সময়ে ধুয়ে গিয়েছে অনেক কিছু, পড়ে থাকা মেঘ এখন একপশলা গল্প হয়ে ঝরে

সেই কবে কালিদাস তাঁর 'মেঘদূতম'- লিখেছিলেন এক অমোঘ ভালবাসার আখ্যান। কালিদাসের সময়ে হয়তো আষাঢ়ের প্রথম দিনেই ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ত। মেঘ ঘিরে ফেলত চারপাশ। সেই বৃষ্টি দেখেই মহাকবি লিখে ফেলতে পারতেন আস্ত মহাকাব্য।  কিন্তু এখন বাংলা ক্যালেন্ডারে আষাঢ়ের পয়লা তারিখ কবে পার হয়ে যায়, কেউই খোঁজ রাখে না। বাঙালীকে আজকাল বড্ড হাপিত্যেশ করতে হয় বর্ষার জন্য। বর্ষা আসে ঠিকই,  কিন্তু সামান্য একটু দেখা দিয়েই চলে যায়। দশহরা বা গঙ্গা পুজো-তে বার এতটুকুও বৃষ্টি হয়নি। বাংলার নিজস্ব লোকগাথায় বলে দশহারায় বৃষ্টি না হলে নাকি সাপের উৎপাত বেড়ে যায়। যদিও এখনকার দিনে কে- বা দশহারা কবে, তা মনে রাখে?

 

বৈশ্বিক উষ্ণায়ন কমাতে জনসচেতনতাও প্রয়োজনআবার, উত্তরবঙ্গে সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র। সেখানে বর্ষা প্রতিবছর ভাসিয়ে দেয়। প্রয়োজনের অতিরিক্ত বর্ষার জলে বানভাসি হয় কত-কত মানুষ। কতজনের বাসা ভাঙে অশান্ত তিস্তা। দক্ষিণে সেই বর্ষাই কখন যে আসেন, আর কখন চলে যান, কেউ ধরতে পারে না। কেন বর্ষার এমন খামখেয়ালিপনা, তা নিয়ে পরিবেশবিদদের গুরুগম্ভীর আলোচনা হতে পারে। 'বিশ্ব উষ্ণায়ন' নিয়ে সেমিনার হতে পারে, 'শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত' আলোচনা গৃহে বসে! কিন্তু, এই লেখায় সে সব থাক। দুনিয়ার যত কঠিন অথচ নির্মমতাকে ভুলে চোখ ধুয়ে নিই বর্ষার জলে।

 

পাশ্চাত্যের কবিদের মধ্যে বসন্তকে নিয়ে একটা আলাদা 'ফ্যান্টাসি` আছে! তার কারণও বোধ করি, ইউরোপের ওই ধূসর, প্রবল ঠান্ডার পরে কিছুটা রঙ এনে দেয় বসন্ত। কিন্তু এই উপমহাদেশে কিন্তু বসন্ত অতটা জায়গা জুড়ে নেই৷ বসন্ত এখানে দুয়োরানি। কারণ বসন্ত আসতে আসতেই আমাদের এই নাতিশীতোষ্ণ দেশে এসে পড়ে প্যাচপেচে গরম!  তাই, বোধহয় ঋতুদের মধ্যে কবি, সাহিত্যিক, সিনেমার পরিচালকদের কাছে এত প্রিয় এখানে বর্ষা। কেবলই বর্ষা।

 

" সখি হামারি দুখের নাহিকো্ ওর।

ভরা বাদর, মাহ বাদর

শূন্য মন্দির মোর’'

 রবীন্দ্রনাথ-নজরুল সম্পর্ক

বিদ্যাপতি লিখেছিলেন এমন বিরহের গাথা।  আমাদের নিজেদের ঘরের ঠাকুর রবি ঠাকুর-নজরুল ইসলাম অবধি, বর্ষাকে নিয়ে অসংখ্য গান কবিতা লিখে গিয়েছেন, যা আজও রয়ে গিয়েছে। থাকবে।

 

