দ্বাদশ অধ্যায়
‘প্রতাপের রাজপাট মানসিংহে খায়।
রায়ের দৌলত রায় রায়েতেবিলায়’।।
গতকাল সন্ধ্যায় সুজাতার প্রশ্নের উত্তরে মনোময় এই দুটো লাইন বলেছিলেন। এই দুই লাইন যে মনোময় ‘শ্যামরায়মঙ্গল’-এ পেয়েছেন সে কথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু সুজাতা তাঁর করা প্রশ্নের সাথে এই দুই লাইনের কী সম্পর্ক বুঝতে পারেন নি। মনোময়কে বারবার রিকুয়েস্ট করেও এর উত্তর পান নি। শেষে অভিমান টান করে থেকেছেন, কিন্তু মনোময় মৌনভঙ্গ করেন নি।
আজ সকালে চা খেতে বসে সুজাতার মানভঞ্জন করার জন্য মনোময় বললেন,
‘কুমার রাঘব রায় বিগ্রহ লৈয়া যায়
রাঘবে লৈল রত্নধন।
মেলেচ্ছ ভাব হৈতে সুদূরে সকল লৈতে
মর্দনা হৈল প্রদর্শন’।।
সুজাতার মানভঞ্জনের বদলে উল্টো ফল হল। চায়ের কাপ-প্লেট টেবিল থেকে তুলে নিয়ে রাগ করে চলে যাওয়ার সময়ে সুজাতা বলে গেলেন, ‘বেশি কায়দা করলে না খেয়ে অফিস যেতে হবে, বলে দিলাম’।
‘আহাহা, আমার বউ তো কেবল সুন্দরী নয়, সে বিদুষীও। শ্যামরায়মঙ্গল থেকে বলছি লাইনগুলো। ব্যাখ্যা তুমি করে নেবে জানি তো’।
‘বেশি ঢং করবে না বলে দিলাম কিন্তু’, সুজাতার রাগ কিছুটা হলেও কমেছে বোঝা গেল।
‘আচ্ছা আচ্ছা, বসো দেখি দু’মিনিট’, মনোময় উঠে গিয়ে সুজাতার হাত ধরে টেনে এনে বসিয়ে দিয়ে বললেন, ‘দেখ, প্রতাপাদিত্য ব্যবহার না করলেও বসন্ত রায়ের পুত্রেরা সকলেই ‘রায়’ উপাধি ব্যবহার করতেন। গোবিন্দ রায় পিতার সাথেই মারা গিয়েছিলেন। বেঁচে ছিলেন কচু রায়, চাঁদ রায়। যশোরের মূল অংশের ভাগ পেয়েছিলেন চাঁদ রায়। আর সরশুনার দিকের অংশটি পেয়েছিলেন কচু রায়। রায়দের সম্পদ রায়দের মধ্যেই ভাগ বাটোয়ারা হয়েছিল’।
‘ব্যাস, এইটুকুই ?’, সুজাতা যেন ঠিক খুশি হন নি।
‘আমি জানতাম যে আমার বিদুষী গিন্নি ঠিকই ধরে ফেলবেন’, বউয়ের সাথে ফ্লার্ট করলেন মনোময়।
‘ন্যাকামি ছেড়ে কাজের কথায় এসো তো’, সুজাতা পাত্তাই দিল না যেন ঠিক।
‘লক্ষ্মীকান্ত বা জয়ানন্দ, এঁরা মজুমদার উপাধি পেলেও এঁদের বংশধরেরা সব্বাই ‘রায়’ উপাধি ব্যবহার করছেন। প্রতাপাদিত্যের দৌলত এই রায়েরাও পেয়েছিল। হরিদাসের মঙ্গলকাব্য এই ইঙ্গিতই দিচ্ছে। এই কারণেই আমি উত্তরপাড়ায় সাবর্ণদের, অর্থাৎ রত্নেশ্বর রায়েদের বিষয়ে খোঁজখবর করতে আগ্রহী’।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সুজাতা বলে উঠলেন, ‘যাই, অফিসের রান্না দেখি গে। তবে আমার যেন মনে পড়ছে তোমার কচু না ঘেঁচু রায়ের আসল নাম ছিল ‘রাঘব রায়’। তোমার পরের পঙক্তিগুলো কি সেইদিকে ইঙ্গিত করছে ?’
