মফসসল শহরে মানুষ হলেও রেকর্ড প্লেয়ারের দৌলতে বর্ষা যেন আমার কাছে সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ;'এলো বরষাযে সহসা মনে তাই, রিম ঝিমঝিম ,রিম ঝিমঝিম ,গান গেয়ে যাই '-- এই গানটার সঙ্গে কেমন একটা মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। নগর জীবনের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর বন্ধুবান্ধবদের কাছে শুনেছি; উৎপলা সেন নাকি খুনসুটি করবার জন্য, তাঁর 'মানা'-কে বলতেন ; গাড়ি চালাতে চালাতে, রাস্তায় কোনও সুন্দরী মেয়েদেরদেখলেই সতীনাথ , সুধীন দাশগুপ্তের সুরে ,এই গানটি গুনগুন করে উঠতেন।
বর্ষার গান, কবিতা, ছবি, আমাদের মনন জগতকে একটা অন্যরকম আমেজের মধ্যে পরিপুষ্ট করে তুলেছে। কিন্তু বর্ষার খাওয়া দাওয়া, এটা আমাদের কতখানিরসনারতৃপ্তি ঘটায় ? বর্ষা মানে কি কেবলমাত্র খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ?আর কিছু খাবার নেই বর্ষায়?
খিচুড়ি তো এখন প্রায় মহার্ঘ্য । গোবিন্দ ভোগ চালের খিচুড়ি যদি বানাতে চাই, চালের দাম পকেটের ছেঁকা দেবে। তারপর ভাল ঘি। সেখানেও ঠ্যাকা কম নয়। আবার ভালরকম মশলাপাতি না দিলে খিচুড়ি জমবে না। আচ্ছা কেমন খিচুড়ি হবে ? লোপসির মতো খিচুড়ি ?
আজকের নতুন প্রজন্ম এই লোপসি খিচুড়ি ব্যাপারটা জানেই না। একটা কাল ছিল, যখন গরিব বড়লোক সব বাড়িতেই পাতলা ট্যালটেলে খিচুড়ি খাওয়ার একটা রেওয়াজ ছিল। বিশেষ করে বর্ষার দিনে ।
মুগের ডালের খিচুড়ি বর্ষায় খুব একটা কিন্তু হত না। হত মুসুর ডালের। মুগের ডালের খিচুড়ির মধ্যে কেমন একটা উৎসবের গন্ধ মাখা রয়েছে। অনেকে বলেন, ভোগের খিচুড়ি। আজকাল তো আবার ফেসবুকের দৌলতে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, এই ভোগের খিচুড়িও অনলাইনে কিনতে পাওয়া যায়। জানি না , সেটা কোনো দেবালয় নিবেদন করা , নাকি কেবলমাত্র পেটুকের রসনা তৃপ্তির জন্য ।
মনে হয় 'ভোগের খিচুড়ি',এই বিপণনের ক্ষেত্রে, একটা ভোগের খিচুড়িরসঙ্গে 'মতো'এই শব্দটা রাখা খুব দরকার। তা না হলে, বিশ্বাসীদের আধ্যাত্মিক বোধের সঙ্গে কেমন একটা বেইমানি করে হয়ে যায় ।
তা সে যাই হোক, এই লোপসি খিচুড়িকে বিভূতিভূষণের গল্পে খুব দেখতে পাওয়া যায়। পথের পাঁচালীর পরবর্তী অংশ, অপরাজিত, যেখানে উপন্যাসের কুশীলবদের সঙ্গে পটভূমিতে যুক্ত হয়েছে বেনারস, সেখানকার নানা ধরনের ধর্মশালা, উপাসনালয় ইত্যাদি-তে প্রসাদ ভোজন পদ্ধতি যুক্ত হয়েছে। আর সেখানেই এসে যাচ্ছে, এই লোপসি খিচুড়ি ।
এটা উপন্যাসে যত না , আমাদের কাছে বিষয়টা লোভনীয় হয়ে ওঠে সত্যজিৎ রায়ের ফিল্মে । যখন বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে ভক্তদের খিচুড়ি খাওয়ার দৃশ্যগুলি আমরা দেখি, তখন সেই তীর্থস্থানের মাহাত্ম্য আর বাংলার বর্ষা, কোথায় যেন একটা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
