হাতি মাহুতের পৃথিবী আর গঞ্জ হাটের লোকগল্প

 
আর সেই নদী গঙ্গাধরের চরে চরে হাঁটতে হাঁটতে কত কত ভাবনাই যে ভাবতে হয়!ভাবনা স্থির থাকে না।সে একরকমভাবে শুরু হয়।আর গতিপথ বদলাতে বদলাতে চিরনুতনের দিকে চলে যেতে থাকে।ইয়াকুব ব্যাপারীর দুই চোখে আকাশের নীল ছায়া ফেলে।বালুবাড়ি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ইয়াকুব খুব পুরোন কোন এককালে শোনা একটা গানকে নিজের খুব গহিনে টেনে নিতে থাকে_
'ও মোর সারিন হাতির মাহুত রে
যে দিন মাহুত জঙ্গল যায়
নারীর মন মোর কান্দিয়া রয় রে"
এই গান থেকে কি তীব্র এক মনকেমণের  ছবি উঠে আসে। নদীপাড়ের মানুষের যাপনের দুঃখ,যন্ত্রণার ছবি ক্রমে বিচুর্ণ হয়ে উঠতে থাকলে ইয়াকুব ব্যাপারির মনে পরে ছত্রশালের হাটে আলাউদ্দিন এমেলের ভোটের জুলুসের কথা!সে এক মজার নির্বাচনী সভা।ইয়াকুব ভাবে,এ কেমন ভোটের মিটিং!কেননা আলাউদ্দিন এমেলের মিটিঙে তো কোন ভাষণ থাকে না।বাইরে থেকে আসা কোন নেতার ঘর তো সেই সভায় থাকে না!থাকে খালি গান আর গান।ঢোল আর বাঁশি।আলাউদ্দিন মাস্টার নাকি আলাউদ্দিন এমেলে নাকি আলাউদ্দিন গিদাল হাতে দোতরা নিয়ে;দোতরা বাজাতে বাজাতে কোমরে নাচ নিয়ে গাইতে থাকেন গানের পর গান।লোকগান।মাটি ছুঁয়ে বেঁচেবর্তে থাকা সহজ সরল মানুশের প্রানের গা।জীবনের গান।মানুষ ঘিরে ধরে এক ভোটের নাকি গানের মিটিং!আর ভোটের পরে দেখা যায় আলাউদ্দিন এমেলে এক্কেবারেই পাশ।কি আজব কিসিমের মানুষ ছিলেন এই আলাউদ্দিন মাস্টার!সারাজীবন লোকগান আর মানুষের ছায়ায় ছায়ায় কাটিয়ে দিয়েছেন তিনি তার জীবন।লিখেছেন গানের পর গান।গঙ্গাধরের চর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ইয়াকুব আচমকা উদাস হয়ে যান।তার চোখ জুড়ে জলের মত কিছু একটা বুঝি আসতে চায়!আর চরের উত্তর শিথান থেকে ভেসে আসে আলাউদ্দিন গিদালের গানের সুর_
 
‘হাত্তি মার্কা কেরাসিন তেল
 
কায় বা আইনছেন দ্যাশতে
 
বাপ রে বাপ মাও রে মাও
 
মোর গাও ঝমঝম করে রে’
 
বিকেল ক্রমে ঘন হতে থাকে।আর গান গড়াতেই থাকে।
শেষ বিকেলে জমে ওঠা তামারহাটের মস্ত ভিড়ের মধ্যে নেমে যেতে যেতে মহিউদ্দিন ওস্তাদের মনে পড়ে যায় গৌরীপুরের সাচি পান আর গোলকগঞ্জের গুয়ার কথা।তার জিভে আটকে থাকা সেই পান আর গুয়ার স্বাদের আহ্লাদ তাকে বিমনা করে তোলে।তার শরীর জুড়ে কেমন এক নাচের ছন্দ চলে আসে।সে হাটের ভেতর নিজেকে ছড়িয়ে দিতে দিতে কন্ঠে গান নিয়ে দু’চার পাক নেচেই ওঠে!হাটের মানুষ তার গান শোনে,শুনতেই থাকে;হাটের ব্যাপ্ততা হাটের ব্যাস্ততায় নুতন এক হাট জেগে উঠতে থাকে।হাট বুঝি গানের হাট কিংবা নাচের হাট হয়ে ওঠে!মহিউদ্দিন মাস্টার তকন গেয়েই চলেছেন গঞ্জহাটজনপদের খুব গহন থেকে উঠে আসা গান_
 