কচুর সাথে ‘ঘেঁচু’ সুজাতা ইচ্ছে করে জুড়ে দিয়েছেন। সেটা বুঝেই মনোময় বললেন, ‘এক্সেলেন্ট ! জানতাম তুমি ঠিক ধরবে। তাহলে দাঁড়াল যে রাঘব অর্থাৎ কচু রায়ের কাছেই বিগ্রহ এবং ধনরত্ন এসেছিল। একচুয়ালি এটাই হবার কথা। কারণ জাহাঙ্গীরের কাছে সশরীরে গিয়ে প্রতাপের বিরুদ্ধে তিনিই দরবার করেছিলেন। কচু রায় মানসিংহের সাথেই এসেছিলেন। এমনকি যুদ্ধে অংশগ্রহণও করেছিলেন। ‘সুদূরে সকল লৈতে’ থেকে অনুমান করতে পারি আদি যশোরের রাজধানী থেকে অনেকটা দূরে সরশুনার রায়গড়ে কচু রায় অনেক ধনসম্পত্তি নিয়ে এসেছিলেন। বেশ মর্দানের মতই অর্জন করেছিলেন। তবে এই ধনরত্নের ভাগ অন্যান্য রায়েরাও পেয়েছিলেন। এখান থেকে একটা জিনিস আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল, সুজাতা’।
‘কী ?’
‘আমি প্রথমে ভেবেছিলাম যশোর অঞ্চলে খোঁজখবর নেব রাজিয়ার সাহায্য নিয়ে। তোমার রাজিয়াকে মনে আছে তো ? বাংলাদেশ প্রত্নবিভাগের অফিসার ?’
‘তোমার ঐ ‘রসরত্নাকর’-এর সুন্দরী প্রত্নতাত্ত্বিক তো ? হ্যাঁ মনে আছে’।
সুজাতার জবাব খুব যে সরল নয় মনোময় বুঝলেন। এর কারণ কী গতকাল রাত থেকে চলে আসা অভিমান পর্ব, নাকি মহিলা মনস্তত্ত্ব ? মহিলাদের মনস্তত্ত্ব খুব যে ভালো বোঝেন মনোময়, এমন নয়। তারা সময় সময় অতিরিক্ত পজেসিভ হয়ে ওঠেন। দুই সমতুল্য নারী কখনই যেন ভালো বন্ধু হয়ে উঠতে পারেন না। সে সৌন্দর্যের বিচারে হোক বা বিদ্যাবুদ্ধিতে। এক দ্বন্দ্ব, এক অসূয়া যেন কাজ করে। তার উপরে যদি স্বামী বা প্রেমিকের উপরে অধিকারের প্রশ্ন আসে, তাহলে তো কথাই নেই। মনোময় ওসব ঝুটঝামেলার ধারকাছ দিয়েই গেলেন না। বললেন, ‘প্রতাপের খাজানার হদিশ ওদেশে পাওয়ার সম্ভাবনা কমে গেল হরিদাসের লেখা পড়ে। এবার বাকি রইল গোবিন্দমূর্তির কথা। সেটাও দেখছি রাঘব রায় নিয়েছিলেন বলে বলা হচ্ছে। এই জায়গাটায় জট হয়ে রয়েছে’।
‘কেন ?’