যদিও বর্ষা আমাদের ফাঁকি দিয়েছে। তবুও একথা তো সত্যি যে, এই নদীমাতৃক ভারতবর্ষে, যেখানে কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত এদেশের কোটি কোটি মানুষ, তাদের জন্য বর্ষা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। বৃষ্টি হলে ফসল ভাল হবে। ফলন ভাল হলে, আনাজের দাম কমবে। উল্টোটা হলে দাম বাড়বে। অর্থমন্ত্রী ''পেঁয়াজ খাই না'' বলে এড়িয়ে যাবেন!  আর আরও কিছু কৃষক আত্মহত্যা করবেন! কৃষক 'লাশ' হবে, আর নিম্নবিত্ত হবে 'জিন্দা লাশ'!  আসলে বর্ষা তো শুধু একটা ঋতু না, বর্ষা দেশের কোটি-কোটি মানুষের জীবন জীবিকার নির্ধারক৷ মজে যাওয়া মরা নদীতে প্রাণ ঢেলে দেয় বর্ষা।

 

যে বর্ষা না এলে 'আল্লাহ মেঘ দে পানি দে'-এর করুণ আর্তনাদে একাত্ম হয় হিন্দু কৃষকও। আবার, তেমনিই ব্যাঙের বিয়ে দিয়ে বর্ষাকে ডাকার গ্রামীন উপচারে সামিল হয় এদেশের কোটি কোটি  মুসলিম কৃষকরাও। খেটে খাওয়া মানুষের আবার ধর্ম কি! বঙ্কিমচন্দ্র তো সেই কবেই 'বঙ্গদেশের কৃষক' প্রবন্ধে হাসিম শেখ আর রামা কৈবর্ত্ত' দুর্দশার নিদারুণ ছবি এঁকে গিয়েছেন! আজও তাই বর্ষাকে ঘিরে আবর্তিত হয় এদেশের কোটিকোটি কৃষকের জীবন।

 

কবিদের 'রোমান্টিসমে' বাইরে গিয়েও বর্ষার যে কতটা গুরুত্ব তা কি সে নিজেও জানে?

 

"এমন দিনে তারে বলা যায়

এমন ঘন ঘোর বরিষায়।"

 

কালীদাস, চন্ডীদাস, রবীন্দ্রনাথ পেরিয়ে বরং এগিয়ে যাই আরও অনেক বছর। তখনও বর্ষা সময়ে আসত। আজকের মতো অবাধ্য ছিল না। তখন 'ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট' সিনেমায় রাজ কাপুর আর নার্গিস রোমান্স করতেন পর্দায়৷ বাস্তবেও? 'প্যায়ার হুয়া ইকরার হুয়া' গাইতে গাইতে রাজের কালো ছাতা উড়ে যাবে। উড়ে যেতেই হবে। কারণ,  তারপরেই বৃষ্টিতে ভিজবে দু'টো শরীর! সিক্ত হবে। সেই সাদা কালো যুগে সেটাই উষ্ণতা ছড়াবে। কয়েকবছরের মধ্যেই কিশোর কুমার বৃষ্টিতে ভেজা মধুবালা-কে  দেখে গাইবেন, "এক লড়কি ভিগি ভাগি সি...” তারপরে আরও তিন দশক কেটে যাবে। বৃষ্টি আর রোম্যান্স-কে আলাদা উচ্চতায় নিয়ে যাবে বলিউড! অমিতাভ বচ্চন আর স্মিতা পাতিল বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে আগুন ধরাবেন পর্দায় 'নমক হালাল' ছবিতে। 'আজ রপট যায়ে তো, হামে না উঠাইয়ো...’ ১৯৮২-এর সেই সময়ে 'বচ্চন কাট্', কান ঢাকা চুল আর বেলবটম প্যান্ট, মফস্বলের সিনেমা হলে দেদার ব্ল্যাক! ভারতীয় সিনেমার পর্দায় বর্ষা প্রজন্মের পর প্রজন্মে নতুন নতুন করে এসেছে! যে ভাবে 'কুছ কুছ হোতা হ্যায়'-তে কোনও গান ছাড়াই শাহরুখ কাজলের 'রেইন ড্যান্স' ভারতীয় সিনেমার 'আইকনিক'  দৃশ্যগুলোর একটা হয়ে গেছে! বর্ষা-প্রেম আর শরীর একাত্ম হয়ে গেছে! এই প্রেম শুধুই 'প্লেটোনিক' না! বর্ষা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কুসুমের মতো। শুধু মন না, শরীরও চায়!

 

"আওগে জব তুম সাজনা

অঙ্গনা ফুল খিলেঙ্গে

বরসেগা শাওন... ঝুম ঝুম কে...

দো দিল, অ্যায়সে মিলেঙ্গে...”