একটা সময় ছিল যখন ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে শীতকালে, বর্ষাকালে গরম গরম খুদের খিচুড়ি খেতে খুব ভালবাসতো । বাংলাদেশের বৃহত্তর ঢাকায়, অর্থাৎ;বিক্রমপুর -মুন্সিগঞ্জ, এই সমস্ত এলাকায় খুদের ভাত খাওয়ার একটা রীতি আছে। বর্ষাকালে অনেকে এইধরনের ভাত খান। ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে বর্ষাকালে এই খুদের ভাত, যাকে, ঢাকা বিক্রমপুরের ভাষায় বলা হয়;'বউয়া ভাত ' তা, সেখানকার মানুষেরা খুব আনন্দ করে খান। আজকের দিনের বাঙালি অবশ্য খুদের ভাত, পাঁচতারা হোটেলে গিয়ে হাজার হাজার টাকা খরচ করে খায়।আবার কেউ কেউ আছেন যাঁরা, খুদের ভাত খাচ্ছি, এটা বাইরে বললে, পাছেবাইরের মানুষ মনে করে ফেলে যে, এরা খুব গরীব, সেই কারণে ভাল লাগলেও ,এসব বিষয়গুলি বাইরে আলোচনা, বর্ষা --খিচুড়ি এইসমস্ত আলোচনা নৈব নৈব চ!
আজ থেকে চল্লিশ ,পঞ্চাশ বছর আগে গ্রামবাংলারসামাজিক কাঠামোটা কী ছিল এখনকার মানুষ ঠিক ঠাওয়ার করে উঠতে পারবে না। গ্রামের মানুষ, সে যদি পরিশ্রম করে, জমি জিরেত , ব্যবসা-বাণিজ্য বা চাকরি-বাকরি ইত্যাদির মাধ্যমে সামান্য কিছু উপার্জন করে, একদম হা অন্ন অবস্থা থেকে উত্তরিত হয় , তবে তার পক্ষে কোঠা বাড়ি , নিদেন পক্ষে ঘরতৈরি করার ব্যাপারটা সেদিন ছিলপ্রায় একটা নিষিদ্ধ ।
এখানে নির্ভর করত নানা ধরনের জাতপাতের পাঁচিল। নির্ভর করত নানা ধরনের সামাজিক পরিকাঠামোর বিষয়গুলো। সেসব বিষয়, যা শরৎচন্দ্রের লেখায় দেখা মেলে বা বিভূতিভূষণের উপন্যাস, ছোটগল্পে, ' আপনারা?' এই প্রশ্নের মধ্যে লুকিয়ে আছে , সেগুলো কিন্তু খুব বেশি দিন আগেকার ব্যাপার না ।
যদি আমরা মনে করি;শরৎ থেকে বিভূতিভূষণ,ষাট সত্তর বছরের বাংলায় যে সামাজিক বিবর্তন ,তা একটা ইতিবাচক উত্তরণের দিকে বাংলাকে নিয়ে যেতে পেরেছিল ,আমরা বোধহয় হতাশ হব। এই বর্ষার সালতামামিলিখতে গিয়ে তাই বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে ,সেই সব সময়, জাতপাতের বেড়াজালে কি অসহনীয় অবস্থা নিম্নবর্গীয় মানুষদের এই বাংলার বুকেই সইতে হয়েছিল। উচ্চবর্ণের সামাজিক শোষণটা শীত- গ্রীষ্ম- বর্ষা -হেমন্ত- বসন্ত, কীভাবে মানুষের জীবনে একটা জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছিল।