‘আমরা দেখেছিলাম সতীশচন্দ্র লিখেছেন যে গোপালপুর থেকে বিগ্রহ কখন কোথায় কার কাছে গিয়েছিল, সেসব নিয়ে কি কি মোকদ্দমা হয়েছিল, সব বিবরণ। মূর্তি গোপালপুর থেকে পরমানন্দকাটি, সেখান থেকে রামজীবনপুর। সেখান থেকে রায়পুরে অধিকারীদের আবাসস্থলে। তারপরে টাকীর জমিদারের দোলযাত্রায় আনা নিয়ে মামলা। আমি বুঝতে পারছি না যে কচু রায় যদি বিগ্রহ নিয়েই আসবেন তাহলে কয়েকশো বছর ধরে যশোর জেলায় এসব মোকদ্দমা কী নিয়ে হয়েছিল ?’
এই আলোচনা তখন আর বেশিদূর এগোয়নি। বিকেলের দিকে একটু তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বের হয়ে মনোময় চললেন উত্তরপাড়ার দিকে। চাঁদনি চক থেকে সেন্ট্রাল এভিনিউ ধরে শ্যামবাজার। তারপর বি টি রোড ধরে ডানলপ মোড় হয়ে দক্ষিণেশ্বর। সেখান থেকে বালিব্রিজ পার হয়ে জি টি রোড ধরলেই উত্তরপাড়া। একটা বিশাল তোড়ন হয়েছে ঢোকার মুখে। একটু এগোতেই জয়কৃষ্ণ লাইব্রেরী। চৈতালিকে সেখানেই থাকতে বলেছিলেন।
গ্রীষ্মের বিকেল। সন্ধ্যা হতে হতে প্রায় সাতটা। মনোময় এসে গেলেন সাড়ে পাঁচটা নাগাদ। লাইব্রেরীর কাছটা একটু জ্যাম থাকায় চৈতালি আর একটু এগিয়ে ফেরিঘাটের কাছে অপেক্ষা করছিল। মনোময়ের গাড়ি আসতেই দুজনে সামান্য এগিয়ে জি টি রোড থেকে পশ্চিমে ঢুকে মৌসুমী ক্লাবের কাছে এসে দাঁড়াল চৈতালি। এই ক্লাবের পাশেই ‘মেনকা অ্যাপার্টমেন্ট’। ‘সাবর্ণ ভিলা’ নামেই অ্যাপার্টমেন্টটির নাম রাখতে পারত। বাঙ্গালি প্রোমোটারেরা আর শিক্ষিত হয়ে উঠল না কিছুতেই। মনোময় হতাশায় মাথা নাড়লেন।
চৈতালি যার থেকে সাবর্ণভিলার পুরানো ছবি পেয়েছিল তাঁর নাম সূর্য রায়চৌধুরী। তিনি লতায়-পাতায় ছড়িয়ে যাওয়া লক্ষ্মীকান্ত মজুমদারের বংশধর। এইপরিবারের ‘রায়’ উপাধি পাওয়া এবং ‘চৌধুরী’ উপাধি পাওয়ার ইতিহাস রয়েছে।লক্ষ্মীকান্তের প্রপৌত্র কেশব রাম মুর্শিদ কুলি খাঁয়ের সময়ে ‘রায়চৌধুরী’ উপাধি পেলেন। হালিশহর, নিমতা-বিরাটি, উত্তরপাড়া, বড়িষাতে থাকা বংশের একেক জন একেক উপাধি ব্যবহার করে থাকেন।কেউ শুধু রায়, কেউ রায় চৌধুরী, কেউবা শুধু চৌধুরী। আদিতে এই পরিবারের ‘গঙ্গোপাধ্যায়’ উপাধি টি গোঘাটের কয়েকজন ছাড়া আর কেউই ব্যবহার করেনা। সূর্যবাবু চৈতালি দের নিজের ঘরেএনে বসালেন। আদি সাবর্ণভিলার তিনশো মিটারের মধ্যে ওঁর বাড়ি।আশেপাশে জ্ঞাতিগোষ্ঠীদের বাড়িঘরগুলির অনেক গুলিই আজ আর নেই।অনেকেই কলকাতায় বা অন্যত্র চলে গিয়েছেন। ‘হাংরিজেনারেশন’-এর একজন বিখ্যাত কবি মলয় রায়চৌধুরী এমনই একজন ছিলেন।প্রথম জীবনে এখানেই থাকলেও পরে তিনি কলকাতায় চলে যান।
