নেশা

রাত একটা বাজে ।।স্ট্রীট লাইটের আলোয় দেখা যাচ্ছে রাস্তার দুপাশে সারি সারি রঙিন ফুল ফুটে রয়েছে।ফুটপাথের দুধারে দুটো কাগজ ফুলের গাছ।এই সব পেরিয়ে ফুটপাথের এক কোনে , যেখানে আলো পৌঁছয় না সেখানে লাদেন শুয়ে আছে।LED রাস্তার আলোর গবেষণা ও উন্নয়নের অগ্রগতি - জ্ঞান - Shenzhen Benwei  Lighting Technology Co., Ltd
গায়ে ময়লা ছেঁড়া জামা ।জীর্ণ প্যান্টে দীর্ঘদিন ময়লা বসে বোঝার উপায় নেই তার রঙ ।প্যান্টে বেল্টের বদলে একটা দড়ি বাঁধা।কোনো স্বাস্থ্যবান দয়া করে জামা প্যান্ট দান করেছে।কিন্তু লাদেনের রোগা শরীরে তা কাকতাড়ুয়ার মতো লাগছে।   
লাদেন জানে না কোথায় টুইন টাওয়ার্স।লাদেন তার মাতৃভূমির নাম ভারতবর্ষ সেটাই জানে না।সে জানে ইন্ডিয়া।কোনো পাড়ার ক্লাবে যখন প্রজেক্টার লাগিয়ে খেলা দেখানো হয়।যখন সবাই চ্যাঁচ্যাঁয় ‘ইন্ডিয়া,ইন্ডিয়া’।সুযোগ পেলে তখন লাদেনও তাদের সঙ্গে গলা মেলায়।পাকিস্তান হারলে বাজি ফাটে।বাজির আওয়াজ শুনতে লাদেনের খুব ভাললাগে । 
লাদেন জানে না ভারতবর্ষের প্রতিবেশী দেশ কারা। শত্রু দেশেরও খবর রাখে না।সে নামাজ পড়ে না। মন্দিরে যায় না।গির্জাতেও যায় না।ভবঘুরে হাভাতেদের যখন ভোট দেওয়ার অধিকার নেই তখন তার ধর্ম নিয়েও কেউ মাথা ঘামায় না।তার কাছে যে খেতে দেয় সেই রাজা।লাদেনের সব থেকে বড় শত্রু তার পেট।আর পেটের মধ্যে গুরগুর করতে থাকা একটা প্রশ্ন “লাদেন নামটা তাকে কে দিল?জন্মে কখনও তার মা বাবার কথা মনে পড়ে না।একেক সময় মনে হয় রাস্তাই তার বাপ মা । তাই তো রাতের বেলায়  তার সঙ্গে রাস্তাও জেগে থাকে ।
লাদেনের চোখে মাঝে মাঝে ঝিমুনি নেমে আসে।“কিরে রাস্তা তোর বাপের জমিদারি নাকি?জানিস না এখানে ফুটপাথে শোয়া বারণ।ওঠ শালা।”সজোরে একটা বুটের লাথি খেল লাদেন। ধরমর করে উঠে বসে চোখ কচলায় “স্যর চোখ লেগে গেছিল।” 
“শালা চোখ লাগার আর জায়গা পাস না?খাবি,ঘুমবি,এখানেই মুতবি হাগবি।সরকার কি তোদের গু মুত পরিষ্কার করার জন্য আমাদের রেখেছে?ভাগ শালা।”
A person laying on the ground under a street light photo – Free Light Image  on Unsplashএকটু দূরে দাঁড়ানো গাড়ি থেকে আরেকজন পুলিশ অফিসার নেমে আসে “কি হল হীরেন মালটা কোথাকার?”
“স্যার আগে তো মালটাকে দেখিনি?এই কোথা থেকে এসেছিস?”
লাদেন মাথা চুলকোয় “স্যর অত দিনক্ষণ দেখে তো আসিনি।যেখানে ভালোলাগে ওখানেই থেকে যাই।এই অন্ধকারটাতে শুয়ে থাকি । কারোর কোন ক্ষতি করি না স্যর।” 
“ক্ষতি কি ওভাবে বোঝা যায়?ক্ষতি না হোক ক্রাইম তো করেইছিস । 
“কি বললেন স্যর বুঝলাম না।” 
“এখানে ফুটপাথে শুলেও অপরাধ।তা তোর নামটা কী?”
