আরবি বছরের প্রথম মাস মহরম। মহরমের দশ তারিখটি হল আশুরা। মূলত ওই আশুরার দিনটি 'মহরম' হিসেবে পালিত হয়। এটি কি কোনও উৎসব? অনেকেই ধন্দে থাকেন। বিতর্ক চলে। মুসলিমদের মূলত দু'টি উৎসব। ঈদ-উল-ফিতর বা রোজার ঈদ, আর ঈদ-উল-আযহা বা কুরবানির ঈদ। বাকি যে উৎসবগুলি প্রচলিত তা সর্বজনবিদিত হয়নি। শবে বরাত, শবে মেরাজ, আখেরি চাহারসোম্বা, এমনকী নবী মুহাম্মদ (সঃ)-এর জন্মদিন হিসেবে পরিচিত 'নবীদিবস'-টিও উৎসব হিসেবে সকল শ্রেণির মুসলমানের কাছে স্বীকৃত নয়। এ দিকে বাঙালি বৈশিষ্ট্য অনুসারে বাঙালি মুসলমানের মনটিও উৎসবমুখর। তারা এই দুই ঈদ ব্যাতীত নানারকম উৎসব তৈরি করে নিয়েছেন নিজেদের মতো করে। সেই উৎসবগুলি ধর্মীয় মোড়কে আচ্ছাদিত থাকার কারণে অনেক সময় ইসলামি উৎসব বলে প্রতীয়মান হয়ে থাকে। মহরমের কথাই যদি ধরা হয়, তবে এটা তো কোনও আনন্দমুখর উৎসব হিসেবে পালন করা যায় না! ইতিহাস অনুযায়ী মহরমের দশ তারিখে কি ঘটেছিল?
খলিফা মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পর তার পুত্র ইয়াজিদ সিংহাসনে আরোহণ করেন, যা খিলাফতের নিয়মের বাইরে বংশানুক্রমিক হয়ে যায়। সে সময় ইসলামি দুনিয়ার সমস্ত বিশিষ্ট ব্যক্তিদের খলিফার প্রতি আনুগত্যের অঙ্গীকার করতে হয়েছিল। আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের এবং হুসাইন ইবনে আলী ছাড়া প্রায় সবাই তাদের আনুগত্যের অঙ্গীকার করেছিল। কারণ ছিল ইয়াযীদ একজন অত্যাচারী, মদ্যপ এবং শাসক হওয়ার অযোগ্য ব্যাক্তি।
ইয়াজিদ, হুসাইন বা হোসেনের আনুগত্য পাওয়ার জন্য উদগ্রীব ছিলেন। কারণ হোসেন ছিলেন হজরতমুহাম্মদের কন্যা ফাতিমার সন্তান। খিলাফতের সবচেয়ে বড় দাবিদার এবং যোগ্য ব্যাক্তি।
হোসেন তার ৭২ জন সঙ্গী ও সন্তান-সহ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কুফার দিকে যাওয়ার জন্য মদিনা ত্যাগ করেছিলেন অনুসারীদের আহ্বানে। ইয়াজিদের কাছে তিনি বিদ্রোহী। পথে 'কারবালা' নামক একটি অনুর্বর ভূমির কাছে ইয়াজিদের সেনাবাহিনী তাদের পথ রুদ্ধ করে। তাদের খাদ্য ও পানীয় বন্ধ করে দেওয়া হয়। ইয়াজিদ তার সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক হোসেনের কর্তিত মাথা পেতে সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে প্রচলিত আছে। যদিও এটা নিয়ে ঐতিহাসিক অনেক বিতর্ক আছে। তবে এটা সত্য যে ইউফ্রেটিস নদীর জল তাদের ব্যবহার করতে দেওয়া হয়নি। কয়েক দিনের মধ্যে, তাদের সঞ্চিত জল শেষ হয়ে যায়। প্রবল কষ্টের মধ্যে পড়েন হোসেনের পরিবার। এমনকি বাচ্চারাও ছিল প্রবল তৃষ্ণার্ত। তথাপি হোসেন অযোগ্য ইয়াজিদের আনুগত্য স্বীকার করেননি। মাথা উঁচু করে বাঁচতে চেয়েছিলেন। আশুরার দিনে ইমাম হোসেনের সঙ্গীরা শক্তিশালী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে একের পর এক হত হতে থাকেন। এমনকি ইমাম হোসেনের ছয় মাস বয়সী শিশুকেও তারা তীর বিদ্ধ করে হত্যা করেছিল। অবশেষে ইমাম হোসেনকেও নির্মমভাবে হত্যা করা হয় এবং শিরশ্ছেদ করা হয়। ইমাম হোসেন শারীরিক যুদ্ধে হেরে গেলেও অত্যাচারী ইয়াজিদের কাছে মাথা নত করেননি। তিনি দাসত্বের জীবন যাপনের চেয়ে সম্মানের মৃত্যুকে পছন্দ করেছিলেন। এই হৃদয় বিদারক ঘটনাই ছিল কারবালা, যা মহরম মাসের দশ তারিখে স্মরণ করা হয় মূলত শোক দিবস হিসেবে।
