'-র অনেক বাইরে সে চলে গিয়েছে । যেন কোন্  চিরকালের গরবিনীর পায়ের কাছে বসে মুগ্ধ মন অন্তরে অন্তরে সাধনা করতে থাকে। সুরময় ছন্দোময় দূরত্বই তার সকলের চেয়ে বড়ো অলংকার। এই দূরবিলাসী গাইয়েটাকে অবাস্তবের নেশাখোর বলে অবজ্ঞা কর, এই গরবিনীকে  যদি দোক্তা খেয়ে পানের পিক ফেলতে দেখলে তবেই তাকে সাঁচ্চা বলে মেনে নিতে পারো,  তবে তা নিয়ে তর্ক করব না -- সৃষ্টিক্ষেত্রে তারও একটা জায়গা আছে,  কিন্তু সেই জায়গা দখলের দলিল দেখিয়ে আমার সুরলোকের গরবিনীকে উচ্ছেদ করতে এলে আমি পেয়াদাকে বলব , 'ওকে তাড়িয়ে তো কোনও লাভ নেই, কেননা ,আঁচলে পানের পিকের ছোপ -লাগা মেয়েটা জায়গা পেতে পারে এমন কোনও ঘোর আধুনিক ভৈরবী  রাগিনী হাল আমলের কোনও তানসেনের হাতে আজও তৈরি হয় নি ।' "
রবীন্দ্রনাথের এই উপমা যেন শিল্পী সুচিত্রা, ব্যক্তি সুচিত্রা, মানুষ সুচিত্রা-- সবকিছু মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় ।
রবীন্দ্রনাথের  বলেছিলেন ," যখন বাস্তব সাহিত্যের পাহারাওয়ালারা আমাকে তাড়া করে তখন আমার পালাবার জায়গা আছে আমার গান ।" ( ঐ)
আমাদের জীবন যন্ত্রণার সমস্ত দুঃখ-কষ্ট ভুলে থাকবার মন্ত্র তো রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছিলেন। সেটিই তো আধুনিক সমাজের বেদ -পুরাণ- কোরআন -ত্রিপিটক -বাইবেল। আর সেই মানব মন্ত্রের ধ্বনি প্রতিধ্বনির মধ্যে দিয়ে জীবনে গ্রেসনোটকে, জীবনে যোগ করে যে মানুষটি, গোটা জীবন ধরে উপস্থাপিত করে গেলেন, আর ক'টা দিন পরই তিনি পদার্পণ করবেন ১০০ বছরে ।
জীবনে যন্ত্রনা সুচিত্রা কম পান নি।তাঁর নিজের কথায়, তাঁর স্বামী ধ্রুব মিত্র সম্পর্কে তার মূল্যায়ন ছিল; ধ্রুবর ধর্মে বিশ্বাস ছিল না। গীতায় আস্থা ছিল ।
এই ধ্রুবই যখন ক্যান্সার আক্রান্ত ,তখন প্রাক্তন স্ত্রী হিসেবে নয়। বন্ধু হিসেবে যেভাবে তাঁর  পাশে সুচিত্রা দাঁড়িয়েছিলেন, খুব কম মানুষই তা খোঁজ রাখেন। খুব কম মানুষই তার খবর রাখেন।
 আসলে নিজেকে বিজ্ঞাপিত করে সেই শঙ্খ ঘোষের কবিতার মত ,'মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে '-- এটা তো সুচিত্রার চরিত্রের সঙ্গে কখনও যেত না ।তাই যখন দেবব্রত বিশ্বাসকে নিয়ে লেখা নাটকে সুচিত্রা কে অনৈতিকভাবে, অসত্যভাবে ব্যঙ্গ করা হল, তখন প্রায় জীবন উপ্রান্তে তিনি পৌঁছে গেছেন। কথাগুলো তাঁর কানে উঠলেও রাজেন্দ্র নন্দিনীর মতোই সেগুলি উপেক্ষা করবার মতো মেরুদণ্ড সুচিত্রার  ছিল। এই মেরুদন্ডটাই পারিবারিক পরিমন্ডলের বাইরে কমিউনিস্ট পার্টি এবং রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে সুচিত্রা পেয়েছিলেন।

  • গৌতম রায়