সূর্যবাবু কিছুকিছু কাহিনি শোনাচ্ছিলেন। রত্নেশ্বর রায় যখন উত্তর পাড়ায় এলেন তখন অধিকাংশ এলাকাই ডোবাখানায় ভর্তি।ধীরে ধীরে সেসব ভরাট করে সমতল করা হল।গঙ্গারতীরে মুক্তকেশী কালী মায়ের মন্দির এই পরিবারের তৈরি। এই মন্দিরে রয়েছেন ভদ্রকালী শিব। এই মন্দিরের পূজারী আজও একজন মজুমদার। রত্নেশ্বরের ছিল চার পুত্র। বড় পুত্র রামজীবনের প্রপৌত্র রামহরির গৃহে লর্ড ডালহৌসি এসেছিলেন। এঁরই দৌহিত্র বংশধর হলেন জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়। ইনিও জমিদার। তাঁর নামের লাইব্রেরিটি তাঁরই এক প্রাসাদ। এঁর পুত্র পিয়ারিমোহন মুখোপাধ্যায়ের নামে কলেজ রয়েছে।
সেদিনকার কাহিনি শুনতে মন্দ লাগে না। তবে মনোময় কিছুটা উসখুস করছিলেন। কারণ প্রতাপের গুপ্তধনের কোনো ইঙ্গিতই পাচ্ছিলেন না। একবার দু’বার কবি হরিদাসের কথা বলে বুঝতে পারলেন ‘শ্যামরায়মঙ্গল’ কাব্যটির সম্পর্কে সূর্যবাবু কিছুই জানেন না। সূর্যবাবুর বাড়ি থেকে সামান্য দূরেই তাঁরই জ্ঞাতি অরুণ রায়চৌধুরীর বাড়ি ভাঙ্গতে গিয়ে রত্নদীপেরা পুঁথিটি পেয়েছে। সূর্যবাবুর কাছে পুঁথির প্রাপ্তি নিয়ে কোনো সংবাদই নেই। আসলে রত্নদীপেরা এই তথ্য গোপন রেখেছে। অরুণবাবু সম্পর্কে জানা গেল যে তিনি গত হয়েছেন বছরখানেক আগে। তাঁর পুত্র আমেরিকায় সেটল করে গিয়েছে। পৈত্রিক বাড়িটি প্রমোটিং-এ দিয়েছে সেই পুত্র। ফলে সেই পুঁথি সম্পর্কে তথ্য দেওয়ার কেউই নেই।
মঙ্গলকাব্য সম্পর্কে জিজ্ঞেস করায় সূর্যবাবু বললেন যে নিমতা-বিরাটিতে কৃষ্ণরাম দাস নামে একজন কবি ছিলেন। তাঁদের নিমতার পূর্বপুরুষেরা কবিকে প্যাট্রোনাইজ করেছিলেন। তিনি কয়েকটা নাকি মঙ্গলকাব্য লিখেছিলেন। চৈতালি কৃষ্ণরাম দাসের নাম নোট করে রাখল। শ্যামরায়ের মন্দিরের বিষয়ে প্রশ্ন করায় সূর্যবাবু বললেন, দোলতলায় সেই মন্দির রয়েছে।
মনোময় একথা শুনেই মনে মনে উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। জিজ্ঞাসা করে জানলেন ‘দোলতলা’ নামে জি টি রোডের উপরেই একটি ঘাট রয়েছে। আসলে এই অঞ্চলে গঙ্গার ধারে ধারেই জি টি রোড চলে গিয়েছে। সাবর্ণভিলা থেকে দোলতলার ঘাট কাছেই। সূর্যবাবুকে অনেক ধন্যবাদ টাদ জানিয়ে মনোময়রা চলে এলেন দোলতলার ঘাটে। জি টি রোডের পশ্চিমেই সামান্য দূরেই সেই মন্দিরের সন্ধান পাওয়া গেল। মন্দির একটি নয়, কাছাকাছি দুটি। একই প্রাঙ্গণের দুদিকে দুটি মন্দির। রাস্তার উপরে ভদ্রকালী মায়ের মন্দির। প্রাঙ্গণের ভেতরে শ্যামরায়ের। সেই মন্দিরের গায়ে খোদাই করা দেখা গেল, এই কথা লেখা রয়েছে। ভদ্রকালী নামের জায়গাটির নামকরণের কারণ জানা গেল লেখা পড়ে।