আজ হয়তো নতুন প্রজন্মের পাঠকদের কাছে একদমই আশ্চর্য লাগবে, কিন্তু আশ্চর্য লাগলেও এটা কঠিন সত্য এই যে, এককালে গ্রামে উঁচু জাতের মানুষজনেরা ছাড়া সামান্য কিছু পয়সা কড়ি করে থাকলেও নীচু জাতের মানুষদের ঢালাইছাদের বাড়ি ঘর-- এগুলো ছিল তোলা ছিল মহা অপরাধ। সেই সময় থেকে ধীরেধীরে আমরা আজকের সময়ে এসেছি । তাই গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর জ্বালায় বৃষ্টির সেই ঘন ,ঝমঝমে রূপ আমাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেও,এখন যেন চোখ বুজলে দেখতে পাই; যে গ্রামে আমার নাড়ী পোঁতা আছে, সে গ্রামে বর্ষার দিন, সবে হয়তো সন্ধে ছ'টা বাজে, কিন্তু মনে হবে যেন নিশুত রাত। চারিদিকে ব্যাঙ ডাকছে । আওয়াজ আসছে মাঝে মাঝেগোঁ,গোঁ করে। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকও মাঝেমাঝে আসছে।
আচ্ছা বর্ষায় কি ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকে? নিজের কাছেই এখন কেমন যেন নিজেকে একটাসংশয়দীর্ণ মানুষ বলে মনে হয়। বর্ষাকালে ব্যাঙের ডাকে সঙ্গে ঝিঁঝিঁর সাইরেন,বাজত কি বাজতনা, এসব মনে করতে গিয়ে এখন আমার মনে ভিড় করে সেই ঘন্টা ঝিঁঝিঁর কথা।
ডুয়ার্সের ধুপঝরা বস্তিতে শোনা ঘণ্টা ঝিঁঝিঁ-এর কথা। ঠিক যেন মনে হচ্ছে ,কোনও মন্দির বা দেবালয়ে ,বা হয়তো আমার বাড়ির ঠাকুরদালানেকেউ ঘন্টা বাজিয়ে পূজার্চনাকরছে, এমনই সেই সুন্দর ছিল ঝিঁঝিঁর ডাক-- এসব আমার মনে পড়ছে। কিন্তু মনে পড়ছে না , আমার গায়ে বর্ষার সেই ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে ব্যাঙের ডাকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঝিঁঝিঁ ডাকত কি, ডাকত না।
বর্ষায় ছাতা মাথায় দেওয়ার রেওয়াজ ছোটদের জন্য সেকালের গ্রাম বাংলায় খুব একটা ছিল না। ছিল টোকা। বেত বা বাঁশের বিরাট বেড় দেওয়া টুপি । মাথা শরীর বর্ষার জল থেকে সবকিছুই বাঁচাত । রোদে তো বাঁচাতোই , রোদের দিনে।
সেই টোকা মাথায় দিয়ে পাঁচ পয়সা, দশ পয়সা হাতে গেছি চপের দোকানে। ছোট্ট একটা খড়ের ছাউনি। সামনের কাঠের ফেতনা দিয়ে খড়চোয়ানো জলগুলো মাথার উপরে পড়ছে। সেই টোকার থেকে জলগুলো ছিটকে ছিটকে পড়ছে দোকানের সামনেটায়। খড়চুয়ানো জলে ছোট্ট একটা নালার মতো হয়ে আছে দোকানের সমুখদিকটা । ইচ্ছে করে পা দিয়ে ছপছপ করছি। সেই জল একটু আধটু ছিটকে উঠছে সামান্য উঁচুমাটির দাওয়ায়।
বেশ রেগে যাচ্ছে চপওয়ালি। আবার হাসছেও। হয়তো তারও মনে পড়ে যাচ্ছে নিজের ছোটবেলাকার কথা। দেখতে পাচ্ছি, হয়তো আমার, আমাদের মধ্যেই নিজের ছোটবেলাকে সে ম্যারি হপকিনের গান , দাউ দ্যাট ডেইজ হ্যাজ গন-- এই গান সে শোনেনি , রবীন্দ্রনাথের পুরানো সেই দিনের কথাও শোনেনি। কিন্তু না শুনেও তার হাসি বলে দিচ্ছে, গানের ভাষাআনন্দের ভাষা, তার কোনও আলাদা সামাজিক আয়মাদারি থাকে না। কোন অ্যারিস্টোকেসির বাঁধনে বর্ষা থেকে গান, গান থেকে কবিতা, খিচুড়ি থেকে ইলিশ মাছ ভাজা --কোনও কিছুই আটকে পড়ে থাকে না।