বিয়ের বিদায়লগ্নে গুছিয়ে নিয়েছিলেন বই! বাংলা সাহিত্য-সংসারে আশাপূর্ণা ধরেছিলেন হাল

 

আশাপূর্ণা দেবী ( জুন, ১৯০৯--১৩ জুলাই, ১৯৯৫) বাংলা সাহিত্যের এক বিষ্ময়। প্রথাগত শিক্ষার মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সুযোগ তাঁর ঘটেনি বিশ শতকের সূচনা পর্বের বাংলা,  নানা ধরনের সামাজিক প্রতিবন্ধকতায় সেই বাংলা এবং বাঙালি সমাজ আবদ্ধ হিন্দু- মুসলমান ,উভয় ধর্ম বিশ্বাসের বাঙালি সমাজের মধ্যে নানা ধরনের সামাজিক অবরুদ্ধতা এক ধরনের জঙ্গম ,স্থবির অবস্থা তৈরি করেছে।

সামাজিক আবর্তে এইরকম একটা পরিবেশের মধ্যে বেড়ে উঠেছিলেন আশাপূর্ণা। তবে তাঁর বাড়ি যে সমসাময়িক কালের আর দশটা বাড়ির মতো নানা ধরনের সামাজিক কুসংস্কারে একেবারে আকীর্ণ ছিল,  একথা বলতে পারা যায় না। কারণ ,আশাপূর্ণা সেকালের রীতি অনুযায়ী বেশ ছোটবেলাতেই বিয়ের পর শ্বশুর বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাঁর বাক্সে ভরলেন বেশ কিছু বই।

 এই যে ঘটনা, সেটা কিন্তু সে যুগের প্রেক্ষিতে কোন মামুলি ঘটনা বলে ধরে নেওয়াটা আমাদের ঠিক হবে না। সেটা  এমন একটা সময়, যখন উনিশ শতকের একটা বড় অংশের মানুষের সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক চেতনায় মেয়েরা বই পড়লে অকাল বৈধব্য  ঘটবে-- এই ধারণা থেকে বিশ শতকের বাঙালি   খুব একটা সরে আসেনি

 এই যে ধারণা, তার মধ্যে খুব যে একটা ধর্মীয় বিধি-বিধান কাজ করেছে এমনটা মনে করবার  অবশ্য কোনও কারণ নেই। এই ধারণা তৈরির পেছনে উনিশ- বিশ  শতকের পুরুষশাসিত সমাজ ব্যবস্থার নানা ধরনের সামাজিক বিধি-বিধান এবং প্রতিবন্ধকতাই ছিল সবথেকে বড় দায়ী। এইরকম একটা অবস্থায়, স্কুল কলেজে গিয়ে প্রথাগত শিক্ষার সুযোগ না পেলেও ,নিজের অধ্যাবসায়ের মধ্যে দিয়ে রোকেয়া  বা তাঁর   পূর্ববর্তী ফয়জুন্নেসা বা সমসাময়িক সুফিয়ার মতোই যে নিজের চেষ্টায় ,অপ্রথাগতভাবে  শিক্ষাকে আত্মস্থ করে নিতে পেরেছিলেন আশাপূর্ণা,  সেই যে পরিমণ্ডল, সেটা তাঁর বাড়ির আধা রক্ষণশীল পরিবেশ কোনও বাধা দেয়নি। বরঞ্চ জায়গায় জায়গায় উৎসাহিত করেছিল।

 এটা কিন্তু বিশ শতকের গোড়ার দিকের বাঙালি সমাজের, বিশেষ করে হিন্দু বাঙালি সমাজের, সামাজিক পরিকাঠামো অনুযায়ী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা ঘটনা। অপরপক্ষে এটাও বলতে হয় এই যে, বিয়ের কনে, সাংসারিক জিনিসপত্র বাক্সে  বেঁধে, তার বইপত্রকেও  বাক্সে  বাঁধছে - এই ঘটনাও কিন্তু তাঁর শ্বশুরকূল সম্বন্ধে আমাদের শ্রদ্ধায় মাথা নত করে