 

উস্তাদ রশিদ খান দরদি গলায় গেয়েছিলেন। যেন ডুকরে উঠছে দু্'টো হৃদয়। এই গান শুনে যেন আরও একটু দু:খবিলাসী হয়ে ওঠে মন। বর্ষার একটা অদ্ভুত মন খারাপ আছে। একাকিত্ব আছে। দীর্ঘদিন অপেক্ষার পরে বর্ষায় যেমন একটা মন ভাল করা আছে। তেমনিই টানা কয়েকঘন্টার বৃষ্টিতে ঘরবন্দি হয়ে যাওয়া আর বাইরে অবিরাম বৃষ্টি একটু বিরক্তিও ধরায় বৈকি। খিচুড়ি আর হুইস্কি খেয়ে কেউ কেউ বর্ষাযাপন করেন হয়তো।  কিন্তু, আমাদের মতো খেটে খাওয়া মধ্যবিত্তদের ক্ষেত্রে দিনের সব পরিকল্পনা বাতিল করে, একটা গোটা দিন একা-একা কাটিয়ে দেওয়ার  চ্যালেঞ্জটাও বোধহয় বর্ষাই করে! সবার জীবনে তো আর আজকাল বাংলা সিরিয়ালের মতো বাড়ি ভর্তি লোক থাকে না। আর আজকের নিউক্লিয়ার পরিবারে বেশীরভাগ মানুষই আসলে 'একা'

 

ঘরে বসে বৃষ্টির দিন উপভোগ করতে যা করবেন'মেঘ'-এর সঙ্গে তুমুল ঝগড়ার পরে বর্ষা নিজে যেমন সারাটা দিন কাঁদে, তেমনিই আমাদেরও কাঁদায়। ঝাপসা কাচ, রশিদ খান বা জগজিৎ সিংয়ের গান আর হুইস্কি বা ব্ল্যাক কফি আমাদের মনে করায় আমাদের অপ্রাপ্তির কথা। কত কত হেরে যাওয়া, অপমানের কথা। বসের চেম্বারে ডেকে অপমান, প্রেমিক বা প্রেমিকার প্রত্যাখ্যান, বারবার ইন্টারভিউ দিয়েও একটাও চাকরি না পাওয়ার ব্যর্থতার কাহিনিগুলো বর্ষা মনে করিয়ে দেবে! যে গল্পগুলো একান্ত নিজের। যে গল্পগুলো কেউ শোনেনি। কেউ শুনবেও না। সেই গল্পগুলো একসুরে ঝরে পড়া বৃষ্টি আমাদের মনে করাবেই!

 

চল্লিশ পেরিয়ে যাওয়া কোনও এক পুরুষের মনে পড়ে যাবে, তাঁর পরকীয়া সম্পর্কের কথা। ধরা যাক, তাঁর নাম অবিন। অবিন জানে, যেটা করছে, সেটা ভুল!  এই বৃষ্টি ওকে বোঝায় যে এটা ভুল না, অন্যায়! তবুও অবিন অফিসের জুনিয়র কলিগ শ্রেষ্ঠার সঙ্গে প্রেম করে। প্রেম মানে আসলে, বাইপাসের ধারের হোটেলগুলোয় গিয়ে সময় কাটায়। এটা জেনেই করে যে, শ্রেষ্ঠা ওর সঙ্গে বিছানা ভাগ করে নেয়, স্রেফ নিজের প্রমোশনের জন্য। 'অ্যাপ্রাইসাল'-টা পেয়ে গেলেই শ্রেষ্ঠা আর ওকে ছুঁয়ে দেখবে না! তবুও অবিন এই সম্পর্কটায় আরও বেশী করে জড়িয়ে যায়। বর্ষায় ঘরে আটকে গিয়ে দামী স্কচ অসময়েই গলায় ঢালতে হয়। কারণ, স্ত্রী-সন্তানের সামনে আদর্শ স্বামী-বাবা'- অভিনয় চালিয়ে যেতেই হবে অবিনকে! বর্ষা এভাবেই আটকে দেয়! অস্বস্তিতে ফেলে দেয় বহুবার।

 