লাদেন এবার নড়ে চড়ে বসে “আমার নাম লাদেন।”
“হীরেন ,বলে কি লোকটা? নামের ওজন আছে তো বেশ ।অপরাধ যখন করেছিস তখন শাস্তি তো পেতেই হবে।”
লাদেন চমকে ওঠে “অপরাধ!আমি তো কাউকে গুলি করিনি।এই রাস্তার নামে দিব্বি করে বলছি আমি কখনও এই রাস্তার ধারে মুতিনি।পেট কনকন করলে ওই রাস্তার মোড়ে একটা পায়খানা আছে ওখানে গিয়ে করে আসি।আমার কাছ থেকে টাকা নেয় না।” 
“স্যার ,কী করব গাড়িতে তুলব ?”
পুলিশের বড় কর্তা তখন সিগারেটে সুখ টান দিতে ব্যস্ত ।ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন “ কি কেস দেবে হীরেন?” যাও বরং একটু হাল্কা হয়ে এসো ।”   
হীরেন ফিক করে হেসে ফেলল “ ঠিক ধরেছেন স্যার । অনেক্ষন ধরে পেয়েছে ।”হীরেন অন্ধকার ছারিয়ে  কিছুটা আলোর দিকে হেঁটে গেল। স্ট্রীট লাইটের আলোয় লাদেন শুধু পুলিশবাবুর পিছনটা দেখতে পাচ্ছে।
ধোঁয়ার কুণ্ডলী হাওয়ায় ভাসছে। সেদিকে তাকিয়ে লাদেন বলে “স্যর একটা দেবেন?আপনাকে দেখে ইচ্ছেটা বেড়ে গেল ।” 
বড়কর্তা একটা সিগারেট এগিয়ে চোখ নাচালেন “আজ কি নেশা জোটে নি?সিগারেটে চলবে?নাকি একটু অন্য কিছু আনিয়ে দেব?
লাদেন হাসছে “অনেকদিন খাইনি।গন্ধটা যা হেব্বি লাগে না!”
“হ্যাঁ হেব্বি লাগে বলেই তো সব বুঁদ হয়ে পরে থাকে সব।তা তুই এলি কোথা থেকে?বউ বাচ্চা নেই?”
লাদেন সিগারেটে একটা লম্বা টান দিল“আমি ভবঘুরে মানুষ।যেখানে জায়গা পাই সেখানেই থাকি।যার কোনো চালচুলো নেই , নিজেই আধপেটা খেয়ে দিন কাটায় তার বউ জুটবে কোথা থেকে স্যর?”ব্রিটেনে আধপেটা খেয়ে থাকছেন অনেকে, খাচ্ছেন একবেলা, ক্ষুধার্ত বহু  শিশু,কারণটা কী? - Millions forced to skip meals as UK cost of living crisis  deepens, ঘরে বাইরে নিউজ
এরমধ্যে হীরেন চলে এসেছ।“স্যার এদের বউ জোটে না কিন্তু ব্যাটা এক দুটো প্রেম করেনি, এ হয় না।”
লাদেন এবার খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে উঠল “ভুখা পেটে প্রেম হয়?অবশ্য ভুখা শরীর, শরীর পেলে পেটের খিদেটা কিছু সময়ের জন্য ভুলে যায়।” 
“দেখেছেন স্যার রস কম নেই।স্যার পেটে গোঁত্তা মারলে আরও অনেক খবর বেরবে।”
লাদেন পেটে হাত দিয়ে বলে “ফাঁকা পেট সার । পেটে খাবার গেলে কিছু কথা বেরলেও বেরতে পারে।”
বড়বাবু হীরেনের দিকে তাকিয়ে বলল “ভেরি ক্লেভার।যাও স্টেশন রোড থেকে কিছু খাবার নিয়ে এসো । তাছাড়া এখন কোথাও দোকান খোলা পাবে না ।গাড়িটা নিয়ে যাও।” 
হীরেন অবাক হয়ে বলে “স্যার আপনি একা থাকবেন এই লোকটার সঙ্গে?”
“না থাকার কি আছে?তুমি আমাকে ভীতু ভাবছ নাকি হীরেন?তাছারা ভুলে যেওনা আমার সঙ্গে রিভাল্বার আছে।” লাদেনের দিকে তাকিয়ে বলল “কিছু বেচাল  দেখলেই এনকাউন্টার করে দেব।কতগুলো এনকাউন্টার করেছি জানো যদু?”