 আশাপূর্ণার  স্বামী কালিদাস গুপ্ত ,তাঁর গোটা জীবন ধরে যেভাবে আশাপূর্ণার সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে উৎসাহ জুগিয়ে গেছেন, এই ঘটনাটি কিন্তু বাংলার সাহিত্যের জগতে একটি বিশেষ অবদান হিসেবেই স্বীকৃত হওয়া উচিত। স্বামী কালিদাস বাবুর কাছ থেকে যে পরিমাণ উৎসাহ সহযোগিতা আশাপূর্ণা তাঁর গোটা সামাজিক জীবনে পেয়েছিলেন, সাহিত্যিক জীবনে পেয়েছিলেন, সেটা না পেলে যে পরিপূর্ণভাবে আমরা 'সত্যবতী',' সুবর্ণলতা'-  স্রষ্টাকে সম্পূর্ণ প্রস্ফুটিত হতে দেখতে পেতাম না, একথা আলাদা করে বলবার কোনও প্রয়োজন নেই

 আজকের দিনে দাঁড়িয়ে একটা বিয়ের কনে তাঁর শখের জিনিস বই, শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে, এটা ভাবা কোনও আশ্চর্যের বিষয় নয়। কিন্তু বিশ শতকের সূচনা পর্বের সামাজিক পটভূমিকায় এই ঘটনা যে কতটা বৈপ্লবিক ছিল, তা যাঁরা সেই সময়ে বাঙালি সমাজের আর্থ-সামাজিক -সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল ঘিরে চর্চা করেন তাঁরা খুব সহজেই বুঝতে পারবেন।

 আশাপূর্ণা কিন্তু নিজের লেখনশৈলীকে পরিব্যপ্ত এবং পরিপুষ্ট করেছিলেন সাংসারিক আবর্তের মধ্যে নিজেকে অধিষ্ঠিত করার মধ্যে দিয়েই। আশাপূর্ণার থেকে খানিকটা পরের প্রজন্মের যে সমস্ত বাঙালি লেখিকা কলম ধরেছিলেন, তাঁরা কেবলমাত্র ঘরে নিজেদের আবদ্ধ রাখেননি। ঘর আর বাইরেকে মিলিয়ে মিশিয়ে নিয়েছিলেন। তাঁরা বহু ক্ষেত্রে ঘরের থেকে বাইরেকে দিয়েছিলেন বেশি গুরুত্ব। উদাহরণ হিসেবে মহাশ্বেতা দেবী, সেলিনা হোসেন, রাজিয়া সুলতান বা আরও পরবর্তী সময়ে বাণী বসু, সুচিত্রা ভট্টাচার্য বা সেলিনা হোসেনদের প্রজন্মের  নবনীতা দেবসেন প্রমুখের নাম করা যেতে পারে।

আশাপূর্ণা কিন্তু সাংসারিক পরিমণ্ডলের মধ্যেই নিজেকে আবদ্ধ রেখেছিলেন। সামাজিক প্রেক্ষাপটে খুব একটা নিজেকে পরিব্যপ্ত বা প্রতিষ্ঠিত করবার দিকে তিনি ব্যস্ত হননি। বরঞ্চ বলা যেতে পারে, দু-একটা পুরস্কার বিতরণী সভা-এইরকম খুব নগণ্য কিছু সামাজিক অনুষ্ঠানের বাইরে তাঁকে সভা-সমিতিতেও খুব একটা দেখতে পাওয়া যেত না। সাহিত্যিকদের পরিচিত আড্ডাতেও তিনি খুব একটা সময় কখনও দিয়েছেন, এমনটা শোনা যায়নি। তাঁর নিজের কথাতেই;  রান্নাঘরে খুন্তি নাড়তে নাড়তেই, অবসরে এসে লিখেছি