অথবা, সংসারে চাপে হারিয়ে যাওয়া এক সময়ের মফস্বলের ডাকসাইটে সুন্দরী, ছেলেদের ইস্কুলের 'ক্রাশ' প্রাক্তন  নৃত্যশিল্পী সুচরিতা হয়তো এমনই বর্ষার দিনে বহুদিন বাদে নিজের আলমারির লকার থেকে বার করবে, লুকিয়ে রাখা ঘুঙুরগুলো। যে ঘুঙুরগুলো বিয়ের পরপরই  তুলে রাখতে হয়েছিল 'কর্পোরেট' স্বামীর নির্দেশে!  বৃষ্টির একটা সোঁদা গন্ধ আছে। আলমারিতে বহুদিন লুকিয়ে রাখা জিনিসেরও একটা হাল্কা ন্যাপথলিনের স্যাঁতসেঁতে গন্ধের মতো লেগে থাকে। সুচরিতা  'ঘুঙুর'-টা জড়িয়ে ধরে। ঠিক যেমন করে,  ইলেভেনে পড়ার সময় ওর সহপাঠী বিজয়েন্দু জড়িয়ে ধরেছিল বিজনবাবুর ব্যাচ ছুটি হওয়ার পরে! ব্যাচের সবাই সেদিন বেরিয়ে গিয়েছিল। বৃষ্টিতে আটকে পড়েছিল শুধু ওরা দু'জন। ক্যালকুলাস-ডেরিভেটিবের অঙ্ক মেলানোর ছুতোয় আরও খানিকটা সময় ইচ্ছে করেই থেকে গিয়েছিল। তখনই বৃষ্টি নেমেছিল।  স্যার দোতলায় যেতেই বিজয়েন্দু ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ওর গায়ে। আরও কিছু করত হয়তো। কিন্তু সাহসে কুলোয়নি কারওরই। তখন সদ্য আমির খানের 'ক্যায়ামত সে ক্যায়ামত তক' রিলিজ করেছে। প্রেমের জন্য কতদূর যাওয়া যায়, পর্দায় দেখিয়ে দিয়েছেন আমির খান-জুহি চাওলা! কিন্তু, বিজয়েন্দু জড়িয়ে ধরা ছাড়া তেমন কিছু করেনি সেদিন। গালে ঠোঁট ছুঁইয়েছিল একটু। বিজয়েন্দু একটুবাদে ভিজতে ভিজতেই ওঁর ভাঙা অ্যাভন সাইকেলটা নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলো স্যরের বাড়ি থেকে।

 

সুচরিতার হোয়াটসঅ্যাপে একটা টেক্সট এল। বৃষ্টির জন্য কলকাতা বিমানবন্দর বন্ধ। কলকাতা আসার সব ফ্লাইট ক্যানসেল। রজত, মানে ওর হাসবেন্ড আজ আর ব্যাঙ্গালোর থেকে ফিরবে না। চল্লিশ পেরিয়ে যাওয়া সুচরিতা জানে, রজত ওঁর চেয়ে কুড়ি বছরের ছোট দিয়া' সঙ্গে একটা সম্পর্কে আছে। রজত আর ওঁর মেয়ের ঐশী' চেয়ে মাত্র বছর পাঁচেকের বড় হবে দিয়া। দিয়া আপাতত রজতের অফিসে 'ইন্টার্নশিপ' করছে।  জানে, রজতকে দিয়া আর ওর বন্ধুরা 'সুগার ড্যাডি' বলে ডাকে! 'সুগার ড্যাডি' ব্যাপারটা কী সেটা সুচরিতা জানত না। কিছুদিন আগে ওর মেয়ে ঐশী যখন ওর  বন্ধুদের সঙ্গে, 'সুগার ড্যাডি' শব্দটা নিয়ে মজা করছিল, তখনই আড়াল থেকে সবটা  শুনেছে সুচরিতা। ইসস্, ঠিক এমন সময় যদি কলিংবেলটা বাজত! ঋতুপর্ণ ঘোষে' 'রেইনকোট' ছবিতে যেমন এরকমই বৃষ্টির দিনে ঐশ্বর্য রাইয়ের বাড়ির দরজায় দরজায় হঠাৎই টোকা দিয়েছিল ছোটবেলার প্রেমিক অজয় দেবগন! তেমন করে যদি এখন বিজয়েন্দু আসত! এরকম মেঘলা বৃষ্টির দিন খুব খারাপ! অনেক বাজে চিন্তা মাথায় ঘোরে! একবার কি ফেসবুকে সার্চ অপশনে গিয়ে টাইপ করবে? 'বিজয়েন্দু রায়' লিখে?

