চৈতন্যদেব ঘিরে নতুন ভাবনা

যুগাবতার চৈতন্য ‘মহাপ্রভু’-র সঙ্গে পরিচিতজন কিংবা তাঁর ভক্তসমাজ কি আজ প্রায় পাঁচশো বছর পরেও তাঁর আকস্মিক অন্তর্ধানের প্রকৃত বৃত্তান্ত সম্পর্কে অবগত? সেযুগের চৈতন্য ঘনিষ্ঠজনের কাব্যকথাতেও তাঁর জীবনচরিত এক পর্যায়ের পর থমকে যায়। মহাপ্রভু নিমাইয়ের তত্কালীন শিষ্যসমাজ, এমনকি পরবর্তী বৈষ্ণব পদকর্তারাও তাঁর জীবনের অন্তিম পরিণতি বিষয়ে নীরব থেকেছেন। স্বভাবতই তাঁর জীবনাবসান বৃত্তান্ত ঘিরেও প্রভূত বিতর্ক সহযোগে ‘নানা মুনির নানা মত’ প্রচলিত হয়েছে। চৈতন্যের আবির্ভাবকালে বাংলার আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি, তাঁর পরিবার, বিবাহ, সন্ন্যাসগ্রহণের কথা বৈষ্ণব চরিতকারদের বর্ণনা থেকেই মোটামুটি ধারণা করা যায়। সন্ন্যাস গ্রহণের পর রাধাকৃষ্ণের মাহাত্ম্যপ্রচার, সংকীর্তন কিংবা কৃষ্ণযাত্রা করে গিয়েছেন নিরন্তর। তুর্কি আক্রমণ পরবর্তী বাংলায় তখন শাসকের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হিন্দুসমাজ ক্রমে ধর্মান্তরিত হচ্ছিল। হিন্দুরাও ছিল নিজেদের মধ্যে অন্ধ বর্ণভেদে আক্রান্ত। সেই বহুভাগে বিভক্ত হিন্দু সমাজকে কূপমন্ডূকতা থেকে বের করে এনে মানবতাবাদী আদর্শ বৈষ্ণব ধর্মে ঐক্যবদ্ধ করতে চেয়েছিলেন নিমাই। অস্ত্র ছিল এ বাংলারই পূর্বতন রাধা-কৃষ্ণগাঁথা। নবদ্বীপে তাঁর আন্দোলন মাত্র এক বছরের। ১৫১০-এ ওড়িশায় চলে যাওয়ার পরের ঘটনাবলি বিষয়ে আজও ভক্তসমাজের অধিকাংশই হয়অন্ধকারে আছেন, নয় কোনো অপব্যাখ্যায় বিশ্বাস করেছেন। উত্কল রাজ্যে প্রায় তেইশ বছর ছিলেন চৈতন্যদেব। এই বাংলার অনুগামীদের অনেকের সঙ্গেই তাঁর যোগাযোগ ছিল তখনও। জানা যায়, তাঁর অন্তর্ধানের সময়েই নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন তাঁর অন্যতম ছায়াসঙ্গী স্বরূপ দামোদর এবং কিছুদিন পরে গদাধর চট্টোপাধ্যায়।নীলাচলে(অধুনা পুরী) তাঁর দীর্ঘকালীন জীবনের কথা স্বল্পই জানা যায়। সেক্ষেত্রে স্বভাবিকভাবেই ওড়িয়া বৈষ্ণব কবিদের রচনা চৈতন্যদেবের উত্কল পর্বের কথা জানতে পারার সূত্র হতে পারতো। কিন্তু বহুকাল আগেই ওড়িয়া সাহিত্যেরবৃত্তান্ত এই বাংলার বৈষ্ণব সমাজের চাঁইদের সমর্থন পায়নি। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে ‘মহাপ্রভু’-র বিলীন হয়ে যাওয়ার কথাই তাঁরা অধিক বিশ্বাসযোগ্য মনে করেছেন। এছাড়াও চৈতন্যের অন্তর্হতির বিষয়ে পরবর্তীকালে যেকোনো গবেষণাই তাঁরা নাগাড়ে নাকচ করে গিয়েছেন। উত্কল রাজ্যেথাকাকালীন তিনি পুরীর জগন্নাথ বিগ্রহে বিলীন হয়েছিলেন, নাকি ভাবোন্মত্ত অবস্থায় জলে ডুবে যান, নাকি পুরীর জগন্নাথ উপাসক পান্ডাদের হাতে নিহত হয়েছিলেন, নাকি পায়ের পাতায় কোনো বিপজ্জনক আঘাতে তাঁর মৃত্যু, নাকি স্বেচ্ছা নির্বাসন চেয়েছিলেন নিমাই? আরো হরেক সম্ভাবনারই তথ্যপ্রমাণসহ বিশ্বাসযোগ্য কোনো উত্তর আজও অধরা। 