 আশাপূর্ণা এই খুন্তি নাড়ার অবসরের মধ্যে দিয়েই বাঙালি হিন্দু সমাজ ব্যবস্থার এত গহীনে প্রবেশ করতে পেরেছিলেন যা আজও ভাবলে আমাদের খুব অবাক হতে হয়। এখানে বাঙালি হিন্দুর কথাটা একটু বিশেষভাবে উল্লেখ করলাম এই কারণে যে, আশাপূর্ণা কিন্তু কখনও নিজের অভিজ্ঞতা বা পরিচিতের মাধ্যমে লব্ধ অভিজ্ঞতার বাইরে তাঁর কলমকে পরিচালিত করেননি। বাঙালি মুসলমানকে তিনি খুব একটা দেখবার সুযোগ পাননি। তাই শৈলবালা ঘোষ জায়া যেমন, 'শেখ  আন্দু' মতো অনবদ্য রচনা নিজের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছিলেন, তেমন পথে আশাপূর্ণা হাঁটতে পারেননি।

এটা কিন্তু আশাপূর্ণার কোনও অপরিপূর্ণতা নয়। শৈলবালা পারিবারিক পরিমণ্ডলের দৌলতে বাঙালি মুসলমানের সমাজ জীবনকে দেখবার সুযোগ পেয়েছিলেন। আর দেখবার সুযোগ পেয়েছিলেন বলেই সেই দেখাটাকে' শেখ আন্দু'-এর মধ্যে দিয়ে তিনি পরিব্যপ্ত করেছিলেন। আশাপূর্ণা বাঙালি মুসলমানকে সে ভাবে দেখবার সুযোগ পাননি। তাই কল্পনার  রঙে কলমকে পরিচালিত করা, তেমনভাবেও কিন্তু আশাপূর্ণা একটি বারের জন্যও নিজের কলমকে পরিচালিত করেননি।

 অনেকে আজকাল আলোচনা, সমালোচনার প্রেক্ষিতে আশাপূর্ণা সৃষ্টিতে কেবলমাত্র হিন্দু বাঙালির জনজীবনের বারমাস্যার বিষয়টিকে উল্লেখ করে, বাঙালি মুসলমানের জনজীবনের উল্লেখ না থাকার কথাটাকে টেনে আনেন। কিন্তু তাঁরা আশাপূর্ণার নিজস্ব মনস্তত্ত্বের যে জায়গাটা ছিল, অর্থাৎ ; অভিজ্ঞতার বাইরে একটা শব্দও তিনি লিখবেন না। সেই জায়গা দিয়ে আশাপূর্ণাকে বিচার-বিশ্লেষণের একটুও চেষ্টা করেন না। ফলে অনেকটা অন্ধের হস্তি দর্শনের মতো আশাপূর্ণাকে ঘিরে একটা ভুল মূল্যায়ন করেন।

 আশাপূর্ণা সৃষ্টিকে খুব গভীরভাবে অনুধ্যান করতে হলে আমাদের দরকার  আশাপূর্ণার জীবনটাকেও খুব গভীরভাবে অনুধ্যান করা। তা না হলে আমরা তাঁর সৃষ্টির যে মনস্তাত্ত্বিক দিক, সেটাকে সঠিকভাবে বুঝে উঠতে পারব না। আশাপূর্ণা কিন্তু কখনও নিজের পরিচিত বৃত্তের বাইরে মানুষজনকে নিয়ে নিজের কলমকে পরিচালিত করেননি। উচ্চবিত্তের সমাজকে জানবার সুযোগ তাঁর বিশেষ ঘটেনি। ফলে উচ্চবিত্তের জীবনযাত্রাকে নিয়ে তাঁর লেখালেখি আমরা খুব বেশি পাই না। আশাপূর্ণের উপন্যাস নিয়ে সে যুগে বেশ কিছু সফল চলচ্চিত্র হয়েছে যার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়, উত্তম -সুচিত্রার বহুল আলোচিত 'অগ্নিপরীক্ষা' ছবিটি