‘এইখানের শ্যামরায়ের বিগ্রহ স্থাপন করছেন শেওড়াফুলির রাজা রাজচন্দ্র রায়। সময়কাল দেখছি শ্যামরায়মঙ্গল রচনার দু বছর বাদে ১৭৬২ সালে। আগে শ্যামরায়ের মঙ্গলকাব্য রচনা করলেন হরিদাস রায়। দু’বছর বাদে শ্যামরায়ের মন্দির তৈরি হল, এই বিষয়টা আমাকে ভাবাচ্ছে হে’, মনোময় বলে ফেললেন।
‘স্যার, সাবর্ণভিলায় শ্যামরায়ের মন্দির আগে থেকেই ছিল। প্রাসাদের বাইরে জনগণের জন্য এই মন্দিরটি করা হয়েছিল পরে। আর অনেক দেবতার সাথে শ্যামরায় রয়েছেন এখানে’।
‘তুমি ঠিক বলেছ, চৈতালি’, মনোময় প্রশংসাই করলেন একপ্রকার।
ইতোমধ্যে সজলের ফোন এল চৈতালির কাছে। কথা শুনে বোঝা গেল সজলও এসে পড়েছে। মনোময় চৈতালিকে বললেন, ‘চল গঙ্গার ঘাটে বসে চা খেতে খেতে কথা বলা যাক। সজলকে ঘাটেই চলে আসতে বলে দাও’।
দোলতলার গঙ্গার ঘাটটি বেশ চওড়া। পাশেই রেস্টুরেন্ট হয়েছে সম্প্রতি। সেখানে না ঢুকে ঘাটের পাশেই এক চায়ের দোকানে গিয়ে বসলেন দুজনে। সূর্য অস্ত গেলেও সামান্য আলোর রেশ রয়ে গিয়েছে গঙ্গার বুকে। ঘাট থেকে পূর্বপাড়ে পরিষ্কার দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী মায়ের মন্দির দেখা যাচ্ছে। মন্দিরের আলোর রেখা পড়েছে নদীর বুকে। চৈতালি একবার হাত জোড় করে মায়ের উদ্দেশ্যে প্রনাম করে নিল।
দোকানদার চা দিতে দিতেই সজল এসে গেল। চায়ে চুমুক দিয়ে মনোময় আজকের অভিযানের তথ্য দিয়ে সজলকে বললেন, ‘বলো, তুমি কী ইনফরমেশন পেলে ?’
‘স্যার, এই রত্নেশ্বর রায় থাকতেন আদিতে হালিশহরে। পরে জমি এক্সচেঞ্জ করে এখানে এলেন। এই রত্নেশ্বরের বংশে হরিদাসই প্রথম কবি নয়। রত্নেশ্বরের জামাইয়ের বংশে ভগবান মুখোপাধ্যায় নামে একজন কবির কথা পাওয়া যাচ্ছে। ইনি লিখেছিলেন,
সুরধনী পশ্চিমতটে গ্রামখানি আছে বটে
স্বর্গতুল্য সুপবিত্র স্থান।
সাবর্ণ চৌধুরী আদি আসিলেন হতে গাঁদি
গোষ্ঠীপতি বড়ই প্রধান।।
স্যার ‘সুরধনী’ মানে তো গঙ্গা, যার পশ্চিমে এই উত্তরপাড়া নামের গ্রামে ‘গাঁদি’ থেকে এসেছিলেন রত্নেশ্বর রায়। তিনি সাবর্ণ চৌধুরীদের মধ্যে একজন গোষ্ঠীপতি ছিলেন। এই গাঁদি হল ব্যারাকপুরের দিকের অঞ্চল। হালিশহর সেখান থেকে দূরে নয়’।
‘বেশ, তারপর ?’, মনোময়মনোযোগদিয়েইশুনছিলেন।
‘রত্নেশ্বরের ছিল চার পুত্র।জ্যেষ্ঠরাম জীবন জমিদারীর পনের আনা ভাগ পেয়েছিলেন। শ্যামরায়ের দোল উৎসবের ব্যায়ভার রামজীবনের উপরে ন্যস্ত ছিল’।
‘এই তথ্য কি তুমি ‘কালীক্ষেত্র কালীঘাট’ বইটিতে পেয়েছ, সজল ?’