  সম্প্রতি হস্তগত হওয়া ‘চৈতন্য শেষ কোথায়?’ বইটিতে চৈতন্যদেবের জীবন ও পরিণতি সম্পর্কে সকল সন্দেহ নতুন করেনিরসনের চেষ্টা করেছেন লেখক রজত পাল। পেশায় না হলেও নেশায় তিনি ঐতিহাসিক। এই গ্রন্থে লেখক শুধুই ‘মহাপ্রভু’-র অন্তর্হতিকালীন অনুসন্ধান করেছেন তা নয়, বরং ১৪৮৬ সনে তাঁর আবির্ভাবকাল থেকে ১৫৩৩ সনে তাঁর অন্তর্ধানকাল পর্যন্ত সময়কেও তিনি ইতিহাসজিজ্ঞাসুআতসকাঁচের তলায় রেখেছেন। কিছুটা রীতি বহির্ভূত ভাবেই লেখক গ্রন্থের প্রারম্ভে সমস্ত প্রামাণ্য গ্রন্থাবলি ও তথ্যভান্ডার পাঠকদের সমক্ষে সাজিয়ে দিয়েছেন এবং কারণ হিসেবে বলেছেন, “..পুঁথি ও পুস্তক ছাড়া তাঁর জীবনেতিহাস পুনর্নির্মাণ করা সম্ভবপর নয়। উপরন্তু এত সুধী ও গুণীজন তাঁর জীবন নিয়ে কাজ করেছেন যে নতুন কিছু কথা বলা তাঁদের লেখার রেফারেন্স ছাড়া প্রায় সম্ভব নয়।” একাধারে বর্ণময় ও বিতর্কিত চৈতন্যজীবন বিষয়ে অতীতে বহু গবেষকজনই যে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন এবং তাঁদের তাঁদের মতো করে উপাদান সংগ্রহ ও তত্ত্বতালাশ করেছেন, সেকথা অনস্বীকার্য। আজকের বাঙালি বৈষ্ণব সমাজে যে গড়পড়তা চৈতন্য জীবনকথা প্রচলিত, তা মূলত বৃন্দাবন দাস, লোচন দাস, কৃষ্ণদাস কবিরাজ, কবি কর্ণপুর,মুরারি গুপ্তের মতো চৈতন্যঘনিষ্ঠজন অথবা শিষ্যসমাজ রচিত চৈতন্যসাহিত্যগুলি থেকেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যে কাহিনীগুলির একটিও সঠিক ঘটনাবলিসহ সম্পূর্ণ নয় কিংবা সম্পূর্ণ হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চৈতন্যের জীবনাবসান পর্বটি আধ্যাত্মিকতায় আচ্ছাদিত থেকেছে। একাধিক জীবনকথায় রচনাকারগণ তাঁর অবতারত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করতে কখনো ঘটনাকে রটনা করেছেন, আবার কখনো রটনাকে ঘটনা। তাই তথ্যনিষ্ঠ ও সামগ্রিক চৈতন্য জীবনকথা আধুনিক গবেষণার পূর্বে প্রায় ছিলনা। পরবর্তীকালে বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে দীনেশচন্দ্র সেন, সুকুমার সেন, বিমানবিহারী মজুমদার, শশিভূষণ দশগুপ্ত, বিজিতকুমার দত্ত, প্রভাত মুখোপাধ্যায়, জয়দেব মুখোপাধ্যায় প্রমুখ পণ্ডিতজন চৈতন্য অন্তর্ধান সম্পর্কিত গবেষণার কাজ এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। তাঁরা যেমন চৈতন্যসাহিত্যগুলির বয়ান বিচার করেছেন, তেমনই তাঁর বাংলা ত্যাগ করার পরে নীলাচল পর্বেরও সত্যাসত্য বিশ্লেষণ করে দেখেছেন।