 এই ছবিটির ক্ষেত্রে একটা কথাই বলতে হয়, ফিল্মের প্রয়োজনে নায়ক, নায়িকার জীবন ঘিরে যে ধরনের উচ্চবিত্তের একটা মনোলগ আমরা পাই সেখানে, সেটা কিন্তু মূল উপন্যাসের নেই। মূল উপন্যাস কিন্তু মধ্যবিত্তের জীবন কেন্দ্রিক। মধ্যবিত্তের জীবনের প্রেম, হতাশা ,পরিপূর্ণতা, লড়াই সবকিছুই উপন্যাস আছে। স্বাভাবিকভাবেই ফিল্মের প্রয়োজনে ,বক্স অফিস হিট করানোর তাগিদ থেকে পরিচালকেরা নানা ধরনের বিষয়বস্তু ফিল্মে যুক্ত করেন,  যার সঙ্গে বহু ক্ষেত্রে মূল উপন্যাসের যোগাযোগ খানিকটা সীমায়িত হয়ে যায়

 তাই এই দিক থেকে বারবার বলতে হয়, আশাপূর্ণা তাঁর লেখনিকে কখনও নিজের ধ্যান ধারণার বাইরে, যে দুনিয়াটাকে তিনি চেনেন না, সেই দুনিয়ার একটা কল্পকাহিনী দিয়ে কখনও ভর্তি করেননি। সেই কারণেই আশাপূর্ণা সৃষ্টি একদিকে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। আর একদিকে তার মধ্যে সমাজমনস্কতার একটা পাথরে খোদাই চিত্র অঙ্কিত হয়েছে

 আশাপূর্ণার সৃষ্ট  চরিত্রগুলোকে তাই সমসাময়িক যুগে কোনও মানুষের পক্ষেই তাঁর নিজের পরিমণ্ডলের বাইরের কোনও কাল্পনিক চরিত্র বলে একটিবারের জন্য মনে হয় না। আজ একুশ  শতকের দ্বিতীয় দশকের শুরুতে আমাদের বারবার মনে হয়, আজকের সমাজ জীবনের যে বিবর্তন, বিশেষ করে উদার অর্থনীতির ফলে প্রাচ্যের সমাজ ব্যবস্থা, ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থা, বাংলা- বাঙালির জীবন ,ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বা প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে প্রায়ই উলটপালট হয়ে গেছে, সেই নিরিখে বিশ শতকের প্রায় গোটা সময়কালটার সমাজ মনস্কতা, নারীর অধিকার, সমাজে নারীর স্থান, নারী পু-রুষের সম্পর্ক, নারী স্বাধিকারের প্রশ্ন, এই সমস্ত কিছু বোঝার ক্ষেত্রে আশাপূর্ণা একটা মাইলফল।

 বাংলা যতদিন বেঁচে থাকবে, বাংলা সাহিত্য যতদিন বেঁচে থাকবে ,বাঙালি যতদিন বেঁচে থাকবে, ঠিক ততদিনই অমর হয়ে থাকবেন আশাপূর্ণা তাঁর কালজয়ী সত্যবতী সিরিজের জন্য। এই ট্রিলজির মধ্যে দিয়ে, উনিশ আর বিশ  শতকের নারীর ট্রানজিশন অনবদ্যভাবে আশাপূর্ণা দেখিয়েছেন, তা ভাবলে আমাদের বিস্মিত হয়ে উঠতে হয়। এই তিনটি উপন্যাস; প্রথম প্রতিশ্রুতি ,সুবর্ণলতা এবং বকুলকথা, পড়লে যেন আমরা চোখের সামনে উনিশ শতকের বাঙালি মধ্যবিত্ত জীবনের নানা সন্ধি এবং সেখানে নারীর অবস্থান ,পুরুষ শাসিত সমাজ কীভাবে নারীকে অবদমিত করে রাখতে চাইছে , আর সেই অবদমনের মধ্যে থেকেই নারী কীভাবে একটা সম্পূর্ণ আকাশের জন্য আকুলি  বিকুলি করছে,  সে চিত্র আমাদের আজও বিস্মিত করে।