‘হ্যাঁ স্যার’।
‘তাহলে বোঝাই যাচ্ছে যে শ্যামরায় উত্তরপাড়ার সাবর্ণ চৌধুরীদের কুলদেবতা ছিলেন’।
‘কেবল উত্তরপাড়া নয়, সাবর্ণদের অন্য শাখাতেও শ্যামরায় পূজা পেতেন’।
‘কিন্তু সজল, আমরা যে অন্য একটা ঝামেলায় পড়ে গেলাম’।
‘কী স্যার ?’
‘প্রতাপাদিত্যের সম্পদের সিংহভাগ পেলেন কচু রায়, মানে রাঘব রায়। কিছু ভাগ পেয়েছিল নিশ্চয়ই লক্ষ্মীকান্ত মজুমদার। লক্ষ্মীকান্তের বংশধর রত্নেশ্বর উত্তরপাড়ায় এসে বিশাল এলাকা নিয়ে বাস করতে শুরু করলেন। তাঁর বংশ ধূমধাম করে শ্যামরায়ের উৎসব পালন করতেন। কিন্তু তাঁরই এলাকায় শেওড়াফুলির রাজা এসে মন্দির কেন বানাতে গেলেন ? শেওড়াফুলির রাজা হলেন জয়ানন্দ মজুমদারের বংশধর। তিনি নিজের বিশাল জমিদারী ছেড়ে সাবর্ণদের জমিদারীতে এসে মন্দির নির্মাণ করবেন কোন যুক্তিতে ?’
সজল এবং চৈতালি মনোময়ের এই কথা শুনে চিন্তায় পড়ে গেল। কিছুক্ষণ বাদে চৈতালি বলল, ‘এই এলাকা আসলে তো শেওড়াফুলির রাজাদেরই ছিল। রত্নেশ্বর রায় বিনিময় করে অর্জন করেছিলেন। হয়তো সেই কারণেই’।
‘বলেছ ঠিকই। তবে এই মন্দির নির্মাণের সালটা দেখেছ ? ১৭৬২ সাল। পলাশীর যুদ্ধ হয়ে গিয়েছে। রত্নেশ্বর রায় এর অনেক আগে এই এলাকার দখল পেয়ে গিয়েছেন। শেওড়াফুলির রাজচন্দ্র রায় অন্য জমিদারের এলাকায় কেন মন্দির বানাবেন বলতো ?’।
‘স্যার, রাঘব রায় নিয়ে আমার কিছু বলার আছে’, সজল আগের সমস্যার আলোচনার মধ্যেই বলে উঠল।
‘কী বল’।
‘কচু রায়ের নাম রাঘব রায় ছিল ঠিকই, কিন্তু হরিদাস তাঁকে ‘কুমার রাঘব’ কেন বললেন ?’
‘আমার মনে হয় রাজা বসন্ত রায়ের পুত্র বলে’, মনোময় বললেন।
‘কিন্তু কাহিনির সময়ে কচু রায় নিজেই পিতার অংশের রাজা হয়ে গিয়েছেন। রাজা রাঘব রায় বিগ্রহ আর রত্নধন নিয়ে গেলেন বলাটা ঠিক হত নাকি ?’