  ওড়িশার বিখ্যাত পঞ্চশখা সম্প্রদায়ের সাধক কবি অচ্যুদানন্দ দাস তাঁর ‘শূন্যসংহিতা’ গ্রন্থে জানিয়েছিলেন, তিনি ১৫৩৩ সনের ২৬শে এপ্রিল তারিখে পুরীর জগন্নাথ বিগ্রহের সঙ্গে তাঁকে মিশে যেতে দেখেছিলেন। গোবিন্দদাস বাবাজীর ‘চৈতন্যচকড়া’-তেও মোটামুটি ভাবে একই বিবরণ পাওয়া গেলেও, তিনি ১৫০৪ সনের কথা উল্লেখ করেছেন। রায় রামানন্দ নামে নীলাচলের একজন বৈষ্ণব সাধকের বক্তব্য থেকে আরেকজন চৈতন্য জীবনীকার মাধব পট্টনায়ক জানিয়েছিলেন, পায়ে ইঁটের আঘাত থেকেই শরীর বিষিয়ে গিয়ে চৈতন্যদেবের মৃত্যু হয়। এই পরস্পরবিরোধী বক্তব্যগুলিই ‘নানা মত’ হয়ে প্রচলিত ছিল বা আজও আছে।পরবর্তীকালে বৈষ্ণবদাস তাঁর ‘চৈতন্যগৌরাঙ্গ চকড়া’ গ্রন্থে দাবি করেন, তিনি স্বচক্ষেইনিমাইয়ের মৃতদেহ প্রত্যক্ষ করেছিলেন। কোনো এক পূর্ণিমা তিথিতে জগন্নাথ বিগ্রহের গায়ে চন্দনলেপনের সময়ে ভাবোন্মত্ত অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়, কোনো সন তারিখের উল্লেখ সেখানে ছিলনা। আধুনিক কালের চৈতন্য গবেষকদের মধ্যে মেলভিল কেনেডি, প্রফুল্ল সরকার কিংবা রমাকান্ত চক্রবর্তীরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে, নীলাচলের সমুদ্রসৈকতে ভাবোন্মাদ অবস্থাতেই তাঁর মৃত্যু হয়। এছাড়াও অমূল্যচরণ সেন, বিমানবিহারী মজুমদার কিংবা দীনেশচন্দ্র সেন মনে করেছেন, জয়ানন্দের ‘চৈতন্যমঙ্গল’ কাব্যের বয়ানই সঠিক। অর্থাৎ কোনো এক রথযাত্রায় চৈতন্যদেব পায়ে ইঁটের আঘাত পান এবং পরে সারা শরীর বিষিয়ে গিয়ে আষাঢ় মাসে এক ভক্তের বাগানবাড়িতে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। অপরদিকে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, নীহাররঞ্জন রায়ের মতো গবেষকগণ বিশ্বাস করেন, নীলাচলেই ধর্মীয় ও রাজনৈতিকস্বার্থে নিমাইকে খুন করে সমাধিস্থ করাহয়। যে সমাধির খোঁজ আজও পাওয়া যায়নি। তাই মধ্যযুগের বাঙালি যুগাবতার চৈতন্যদেবের অন্তর্ধান রহস্য স্বাভবিকভাবেই কোনো এক দুর্ভেদ্য পর্দাবৃত থেকেছে এতকাল।বাংলা ও ওড়িশার ধর্মীয় চাঁইদের ভূমিকাএক্ষেত্রে কী? প্রচলিত সকল বয়ান ভক্তমন বিশ্বাস করলেও তা কতটা তথ্যপ্রমাণ নির্ভর? বিমানবিহারী মজুমদার তাঁর ‘রসরাজ’ গ্রন্থের প্রথম ফর্মার সবটুকু স্বেচ্ছায় জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন কেন? ‘কাঁহা গেলে তোমা পাই’-য়ের রচয়িতা জয়দেব মুখোপাধ্যায় তাঁর গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশের আগেই ১৯৯৫ সালে পুরীতে আকস্মিকভাবে নিহত হলেন কেন? ‘মহাপ্রভু’-র অন্তর্ধান রহস্য সমাধানে তিনি কি সত্যের খুব কাছাকাছিই ছিলেন? খুব স্বাভাবিক যে, এমত অপ্রীতিকর ঘটনার পর যেকোনো গবেষণারই অন্ধকার সময় আসে এবং গবেষকদের সত্যনিষ্ঠাও প্রাণভয়ের প্রশ্নের মুখে পড়ে!

  বর্তমানে ফের চৈতন্য গবেষণা কিছুটা প্রাণ পেয়েছে। গবেষক তুহিন মুখোপাধ্যায়ের ‘চৈতন্যের শেষ প্রহর’কিংবা সোমব্রত সরকারের ‘পাঁচ শিকের বোষ্টমী’ গ্রন্থের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। তবুও ‘মহাপ্রভু’-র অন্তর্ধান বিষয়ে বাঙালি সমাজে আজও কোনো তথ্যপ্রমাণ নির্ভর অকাট্য তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। দীর্ঘকালীন এই গবেষণার ধারাতেই ঐতিহাসিক রজত পালের ‘চৈতন্য শেষ কোথায়?’ নবতম সংযোজন। উল্লেখযোগ্য ভাবে পূর্বপ্রচলিত সকল সন্দেহ, সম্ভাবনাই লেখক আলোচনা, বিশ্লেষণ করেছেন। কখনো গ্রহণ করেছেন, কখনো বর্জন করেছেন। মহাপ্রভুর অন্তর্ধান এবং তত্পরবর্তী চৈতন্যজীবনের কোনো নতুন অধ্যায়ের দেখা পেয়েছেন কি লেখক? বইটি হস্তগত হলে পাঠকমাত্রেরই সকল সন্দেহের অবসান হবে। তাই আশা করা যায়, লেখক রজত পাল কর্তৃক এই জটিল ও সাহসী অনুসন্ধান নিশ্চিতভাবেই বাঙালি পাঠকসমাজের সমাদর পাবে।    

                                                                                           

চৈতন্য শেষ কোথায়?

লেখক-   রজত পাল

প্রকাশক- অভিযান পাবলিশার্স

দাম-     ৫০০ টাকা

  • কুনাল রায়