 সাম্প্রতিক অতীতে সুবর্ণলতা ,প্রথম প্রতিশ্রুতি টেলি সিরিয়ালে ফিরে এসেছে। সেই সময় এই টেলিসিরিয়ালগুলোর যে জনপ্রিয়তা, তার নিরিখেই আমরা বুঝতে পারি ,আজও বাঙালি সমাজ, নারী- পুরুষ নির্বিশেষে, উনিশ শতকের মধ্যবিত্ত হিন্দু বাঙালির যে সমাজচিত্র এই ট্রিলজির  মধ্যে দিয়ে আশাপূর্ণা রেখে গিয়েছেন, তার মধ্যে থেকে কেবলমাত্র রসাস্বাদনই নয়, ইতিহাসের উপকরণ খোঁজবার ক্ষেত্রে কতখানি গুরুত্বসহকারে আশাপূর্ণই সৃষ্টিকে দেখেন , তা ভাবলে অবাক হতে হয়।

 ' মুক্তকেশী 'এই চরিত্রটি থেকে সত্যবতী হয়ে সুবর্ণলতার দক্ষিণের বারান্দার জন্য আকুলতা, আর পরিবারের পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে অত্যন্ত মার্জিত কিন্তু দীপ্ত লড়াই। সেই পর্যায়ক্রম কিন্তু পরবর্তীকালে সুবর্ণ কন্যা বকুলের মধ্যে সঞ্চারিত হয়। একটা মুক্তধারার চেতনার প্রবাহমানতা সেটা।

 'সত্যবতী' চরিত্রটি যেন আমাদের কাছে উনিশ শতকের মধ্যবিত্ত বাঙালির গেরস্থ জনজীবন ঘিরে যে সমস্ত আকর গ্রন্থগুলি আছে, যেমন বেগম রোকেয়ার অবরোধবাসিনী, সুফিয়া কামালের সেকালে আমাদের কাল, জ্যোতির্ময় দেবীর বিভিন্ন লেখা, প্রভাবতী দেবী সরস্বতীর লেখা, রাধারানী দেবীর লেখা ,এমনকি কাজী আবদুল ওদুদের নদীবক্ষে বলে যে উপন্যাসটি, যাকে ঘিরে এপারের উন্নাসিক হিন্দু বাঙালি খুব একটা আলোচনাও কখনও করে না , সেখানে যে বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্তের অন্তঃপুরের নারীর অবস্থান ঘিরে নানা ধরনের সামাজিক ইতিহাসের মশলা আমরা পাই ,এসব কিছুকে যেন একটা সমন্বিত ধারার মধ্যে দিয়ে সত্যবতী চরিত্রটির ভিতরে  উপস্থাপিত করতে পেরেছিলেন আশাপূর্ণা

 অবরোধের ঘেরাটোপ মধ্যবিত্ত হিন্দু বাঙালির মধ্যে, উচ্চবিত্তের হিন্দু বাঙালি তুলনায় খানিকটা অন্যরকম ছিল। আবার মধ্যবিত্ত হিন্দু বাঙালি নারীর অবরোধ আর উচ্চবিত্ত মুসলমান নারীর অবরোধের যে খানিক চিত্র, তার মধ্যেও কিছুটা সঙ্গতি-অসঙ্গতি ছিল। এই সমস্ত কিছুকে যেন একটা অদ্ভুত মুন্সিয়ানার মধ্যে দিয়ে আশাপূর্ণা অবস্থিত করতে পেরেছিলেন।