লাদেন পিছন চুলকাতে থাকে ।ভয়ে ভয়ে দুদিকে মাথা নাড়ল । তার মানে সে জানে না । 
হীরেন গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে বলল “আধা ঘণ্টার মধ্যেই আসছি স্যার।”
বড়বাবু আরেকটা সিগারেট এগিয়ে দিলেন লাদেনের দিকে “খাবার তো আসছে।এবার  তোমার শরীরের খিদের গল্প শুনি।”
সিগারেটে বার কয়েক ধোঁয়া উড়িয়ে লাদেন আলোর দিকে তাকাল “স্যর আমার দুটো নেশা।পয়সা পেলে 
ডেন্ড্রাইট কিনি।আরেকটা নেশাও আছে পরে তার কথা বলব।আগে বিমলির কথা বলি।” 
“বিমলি ওর বাচ্চাটা ভাড়া দিত।যারা রাস্তায়  ছেলে কোলে নিয়ে ভিক্ষা করে ওদের কোলে সারাদিন বিমলির ছেলেটা ঘুরে বেড়াত।যাওয়ার আগে ছেলেটাকে দুধের সঙ্গে দুফোঁটা মারি মিশেয়ে খাইয়ে দিত।ব্যাস ছেলে সারাদিন ঘুমাত ।দিনের একশ টাকা পেত বিমলি।বিমলি সারাদিন বাসে বাসে ঘুরে এর ওর পকেট কাটত । আমি একবার ওর হয়ে মার খেয়েছিলাম।সে বেদম মার।তার থেকে আমায় পুলিশে দিলে ভালো হত।কিন্তু শালা পাবলিক যদি একবার পকেটমার হাতে পায় তাহলে হাতের মনের সব ঝাল মিটিয়ে নেয় ।কদিন খুঁড়িয়ে হাঁটতে হয়েছিল।”
লাদেন হাত ঘষল “আমার মার খাওয়া দেখে বিমলি আমার প্রেমে পড়ে গেল।ওর বর বাচ্চা পয়দা করেই  গায়েব।আর আমার নেই চাল চুলো।রাস্তার ধারেই পেলাস্টিক টাঙ্গিয়ে বিমলি থাকত।আমারও আস্তানা জুটে গেল।দিনে ভাত খাচ্ছি ।রাতে বিমলিকে খাচ্ছি।দুমাস যেতেই একদিন রাতে বিমলি আমাকে গরম খুন্তি দিয়ে মারতে আসে।আমার জন্য নাকি আবার পেটে বাচ্চা ধরেছে।বলুন তো স্যর কোনো মানে হয় আমায় ওভাবে মারার?বরং ভালোই তো আরেকটা বাচ্চা হলে সেটাকেও ভাড়াতে খাটাত ।ডবল ইনকাম।”  
বড়বাবু লাদেনের গালে একটা চড় কসিয়ে বলে “শালা জিন্দেগিতে বদলাবি না তোরা।তারপর কী হল?” 
লাদেন গালে হাত বুলিয়ে বলে “আমার কাছে পেট খালাস করার  পয়সা চাইছিল । আমি কোথায় টাকা পাবো বলুন স্যর?শুনল না।আমায় ঘর থেকে বের করে দিল।বলল তিনদিনের মধ্যে পয়সা জোগার করতে হবে।” 
বড়বাবু হাসছে “শালা ফুর্তি করতে গিয়ে ফেঁসে গেছে।”
“স্যর আপনি ফাঁসলে কী করতেন?”
বড়বাবু উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন “আমি আজ পর্যন্ত কোথাও ফাঁসিনি।তুলিকা রায় একটু জ্বালিয়ে ছিল।আমার সুপারিশে চাকরিটা হল।আর আমার সঙ্গে শুতেই আপত্তি।না শুয়ে উপায় ছিল না তুলিকার।চাকরিটা খেয়ে ফেলতাম।বাড়ির একমাত্র আর্নিং মেম্বার, যাবে কোন চুলোয়?একমাস ধরে বিছানায় এমন রগড়ে ছিলাম।একদম ফ্রেশ মাল।এঁটো মালে মজা নেই।মনে হচ্ছিল আমার পঞ্চান্ন বছর বয়সেও নতুন যৌবন এসেছে। তুলিকার পেটে যে বাচ্চা আসবে কী করে জানব!আমাকে বিয়ে করার জন্য চাপ দিচ্ছিল ।কিছুতেই বাচ্চাটা নষ্ট করবে না।”
বড়বাবুর চোখ কুঁচকে গেছে “আমার সাজানো গোছানো সংসার।বউ স্কুল টিচার, ছেলে দিল্লীতে পড়াশুনো করে।একদম সুখী পরিবার।আমি পরিবারের গায়ে আঁচ লাগতে দিনি।একদিন তুলিকার পেটে এমন লাথি মারলাম যে বাচ্চাটা গলে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছিল।রক্তের বন্যা।তার দশ দিনের মধ্যে তুলিকা সুইসাইড করে।”      