‘ও কি বাপ রে বাপ
 
ও কি হায় রে হায়
 
এল্যা কেনে আসিলুং মুই গৌরীপুরের হাট’
তখন হাটের চারদিক থেকে গোয়ালপাড়ার উন্মাদ করে দেয়া কাঠিঢোল বাজতে থাকে।সারিন্দা বাজাতে বাজাতে দীননাথ বর্মণ তার বাবড়ি ছাটা চুলের আন্দোলনে হাটের মধ্যে নুতন এক রঙ্গিলা হাট জাগিয়ে তুলতে থাকে।ধনকান্ত বড়ুয়া তার বাঁশিতে সাজিয়ে দিতে থাকেন অদ্ভূত এক ম্যাজিক।এক মায়া থেকে আমরা দেখি জীবন জুড়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকা মায়াসমুদ্র।মহিউদ্দিন গানে গানে তার জীবনকে কিছুটা বুঝি গঞ্জ আর হাটের ঢলেই বিছিয়ে দিতে থাকে,কেননা এ ছাড়া তার আর কোন উপায় নেই।নিয়ন্ত্রণহীন পরিসরে একটা অবসাদের বিলাপের বিষণ্ণতার গোলকধাঁধায় মহিউদ্দিন তার সমস্ত গান,নাচ,সঙ্গীসাথী নিয়ে ক্রমে প্রবেশ করতে থাকে।
 