 আশাপূর্ণা সমাজবিজ্ঞানের খুঁটিনাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্দর্ভ রচনার মধ্যে দিয়ে কখনও আত্মস্থ করবার সুযোগ পাননি। আর হয়তো সেটা পাননি বলেই সমাজের এত গভীরে নিজেকে বিস্তৃত করতে পেরেছিলেন। আর সেই বিস্তারই  যেন আমাদের হিন্দু বাঙালি নারীর সামাজিক বিবর্তনের এক অনবদ্য ইতিহাস আশ্রিত দলিল এনে উপস্থাপিত করেছে। সমসাময়িক কালের আবর্তে আমরা বিমল মিত্রের সাহেব বিবি গোলাম উপন্যাস দেখেছি। সেখানেও দেখেছি হিন্দু বাঙালি নারীর সামাজিক অবস্থানের কথা। আবার অন্নদাশঙ্করের বিশ শতক ঘিরে  ক্লাসিকধর্মী উপন্যাসগুলি রয়েছে। সেখানেও আমরা দেখেছি, উচ্চবিত্তের সমাজ ব্যবস্থায় নারীর অবস্থানের নানা খুঁটিনাটি বিষয়াবলীকে।

 কিন্তু এই সমস্ত কিছুকে অতিক্রম করে যখন একেবারে আমাদের সমাজ জীবনের বারোমাস্যা এনে উপস্থাপিত করছেন আশাপূর্ণা , তখন মনে হয় কি যাদু মন্ত্রে , 'শীতল শীতল পরের কথা ' তাঁর কানে এসেছিল। আশাপূর্ণার কালজয়ী সৃষ্টির মধ্যে আমরা কখনও দেখতে পাই না, সমাজ মনস্কতার থেকে বাইরে গিয়ে কোনওরকম কাল্পনিক উপস্থাপনা। আবার দেখতে পাই না, নারীকে মহৎ করবার তাগিদে, কোনওরকমের  অতি বিপ্লবীয়ানা। যে গুলি অনেক ক্ষেত্রে তাঁর পরবর্তী প্রজন প্রজন্মের মহিলা সাহিত্যিকদের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায় বলে সাহিত্যমোদিদের একটা অভিমত রয়েছে।

 আশাপূর্ণা কিন্তু শান্ত মৃদু অথচ দৃঢ় স্বরে  বারবার নিজের মনের ব্যাপ্তিকে প্রসারিত করবার জন্য কলমকে পরিচালিত করে গিয়েছেন। এই প্রসঙ্গে আমার বিশেষ ভাবে মনে পড়ছে, তসলিমা নাসরিনের লেখার স্বাধীনতা ঘিরে সেই সময়ে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল, তার পরিপ্রেক্ষিতে অন্নদাশঙ্কর রায়ের তৈরি করা একটি বিবৃতি নিয়ে আমি তাঁর কাছে গিয়েছিলাম। আশাপূর্ণা লেখকের স্বাধীনতার পক্ষে সম্পূর্ণ সহমত পোষণ করেও অন্নদাশঙ্করের তৈরি করা সেই বিবৃতিতে স্বাক্ষর দেননি কারণ, তাঁর মনে হয়েছিল ,তসলিমার লেখার অধিকার ঘিরে যে আলাপ- আলোচনা- বিতর্ক, তার মধ্যে এক ধরনের রাজনৈতিক আবর্ত কাজ করছে। সেই রাজনৈতিক  আবর্তে অবশ্যই কোনও দলীয় রাজনীতির নিরিখে চিহ্নিত নয়, তবুও কোনও না কোনও উদ্দেশ্যমূলক ভাবনা সেখানে কাজ করছে। এখানে দেখেছিলাম লেখকের স্বাধীনতার পক্ষে অন্নদাশঙ্করের আবেগ মুক্ত মন এসবের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল ছিলেন আশাপূর্ণা। কিন্তু তসলিমার প্রশ্নে বোধহয় অনেক বেশি ভবিষ্যৎকে তিনি দেখতে পেয়েছিলেন তিনি। আর সেটা পেরেছিলেন বলেই সেদিন লেখকের স্বাধীনতার প্রশ্নে মুক্ত কণ্ঠ হয়েও, সেই বিবৃতিতে স্বাক্ষর দিতে তিনি ছিলেন নারাজ।

  • সম্পাদকীয়