মনোময় কিছুক্ষণ ভেবে টেবে নিয়ে বললেন, ‘কবিরা কী আর সবসময় এতো ভেবে লেখেন নাকি !’
‘স্যার, আমার মনে হয় এটা হরিদাস ভেবেই লিখেছিলেন’, সজল কেমন জানি কনফিডেন্ট হয়ে বলল।
‘তুমি এমন নিশ্চিত হয়ে কিকরে বলছ বলতো ?’
‘স্যার, আপনি আর একজন রাঘব রায়ের কথা ভুলে যাচ্ছেন’।
‘কে বলতো ?’
‘জয়ানন্দের পুত্র রাঘবেন্দ্র রায়। ঘটনার সময়ে তিনি কিছু রাজকুমার ছিলেন। আমি বাঁশবেড়িয়ার বংশতালিকা যোগাড় করেছি, দেখুন স্যার’।
‘ও ডিয়ার, ডিয়ার’, বলে মনোময় সজলকে প্রায় বুকেই জড়িয়ে ধরছিলেন। মুর্শিদাবাদের দত্তবাটির দেবদত্ত থেকে শুরু করে ২৭ জনের বংশতালিকা যোগাড় করেছে সজল। তালিকায় ১৮ তম নাম হল জয়ানন্দ রায়। ইনি মজুমদার উপাধি পেয়েছিলেন। জয়ানন্দের পুত্রের নাম এই তালিকায় রাঘব রায়। ইনি মজুমদার এবং চৌধুরী দুইই।
প্রাথমিক উচ্ছ্বাস থেমে গেলে মনোময় বললেন, ‘রাঘবেন্দ্র রায় যে রাঘব রায় নামে পরিচিত ছিলেন সেটা মাথায় আসে নি। প্রতাপাদিত্যের মৃত্যুর সময়ে তিনি কুমার রাঘব রায়। প্রতাপের সম্পদের ভাগ পিতা জয়ানন্দের হয়ে তিনি সংগ্রহ করেছিলেন। তার বংশধর উত্তরপাড়ায় শ্যামরায়ের মন্দির...... দাঁড়াও তো। চৈতালি, দেখ তো রাস্তার ওপারে যে লোকটা বাইকের সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে তাকে চেনা লাগছে না ?’
চৈতালি একঝলক দেখে নিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ স্যার। লোকটাকে সাবর্ণভিলার সামনে দেখেছি বলে মনে হচ্ছে’।
মনোময় ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে জি টি রোড পার হয়ে উল্টোদিকে গিয়ে লোকটার সামনে পৌঁছে গিয়ে সটান বলে বসলেন, ‘ভাই, আপনি কি আমাদের ফলো করছেন ?’
লোকটি এমন পরিস্থিতির জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। হাত থেকে সিগারেট ফেলে দিয়ে বলল, ‘কই না তো’।
‘সজল আর চৈতালি ইতোমধ্যে লোকটার কাছে এসে পড়েছে। মনোময় বললেন, ‘কিন্তু আপনাকে তো মেনকা অ্যাপার্টমেন্টের সামনে দেখেছি’।
লোকটি আমতা আমতা করে বলল, ‘ওখানে পাশেই একটা ফ্ল্যাট তৈরি হচ্ছে। ভাবলাম আপনারা বুঝি ফ্ল্যাট দেখতে এসেছেন। আমি জমিবাড়ির দালালি করি। ভাবলাম কাস্টমার হবেন হয়তো। তাই’।
মনোময় একদৃষ্টিতে লোকটার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘আপনার ফোন নাম্বারটা দিন। ফ্ল্যাট পছন্দ হলে আপনাকে জানাব’।
লোকটি ধাতস্থ হয়েছে এর মধ্যে। বলল, ‘না স্যার। মনে হচ্ছে না আপনারা কিনবেন বলে। তবে যদি আবার আসেন বলবেন মদন ধাড়াকে খুঁজছেন। লোকজন দেখিয়ে দেবে’। একথা বলেই লোকটি বাইকে স্টার্ট দিয়ে হুশ করে বেরিয়ে গেল