লাদেন বড়বাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে আবার মুখ নিচু করল।“আমি বিমলির জন্য চুরি করতে গেছিলাম এক দোকানে।চুরির আগেই মেরে ভাগাল।সারাদিন কিছু খাওয়া নেই।” 
 লাদেন এবার পা ছড়িয়ে আরাম করে বসে বলতে শুরু করল “সেদিন খুব বৃষ্টি।বিমলির ঘরের পিছনে একটা বড় গাছ আছে।ওখানেই দাঁড়িয়ে ছিলাম।পাশে বড় নালা  দিয়ে হুরহুর করে জল যাচ্ছে ।হঠাৎ বিমলি এসে হাজির। আমায় বললে আমি নাকি  ভীতুর মতো এখানে লুকিয়ে আছি।খুব রাগ হল।আমি ভীতু নই । বিমলিকে এক ধাক্কা দিয়ে বড় নালীতে ঠেলে ফেলে দিলাম।জলের তোরে কোথায় ভেসে চলে গেল।ওর ঘরের বাচ্চাটাকেও ভেবেছিলাম ফেলে দেব।কিন্তু যে ছোট থেকেই ব্যবসা শিখে গেছে।সে বড় হলে অনেক বড় মানুষ হবে।তাই না স্যর!তাই পাঁচ হাজার টাকায় বেচে দিলাম।”শান্তির বাজার জেলা হাসপাতালে একইসাথে তিনটি বাচ্চার জন্ম দিল মহিলা – Jagaran  Tripura – Bangla News, Bengali News, Latest Bengali News, Tripura News,  North East News
বড়বাবু লাফিয়ে উঠেছেন “তুই একটা খুনি, ক্রিমিনাল।বাচ্চাটাকে বিক্রি করে দিলি!” 
স্যর এটা খুন নয় এটা একটা এক্সিডেন্ট।শাস্তি দিয়েছিলাম মুদি দোকানের মালিককে।রোজ লাথি মারত । আমি শুধু রাতের বেলায় দোকানের সামনে ঘুমতাম।সকালেই চলে যেতাম।একদিন কুকুরে গু করেছিল। বলে নাকি আমি করেছি।আমার পেট ভালো স্যর।কুকুরের সেদিন মনে হয় পেট খারাপ করেছিল।কিন্তু আমার কথা শুনল না।খুব মারল।আর সব আমায় পরিস্কার করতে হল।আমি সেদিন নতুন একটা ব্লেড কিনেছিলাম । রাতে যখন বাড়ি ফিরছিল আমিও দিলাম তার গলায় চালিয়ে।গলার নুলি কেটে দুভাগ।যতক্ষণে সবাই টের পেয়েছে।ততক্ষনে শেষ।আমি কিন্তু শেষ যাত্রায় পিছু পিছু গেছিলাম ।”
“ও মাই গড।এই তো তিনমাস আগের ঘটনা, বিধান পল্লির মুদিদোকানের  মালিক খুন হয় ।কাউকে ট্রেস করা যায়নি।তুই খুন করেছিস?”বড়বাবু  ততক্ষনে মোবাইলে খুঁজছেন কিছু।গলার নুলি কেটে আরও দুটো খুন হয়েছে গত মাসেই । 
“না বড়বাবু খুন নয়।আপনি বললেন না অপরাধ করলে শাস্তি পেতেই হবে।আমাকে যে বিনা কারনে এত মারল সেটা অপরাধ নয়!আমি তো তার শাস্তি দিলাম।”  
বড়বাবু কাউকে ফোন করতে যাচ্ছিলেন।কিছু বোঝার আগেই লাদেন ততক্ষনে বড়বাবুর ঠিক পিছনে।নতুন ব্লেডে নুলি কাটতে সময় লেগেছে কয়েক সেকন্ড।বড়বাবুর রিভাল্বার ততক্ষনে লাদেনের হাতে।“আমি গুলি করব না স্যর ।আপনার হাতদুটো শুধু বাঁধব।আসলে আপনাকে আমার আরেকটা নেশার কথা বলা হয়নি।”
 বড়বাবু ছটফট করছেন।লাদেন তার সামনে দাঁড়িয়ে বলে “স্যর আমাদের দুজনেরই মনে হয় রক্ত দেখতে খুব ভালোলাগে।ওটাই আমাদের নেশা।স্যর শুধু আপনার নেশাটা কেউ জানতে পারে না।”
                           

  • অ্যাঞ্জেলিকা ভট্টাচার্য