এই পর্বে আমরা কিন্তু ইয়াকুব ব্যাপারিকেও দেখে ফেলি।কেননা,ইয়াকুব তখন হন্তদন্ত প্রবেশ করতে চাইছেন মহিউদ্দিন ওস্তাদের গানের ভুবন আর তামারহাটের গানবৃত্তান্তের খুব খুব ভেতরেই!
ইয়াকুব ব্যাপারী আর মহিউদ্দিন ওস্তাদের দেখা হয়।হয়তো দৃষ্টি বিনিময় হয় তাদের।কিন্তু কোন কথা হয় না।হাট তখন কেন্দ্রচ্যুত হয়ে টুকরো টুকরো ভাবে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।হাটের মধ্যে জেগে ওঠে কত কত রকমের হাট।ইয়াকুব চলে যায় তামাকহাটির দিকে।আর মহিউদ্দিন ধানহাটির গহিনে মিলিয়ে যেতে থাকেন।আমরা ঠিক তখন দেখে ফেলি আসারিকান্দির লোকমান পাগেলা কে। সে তখন মাথায় গামছার পাগড়ি বেন্ধে চুপচাপ বসে আসে গিয়াস হেকিমের হেকিমি ওষুধ বিক্রির জমায়েতে।আসলে ওষুধ নয়।তার আগ্রহ গিয়াস হেকিমের ওষুধ বিক্রির ফাঁকে ফাঁকে দুলে দুলে গান করবার প্রতি।
আশেপাশের বিশ তিরিশ হাটে আজ প্রায় তিন কুড়ি বছর ধরে এভাবেই গান আর হেকিমী ওষুধ নিয়েই ছুটে চলেছেন গিয়াস হেকিম।এর আগে তার বাপের সাথে,তার বাপ আবার তার বাপের সাথে ঘুরে ঘুরে বেড়াতেন হাটে হাটে।গিয়াস হেকিম আর তার গান আর তার শিকড় বাকর ছাল বাকলার ওষধি সামগ্রী নিয়ে এক রঙ্গিলা জীবনের ভেতর কাটিয়ে যাচ্ছেন তার আয়ুষ্কাল।আমরা দেখতে পাই গিয়াস হেকিম
তার বাবরি ছাটা চুল দোলাতে দোলাতে গাইছেন_
"ছাড়িবার না পাং 
এই গানের মায়া"
গানের পর গান চলতে থাকে।গান থামে।কিছু কথা তথা হয়।ওষুধের গুণকীর্তন হয়।মজা গুয়া পান বিড়ি  তামাকু সেবন হয়।হাসি মস্করা হয়।লোকমান পাগেলা
শরীরের আড়মোড়া ভেঙে তার পেশিসমগ্রে একটা মত্ততা বইয়ে দিতে দিতে একটা নাচের তীব্রতা ক্রমে নির্মিত করতে থাকেন।গিয়াস হেকিম তখন দোতরা বাজিয়ে গাইছেন_
"গান গান করিয়া সর্বনাশ
তবু না মেটে গানের হাউস "
এইভাবে হাটের মধ্যে জেগে ওঠে নুতন এক হাট।
গ্রাম-বাংলার চিত্র (আমাদের কিশোরগঞ্জ) | Facebook
আর একসময় প্রসঙ্গ হারিয়ে কিরকম প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে থাকে লোকমান।লোকমান পাগেলা।চরে চরে বালাবাড়ির কাশিয়ার ঝোপে ঝোপে হাটগঞ্জের মস্ত পরিধির ভেতর ডুবে যেতে যেতে কত কত পুরাতন আর নুতন গল্প সে তুলে আনে।সাজিয়ে দেয়।ছড়িয়ে দেয়। হাটে হাটে লোকমান হাটুয়া পাইকার ব্যাপারীদের শোনায় সেই সব গল্প।মানুষ ভালোবেসে তাকে পাগেলা বলে ডাকে।লোকমানের বাবা নইমুদ্দিন ছিল পান গুয়ার দোকানি।গোলকগঞ্জের আর আসারিকান্দির হাটে সপ্তাহে তিন দিন তার দোকানদারি।বাকি চারদিন সে বিবাগী।কখনো গৌরীপুরের বড় রাজকুমারীর বেটা মৃণাল বড়ুয়ার সাথে গানবাড়িতে,কখনো লালজি রাজার হাতি ধরার ফান্দিদের দলে মিশে যাওয়া,কখনো আসগর বয়াতির পালাটিয়ার দলে ঢোল বাজানোর কাজে ডুব দেওয়া।এইভাবেই একটা জীবন কখন কিভাবে বুঝি ফুরিয়ে গেল।নইমুদ্দিনের ইন্তেকালের পর প্রায় হাজার মানুষের ঢল নেমেছিল তার জানাজায়।এসেছিলেন লালজি রাজা।রঘুনাথ মাহুত।বয়ান শেখ।