 

"এই শ্রাবণ নাম লেখা গাছের পাতার তলে

এই শ্রাবণ মিশলো পুকুর ড্রেনের জলে

এই শ্রাবণ বাক্স বন্দী কিছু ইচ্ছে আছে

এই শ্রাবণ স্যাঁতস্যাঁতে খুব আমার কাছে।"

 

এই বর্ষা যেমন দু:খবিলাস করায়। তেমনিই এই বর্ষা সত্যিকারের দু: হয়ে হাজির হয় কত কত মানুষের জীবনে। খবরের কাগজের এক কোণে খবর বার হয়। বিদ্যুৎস্পৃষ্ঠ হয়ে মৃত কিশোর। ক্ষমতার শীর্ষে থাকা কিছু লোকজনের দায়িত্বজ্ঞানহীনতায় চলে যায় তরতাজা প্রাণ। রাস্তার ইলেকট্রিক পোস্ট 'বডি' হয়ে যায়। ড্রেন উপচে গোটা রাস্তায় জমে থাকা জল সাক্ষাৎ মৃত্যু হয়ে দাঁড়ায়। চলে যায় জলজ্যন্ত বছর ১৭ এর কিশোর। বিট্টু পাসোয়ান। বর্ষা ওকে কেড়ে নিয়েছিল? নাকি ক্ষমতার চেয়ারে বসে থাকা কিছু 'অপদার্থ'-রা, সেই হিসেব এখন করতে পারেনি বিট্টুর বাবা রমেশ। রমেশ এখন খুব চুল্লু খায়। আগেও খেত। বৃষ্টি হলে আরও খায়। আগে রমেশের বউ আরতি এই চুল্লু খাওয়া নিয়ে খুব ঝামেলা করত। এখন আর করে না। রমেশ চুল্লু খায় আর বর্ষা-কে গালাগালি দেয়। বিট্টু মারা যাওয়ার পরে রমেশদের এই কলোনিতে অনেক টিভির ক্যামেরা এসেছিলো! সবাই রমেশের ইন্টারভিউ নিয়েছিলো। সন্তান হারা বাবামায়ের চোখের জল ভালো 'টিআরপি' দেয় টিভিওয়ালাদের! শাসক-বিরোধী অনেক পার্টির লোকেরা বিট্টু' মৃত্যু  নিয়ে রাজনীতি করেছিল। বিট্টু পাসোয়ানের এই মর্মান্তিক মৃত্যু নিয়ে অনেকগুলো টিভি চ্যানেলে সান্ধ্য বির্তক সভা হয়েছিল। পৌরসভার ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ার কিছুদিনের জন্য শো-কজড হয়েছিলেন বটে! ব্যস এইটুকুই। এখন আবার বহাল তবিয়তে তিনি কাজ করছেন! এই মৃত্যুর দায়ে কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। কেউ পদত্যাগ করেনি। কারওর কোনও পদ যায়নি। খালি প্রতিবছর বর্ষা এলেই এখনও আকন্ঠ চুল্লু খেয়ে বর্ষাকে দেহাতি ভাষায় গালাগালি দেয় রমেশ! রমেশের ইচ্ছা হয়, ওঁর ছেলের মৃত্যুর জন্য আসল দোষীদের নাম ধরে ধরে গালাগালি দিতে। কিন্তু মাতাল রমেশ জানে, ওই লোকগুলো অনেক উঁচু চেয়ারে বসে আছে! ওদের হাতে অনেক 'পাওয়ার' ওদের ওই কালো কাঁচ লাগানো গাড়িগুলো যখন তখন পিষে দিতে পারে ওদের মতো বেওয়ারিশ মজদুরকে! রমেশ তাই, চুল্লুর নেশায় শুধুই বর্ষাকে খিস্তি দেয়। বৃষ্টি বাড়লে সেই খিস্তির তোড় আরও বাড়ে।

 

বর্ষাও জানে, ১৭ বছরের বিট্টু পাসোয়ানের মতো আরও অনেকের মৃত্যুর জন্য দায়ী না। দায়ী অন্য কেউ। কিন্তু তারপরেও বর্ষা সবটা সহ্য করে নেয়। কারণ, বর্ষা ভেজায়, নিজেও ভিজতে জানে। অনেকটা শোক ধারণ করে, তারপরেই অঝোড়ে নেমে আসে এই বসুন্ধরার বুকে।   নজরুলের লেখার মতো,

 

"শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে,

বাহিরে ঝড় বহে নয়নে বারি ঝরে। 

ভুলিও স্মৃতি মম নিশিথ স্বপন সম

আঁচলের গাথা মালা ফেলিও পথ পরে.. ”।।

  • শমিত ঘোষ