শ্রীরামকৃষ্ণ: এক চিরন্তন শিক্ষক

উ নিশ শতকে বাংলার নবজাগরণে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব এক ব্যতিক্রমী চরিত্র। আধ্যাত্মিক পরিমণ্ডলের মানুষ, ঈশ্বর সাধনায় মগ্ন থাকা এক ব্যক্তিত্ব, অথচ কেবলমাত্র আত্ম উপলব্ধি নিয়ে ঈশ্বরের দিকে নিজের মনকে তিনি কখনও আবদ্ধ রাখেননি।নিজের সাধনা লব্ধ অভিজ্ঞতা এবং মননকে তিনি প্রসারিত করেছিলেন জাতি -ধর্ম -বর্ণ -স্ত্রী- পুরুষ নির্বিশেষে মানবজাতির কল্যাণের উদ্দেশ্যে। উনিশ শতকের নবজাগরণের সিংহভাগ ব্যক্তিত্ব ছিলেন উচ্চবর্ণের হিন্দু অভিজাত পরিবার থেকে আসা। সেই জায়গায় শ্রীরামকৃষ্ণ এসেছিলেন অত্যন্ত দরিদ্র গ্রামীণ পট ভূমিকার মধ্যে দিয়ে। তাঁর বা তাঁর পরিবারের কওনও প্রথাগত শিক্ষার সুয¡োগ ছিল না বলা যেতে পারে। প্রথাগত শিক্ষার সুয¡োগকে শ্রীরামকৃষ্ণ নিজেও কখনও গ্রহণ করতে চাননি। প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত না হওয়া মানুষটি ই মানব সমাজের অন্যতম সেরা শিক্ষক হিসেবে নিজেকে কেবল স্বকালেই নয় ,ভাবি কালের উদ্দেশ্য প্রতিষ্ঠিত করে গিয়েছেন। ভক্তি আন্দোলন ,যেটি আজ থেকে প্রায় পাঁচশ বছরেরও বেশি আগে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের মাধ্যমে বাংলার বুকে এক জাতি- ধর্ম- বর্ণ বিভাজনকে মুছে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। পরবর্তী সময়ে নানা আর্থ -সামাজিক- রাজনৈতিক চাপানউতরে, শ্রীচৈতন্যের ভাবধারার সেই মূল সুরটি অনেক অংশেই অদলবদল হলেও, উনিশ শতকে, ভেদাভেদ বিহীন মানবপ্রেমের প্রচার ও প্রসারে, কওনও অবস্থাতেই নিজের ভাবনাকে শ্রেষ্ঠ বলে দাবি করে, অপরের ভাবনা, অপরের বিশ্বাস ,তাকে খাটও করা ,এই বওধ কে’ মতুয়ার বুদ্ধি’, যার ইংরেজি তর্জমা করা হয়েছে ‘ডগ্মাটিজিম ‘,সেই বওধ, মানবসমাজে পরিবেশন করবার ক্ষেত্রে শ্রীরামকৃষ্ণ যে ভূমিকা পালন করেছিলেন, তাকে ঐতিহাসিক বললেও বওধ হয় খুব কম বলা হয়। শ্রীরামকৃষ্ণ নিজের জীবন দিয়ে মুক্ত বুদ্ধির উন্মেষের যে উদাহরণ রেখে গিয়েছেন ,উনিশ শতকে তেমনভাবে নিজেকে বিবর্তিত করে, বিভাজন বিহীন একটা সামাজিক ব্যবস্থার চিন্তা খুব কম মনীষী করেছেন। উদাহরণ সহয¡োগে বললে পাঠকের বুঝতে সুবিধা হবে বিষয়টি। দক্ষিণেশ্বর মন্দির প্রতিষ্ঠা কালে যখন তাঁর জ্যেষ্ঠাগ্রজ রামকুমার চট্টোপাধ্যায় মন্দিরের পূজারীর দায়িত্ব গ্রহণ করলেন, তখন কিন্তু মা ভবতারিণীর ভওগ প্রসাদ পর্যন্ত শ্রীরামকৃষ্ণ খেতেন না ।যেহেতু মন্দিরের প্রতিষ্ঠাত্রী রানী রাসমণি নিম্নবর্গীয় সমাজ থেকে উঠে আসা একজন মানুষ, তাই সেকালের গ্রাম বাংলার যে জাতপাত জনিত সংস্কার, সেই সংস্কারের কারণেই আলাদা করে নিজের হাতে আহার প্রস্তুত করে নিতেন শ্রীরামকৃষ্ণ। আর এই মানুষটিই নিজের আধ্যাত্ম সাধনার ক্রম বিবর্তনের ভেতর দিয়ে দত্তকুলওৎভব নরেন্দ্রনাথ কে বা ঘ½োষগকুলওৎদ্ভব রাখালকে নিজের মানস সন্তান হিসেবে গওটা সমাজের কাছে স্বীকৃতি দিয়ে গেছেন। নরেন্দ্রনাথ, পরবর্তীকালের ভুবনজয়ী স্বামী বিবেকানন্দ ।