আজও,মরণের প্রায় চল্লিশ বছর পরেও মানুষের স্মৃতিতে খুব খুব বেঁচে আছেন নইমুদিন।লোকমানের রক্তেও বাপের রক্তের ধারা। পীরনানার জীন।
ঘুরে ঘুরে জীবন দেখার জীবন লোকমানের।গানের জীবন।নাচের জীবন।বাদ্য বাজনার জীবন।চিরকালের সব মানুষের গল্পের জীবন।আসলে মানুষ তো গল্প জড়িয়েই বেঁচে থাকতে চায়।
হাটের জমে ওঠা কিংবা ভাঙা হাটের স্তব্ধতার ভিতর লোকমান গতিয়েই দেয় না ফুরোন গল্পের ভাড়ার।
টোকন ব্যাপারী আর তার মত্ত হাতি জংবহাদুরের গল্পকে ভরা হাটে ডুবিয়ে দিয়ে লোকমান একমনে গুনগুন করে_
"ওরে কামাই কাজে যেমন তেমন
মানুষ মারার যম"
হাট এভাবেই লোকমান পাগেলার হাটে রূপান্তরিত হয়ে যেতে থাকে।
সব হাট কি একরকম!সোমবারের হাটের ভেতর কি খুঁজে পাওয়া যাবে বুধবারের হাট! তামারহাটের রঙের সাথে কি পুরোপুরি মিল থাকা সম্ভব রতিয়াদহ
হাটের!ছত্রশালের হাটের পাখিদের কি দেখা মেলে পানবাড়ির কোন এক শনিবারের হাটে!
সব হাট একরকম হয় না।সব গান একরকম হয় না।
সব গঞ্জ আর গাঙ একরকমের হতে পারে না।
প্রবেশ আর প্রস্থান দিয়ে এক একটি হাটপর্ব রচিত হতে থাকে।আর লোকমান পাগলার হাটে ধুলোর ঝড়সমেত ঢুকে পড়ে জোড়া মহিষ।গদাধর নদীর কোন বা চর থেকে বাথান ভেঙে এরা বুঝি চলে এসেছে এই হাটে ভেতরে।সমস্ত হাট জুড়ে একটা হুড়াহুড়ি লেগে যায়।মানুষের গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে মানুষ।তখন কোথায় ইয়াকুব ব্যাপারী কোথায় মহিউদ্দিন ওস্তাদ কোথায় লোকমান!ভরা হাটের কোলাহল থেকে সরে আসতে আসতে ময়কান্ত মৈশাল তখন খুঁজতে শুরু করে বাথান পালানো সেই জোড়া মহিষদের।তার হাতে দীর্ঘ পেন্টি।মাথা গামছা দিয়ে পাগড়ির মত করে বাঁধা।প্রায় তিন কুড়ির পেশীবহুল সুঠাম শরীরের পেশীগুলো একত্রিত করে 
ময়কান্ত তার কণ্ঠে তুলে আনেন মহিষের কণ্ঠের আকুতি।এই ডাক শুনে সেই জোড়া মহিষ কেমন থমকে দাঁড়ায়।তাদের বড় বড় চোখে কেমন মেঘের ছায়া!একটু বাদের দেখা যাবে সেই জোড়া মহিষ অদ্ভুত আহ্লাদ নিয়ে হেলে দুলে ময়কান্তর পিছনে পিছনে সেই বাথানের পথ ধরে ফেলেছে।গদাধর নদীর কোন বা চরের খুব অন্দর থেকে ভেসে আসছে 
হাহাকার ভরা গানের সুর_
"আরে ও  মৈষের  দফাদার ভাই
ডালা সাজাও ডালা সাজাও
চল মৈষের বাথানে যাই রে"
ময়কান্ত তার জোড়া মহিষ নিয়ে বাথানে চলে যেতে থাকে।কিন্তু হাট ভেঙে যায়।