কারবালা একটি স্থানের নাম। মহরম মাসের দশ তারিখকে বলা হয় আশুরা। শিয়াপন্থী মুসলমানেরা মূলত কারবালার স্মৃতিতে মহরম উদযাপন করেন ধুমধাম করে। সুন্নিপন্থীরাও আশুরা পালন করেন, তবে তা একক কারণে নয়, বরং ভিন্ন ভিন্ন কারণে। আশুরার দিনে নবী মুসা বা মোজেস মিশরের ফেরাউন বা ফ্যারাওদের কাছ থেকে বনী ইজরাইলদের মুক্ত করিয়েছিলেন। ওই একই দিনে মানব সম্প্রদায়ের আদি পিতা আদম জ্ঞানবৃক্ষের ফল (গন্দম) ভক্ষণ করে যে অপরাধ করেছিলেন, যে অপরাধে আদম ও তার সঙ্গিনী হাওয়া বা ইভকে নির্বাসন করা হয়েছিল এই পৃথিবীতে -- আশুরার দিন ঈশ্বরের কাছ থেকে পেয়েছিলেন ক্ষমা। এমন অনেক ঘটনাই ঘটেছিল মহরমের দশ তারিখ বা আশুরার দিনে। সে কারণে সুন্নি মুসলমানদের কাছে দিনটির গুরুত্ব আছে বটে; তবে তা উৎসব হিসেবে পালিত হয়নি। ইসলামি উৎসব অনুষ্ঠান মূলত নামাজকেন্দ্রিক। সুন্নিপন্থীরা ওইদিন নামাজ, রোজা, দান খয়রাত করে থাকেন। কোথাওবা রাতের দিকে হয় ওয়াজ মহফিল। শিয়ারা কারবালার স্মরণে যে তাজিয়া বানায়, মিছিল করে শোকের মাতম করে, বুক চাপড়ায়, এসবে সুন্নিদের ঘোর আপত্তি। কাজেই 'মহরম' মুসলমান সমাজে সর্বজনবিদিত উৎসব হয়ে ওঠেনি।
বিশ্বে শিয়াপন্থী মানুষেরা সংখ্যালঘু। ভারতীয় উপমহাদেশ বিশেষত বাংলার চিত্র কিছুটা ভিন্ন। শিয়া তো বটেই, সুন্নী মুসলিম সমাজেও মহরমের সেই কারবালার স্মরণীয় দিবসটির যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। এক সময় গ্রামেগঞ্জে পড়া হত পুঁথি। দুলে দুলে ছন্দময় সেই পুঁথির শ্রোতারা হোসেনের শহিদ হওয়া, সখিনার সদ্য বৈধব্যের হাহাকারের বর্ণনায় কেঁদে বুক ভাসাত। 'ও সখিনা আর কেঁদো না ফেলো না তোমার চোখের পানি ’, এখন সে সব বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। অবশ্য গ্রাম বাংলার বিভিন্ন জায়গায় 'জারি গান' জারি আছে এখনও। কারবালার বিয়োগান্তক গীতগাথা গাওয়া হতে দেখা যায় কিছু কিছু অঞ্চলে, মাতম হিসেবে।
মীর মোশাররফ হোসেনের বিষাদ সিন্ধু উপন্যাসটি এক সময় পঠিত হতো শিক্ষিত সাহিত্যপ্রেমী পরিবারে, এখন আর হয় কি না জানা যায় না। মানুষ তো এমনিতেই নেট দুনিয়ার বাসিন্দা হয়ে গিয়েছে। বই পড়ার চল অনেকটা কমে গিয়েছে। সময়ের স্রোত প্রবাহমান। হারিয়ে যায় অনেক কিছু। উদ্ভাসিত হয় নতুন কিছু। সেই নতুনত্ব কি সব সময় ডেকে আনে হিত? মানুষ যেন বেঁহুশ হয়ে ছুটে চলেছে সেইসব আচার অনুষ্ঠানের দিকে যেখানে ধর্মের রঙ মেশানো আছে। সব সমাজের জন্য প্রযোজ্য এই কথাটি। যেভাবে অভাবনীয় ভাবে বেড়ে গিয়েছে রামনবমী, রথের মিছিল, সে ভাবেই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মহরমের জলুস আর জলসা। এই অন্তসারশূন্য, আচার সর্বস্ব ধর্মাচার কতটা সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখে, কতটাই বা আত্মশুদ্ধির পথ তৈরি করে তা দুর্বোধ্য হয়ে যায়। কারবালার বুক ফাটা কান্না নয়, ঢোল-বাদ্যে, নকল অস্ত্র প্রদর্শনে কিংবা নকল দুলদুল ও তাজিয়া সজ্জায় বেলাগাম, বেহুদা আনন্দ প্রকাশে মত্ত হয়ে ওঠে একদল তরুণ-যুবক।
অসম এক প্রতিযোগিতার আস্ফালন। ক্রমশই বেড়ে চলেছে এই মানসিকতা। ঠিক এই আবেগের জায়গাটিকে মোক্ষম ভাবে ধরে ফেলেছে রাজনৈতিক অপশক্তি। তারা এইসব মত্ততায় খুশি হয়। উৎসাহিত করে। উৎসব হিসেবে ধর্মের নামে অপধর্মের বিস্তার রোধ না করা গেলে একদিন দেশের ক্ষতি এমন জায়গায় পৌঁছাতে, যেখান থেকে ফিরে আসার পথ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে উঠবে। হাহাকার কারবালা হয়ে উঠবে।