ইয়াকুব ব্যাপারী মহিউদ্দিন ওস্তাদ লোকমান পাগেলাকে ভুলে গিয়ে আপাতত আমরা ঢুকে পড়তেই পারি বালাজানের হাটে।গঙ্গাধরের বাতাসে নদীর বালু উড়ে আসছে হাটের মস্ত খোলের ভেতর।শরীর ভরতি বালুকণা মেখে গরুহাটির উত্তর শিথানে
চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে সাজু  চোরা।না,সাজু চোর নয়।তার নাম সাজু মোহাম্মদ। হাটে হাটে গরুর দালালি করে বেড়ায়।আর "চোর চুন্নি" পালাগানে
সাজু চোরের ভূমিকায় অভিনয় করে।তার শরীরের পরতে পরতে তীব্র এক নাচের ছন্দ লুকিয়ে আছে।সাজু চোরার পালা দেখার জন্য মানুষ হামলে পড়ে গানবাড়িতে।সাজু মোহাম্মদকে এখন আর কেউ চেনে না।সবাই সাজু চোরাকে একনামে চেনে।সাজু যখন নেচে নেচে শরীরে অদ্ভুত পাক দিতে দিতে গেয়ে ওঠে_
"ও কি হায়রে হায়
হস্তীর পিঠিত চড়িয়া
আজি মনটায় মোর পিঠা খাবার চায়"
তখন সমগ্র গানবাড়ি জুড়ে কি এক উন্মাদনা!
সাজু চোরা ছিল গানমাস্টার মঈনুদ্দিন এর শিষ্য।
মঈনউদ্দিন আবার ছিল আলাউদ্দিন এমেলের সাকরেদ।সারাজীবন এই গান,এই নাচ,রাতের পর রাত গানবাড়ি নিয়েই জীবন কাটে সাজু চোরার।
গরুর দালাল সাজু চোরা গরুহাটির ভেতর দাঁড়িয়ে 
কি ভাবছিল!রহস্যমোড়া গানবাড়ির কথা।নাকি সওদাপাতি নিয়ে বাড়ি ফিরবার কথা!তার শরীর জুড়ে নাচের ছন্দ ক্রিয়াশীল থাকে আর হাটের অন্ত মধ্যে সাজু ছড়িয়ে দিতে থাকে গুনগুন সুরের কোন এক গান,যা দূরাগত হওয়ার ডানায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে সমস্ত হাটের পরিসরে_
"ওরে ফুলবাড়ীত ফুলমালার বাড়ি
হাট করিতে যামো হামরা গরুর গাড়িত চড়ি"
এইভাবে পুরোন হাটপর্ব শেষ হয়ে যায়।নুতন নুতন হাটগুলোর হাট হয়ে উঠবার জন্যই হয়তো বা!
এত এত হাট,এত এত গঞ্জ,এত এত নদীপরিধির ভেতর মানুষের বেঁচে থাকা।বেঁচে থাকতে থাকতে আবহমান এক জীবনকে বারবার পাল্টে পাল্টে দিতে থাকা।ইয়াকুব মহিউদ্দিন লোকমান সাজু চোরা আরো কত বর্ণময় আর বিচিত্র মানুষের সমাবেশ দিয়ে সেজে ওঠে গঞ্জহাটের এক চিরকালের ভুবনজোত।
এক হাট থেকে মানুষকে চলে যেতে হয় অন্য কোন হাটে।নুতন নুতন হাটে।নয় ফরেস্ট আর কুড়ি নদীর দুনিয়ায় কত যে হাট!
ইয়াকুব একবার পানবাড়ি হাটে গিয়ে ফেরার পথে পথ ভুলে গিয়েছিল।তাকে কি তবে ভুলায় ধরেছিল!
বগরিবাড়ির যতীন ডাকাতের সাথে দেখা হবার পর পরেই ইয়াকুব যতীন কে হাত ধরে নিয়ে গিয়েছিল চিকন চিড়ার হাটখন্ডের দিকে।সেখানে বসে দই চিড়া খেতে খেতে যতীন তার ডাকাতিয়া জীবনের রোমহর্ষক সব গল্পের ঝাঁপি খুলে বসেছিল।
লালজি রাজার ভাই প্রণবেশ সাহেবের সামনেই তো একবার ব্রহ্মপুত্রে জেগে ওঠা নয়া চরে চরদখলের লাঠালাঠিতে কি এক ভয়ানক লড়াই!সেবার মাথা ফেটেছিল যতীনের।
যতীনের ডাকাতিতে হাতখড়ি হয়েছিল বিজনির হামিদ মিদ্দার কাছে।তিরিশ বছর ডাকাতির জীবনে একবারই যতীনকে থমকে যেতে হয়েছিল!তার চোখ কান্নায় ভিজে গিয়েছিল!এবং এই প্রথমবার পুলিশের হাতে স্বেচ্ছায় ধরা দিয়েছিল সে।
সেবার ডাকাতি করতে গিয়েছিল যতীন রূপসীর নন্দ ধনীর বাড়িতে।খবর ছিল তামাক বিক্রির প্রায় তিন লক্ষ টাকা ধনীর বাড়িতেই রাখা আছে।আছে প্রচুর স্বর্ণালঙ্কার।ধনসম্পত্তি।
মধ্যরাতে দল নিয়ে যতীন হানা দিয়েছিল নন্দ ধনীর বাসায়।তারপর সে এক ধুন্ধুমার মারি ফেলা কান্ড!
হঠাৎ নন্দ ধনীর বছর পাঁচ বয়সী বাচ্চা ছেলে যতীনের হাত থেকে বন্দুক কেড়ে নিতে এলে যতীন আত্মরক্ষার জন্য বন্দুক চালিয়ে দেয়।
চোখের সামনে ছটফট করতে করতে সেই বাচ্চাটির মৃত্যু যতীনকে হতভম্ব করে দেয়।
তারপর সব ইতিহাস।জেল থেকে বেরিয়ে যতীন ডাকাতি ছেড়ে দেয়।যোগ দেয় কুষাণ গানের দলে।
দোয়ারির ভূমিকায়।মাঝে মাঝে কীর্তন করে বেড়ায়।
আর ইচ্ছে মত দোতরা কাঁধে ঘুরে বেড়ায় কোন কোন হাটে।দাতের মাজন,হজমি গুলি,কবিরাজি ওষুধ বিক্রি করে আর গান করে ফাঁকে ফাঁকে।
আর দেখা হলেই চেনা বা অচেনা লোকজনকে শোনাতে থাকে ডাকাতিয়া জীবনের নানান গল্পকথা।
জীবন কি অদ্ভুত!
ঘোর লাগা দুই চোখ জাগিয়ে রেখে যতীন বিড়বিড় করে গান তোলে_
"এপার থাকি না যায় দেখা রে
নদীর ওই পারের কিনার"
ইউসুফ মোল্লার বেশ মনে পড়ে শালমারার বড় বালার চরে বড় রাজকুমারীর গান নিয়ে নাচ নিয়ে বাদ্য বাজনা নিয়ে এক শীতের রাতে জমিয়ে তোলা গানবাড়ির কথা।ইউসুফ মোল্লা তখন সদ্য যুবক।পালতোলা নৌকোর দুরন্ত মাঝি।ব্রহ্মপুত্র শাসন করে সে।পণ্য পৌঁছে দেয় বন্দরে বন্দরে।আর নেশা বলতে গানবাড়িতে ঘুরে ঘুরে গান শোনা।
তখন রাজবহাদুর প্রভাত বড়ুয়া বেঁচে।
শিকারে যান মস্ত দাঁতাল হাতি জংবাহাদুরের পিঠে চড়ে।বড় রাজকুমারী আর ছোট রাজকুমারী তখন গঞ্জ গা হাট ঘুরে ঘুরে গান,নাচ, শোলোক খুঁজে বেড়াচ্ছেন।নিজেরাও নাচছেন।গাইছেন।
বালাবাড়ির চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে সেই সব গান।যা চিরকালীন।যা ভরভরন্ত জীবনের কথা বলে_
"কালা বাইগণ ধওলা রে
বাইগণের গোড়ায় কাটা"
এক হাট থেকে বেরিয়ে নুতন এক হাটে প্রবেশ করতে গিয়ে এই চার কুড়ি পেরিয়ে আসা জীবনে বারবার ইউসুফ মোল্লার মনে পড়ে সেই সব সোনার বরণ পাখির মতন দিনগুলির কথা।
হায়রে,কত তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা নেমে আসে মানুষের জীবনে!জলে ভিজে ওঠে ইউসুফের চোখ। সে দেখতে পায় "টলমল টলমল কচুপাতের পানি"।
ঠিক এখানেই একটা গল্প শেষ হয়ে যায়,নুতন এক শুরুর অপেক্ষায়!

  • সুবীর সরকার