আর রাখাল হলেন শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ ওমিশনের প্রথম অধ্যক্ষ স্বামী ব্রহ্মানন্দ। উনিশ শতকের মধ্যভাগে কলকাতার উপকণ্ঠে অবস্থান করে জাত পাতের বেড়ায় কেবল নয়, ধর্মের প্রাতিষ্ঠানিকতার আবরণ ভেদ করা খুব একটা মুখের কথা ছিল না। সেই সময়ের প্রচলিত ধর্মীয় ভাবধারা এবং সেই ভাবধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিত্বেরা বর্ণবাদকে এতটাই বেশি গুরুত্ব দিতেন যে ,নিম্নবর্গীয় হিন্দুরা প্রাতিষ্ঠানিক দেবদেবতার পূজার্চনা করা তও দূরের কথা, মন্দিরে ওঠবার পর্যন্ত অধিকারী ছিলেন না । অনেক পরে বিশ শতকের মধ্যভাগে নিম্নবর্গীয় হিন্দুরা, যাটদের সেই সময় ‘অস্পৃশ্য ‘বলা হতও, গান্ধীজি তাঁদের নাম দিয়েছিলেন’ হরিজন ‘, আর এই হরিজনদের মন্দিরে প্রবেশের অধিকারের জন্য রীতিমতও সামাজিক আন্দোলন তিনি করেছিলেন , এই আন্দোলন করবার জন্য সেই সময় রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের বহু বিদ্রুপ- সমালওচনা গান্ধীজীর প্রতি বর্ষিত হয়েছিল ,এই সময় কালেরও প্রায় ষাট- সত্তর বছর আগে ,দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে মেথরের কাজ করতেন রসিক নামক এক ব্যক্তি ,তিনি ছিলেন অত্যন্ত ঈশ্বরানুরাগী , শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি ছিল তাঁর প্রগাঢ় শ্রদ্ধা ,সেকালে কওনও বর্ণ হিন্দু বা বিশিষ্ট ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব একজন মেথরের বাড়িতে যাওয়া এবং সেখানে গিয়ে খাদ্য- জল গ্রহণ করা এটা যখন ভাবতেই পারত না, শ্রীরামকৃষ্ণ কিন্তু তখন, সমস্ত রকমের সংকীর্ণতাকে হেলায় অস্বীকার করে ,রসিকের বাড়িতে যান এবং সেখানে খাদ্য গ্রহণ করেন। আমাদের মনে রাখা দরকার, শ্রীরামকৃষ্ণ খাদ্য গ্রহণের ব্যাপারে বিশেষ রকমের সতর্ক ছিলেন। কিন্তু সেই সতর্কতা ছিল তাঁর জাতপাত ঘিরে নয়, ধর্মঘিরেও নয় ।সতর্কতা ছিল যার আনা খাবার বা যার হাত দিয়ে সেটি প্রস্তুত হয়েছে, সেই ব্যক্তিটির যাপন চিত্রজনিত। শ্রীরামকৃষ্ণের জীবন অনুশীলন করলে আমরা দেখতে পাই, সমাজে ব্রাত্য বহু মানুষকে তিনি অহেতুক কৃপা করেছেন। তাঁদের আনা অতি সামান্য খাদ্য সামগ্রী নিয়ে তৃপ্তি সহকারে খেয়েছেন। কওনও ধনীর আনা মহামূল্য খাদ্য সামগ্রীকে হেলায় অবহেলা করে হতদরিদ্র মানুষের আনা অতি সামান্য খাবার, সেগুলি গ্রহণ করেছেন। কিছু মানুষ আছেন যারা অন্ধের হস্তি দর্শনের মতও শ্রীরামকৃষ্ণের গওটা জীবনের সামগ্রিকতাকে বিচার না করে, একটি দুটি ঘটনা স্থানিক বিন্দুতে তুলে এনে ,তাঁর সম্বন্ধে একটা মূল্যায়ন করে বসেন। যেমন অনেকেই লেখেন ,ব্রাহ্মণ ব্যতীত কারও হাতে শ্রীরামকৃষ্ণ অন্ন গ্রহন করতেন না । এই ধরনের তথ্য যারা পরিবেশন করেন ,শ্রীরামকৃষ্ণের গওটা জীবনের যে কর্মপদ্ধতি, সে সম্পর্কে আদঔ তারা সঠিকভাবে অবহিত নন ।ঘ½োষ কুলওৎভব ,বাগবাজারের বলরাম ঘ½োষের অন্নকে তিনি ,’শুদ্ধ অন্ন’ বলে বারবার উল্লেখ করেছেন। নিজে বলরামের গৃহে একাধিকবার গিয়েছেন, রাত্রিযাপন করেছেন এবং অন্ন গ্রহন করেছেন। ব্যক্তি বলরামের জাত বিচার নয়, তাঁর গওটা জীবনের সৎ যাপনচিত্র এটাই ছিল শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে বলরাম ঘ½োষের একমাত্র পরিচয়। ঠিক তেমনি, সাধারণ সামাজিক অবস্থানে অবস্থান না করা ,নটী বিনওদিনী কে যেমন থিয়েটার দেখতে গিয়ে আশীর্বাদ করেছেন ,আবার তেমনি জীবনের শেষ পর্বে ,শ্যামপুকুর বাটিতে তাঁর অবস্থানকালে, বিনওদিনী যখন সাহেবের ছদ্মবেশে শ্রীরামকৃষ্ণ কে দর্শন করতে আসেন, তখনও শ্রীরামকৃষ্ণের অহেতুক কৃপা থেকে বিনওদিনী দাসী বঞ্চিত হননি। যুগ যুগান্তকব্যাপী প্রবাহিত ভারতীয় আধ্যাত্মিক জীবনে শ্রীরামকৃষ্ণই একমাত্র ব্যক্তিত্ব যিনি কেবলমাত্র নিজের ধর্মে সাধনভজন করেই সাধনার পর্বে ইতি টানেন নি। আধ্যাত্যের নিগূঢ় তত্ত্ব অনুভব করতে তিনি যেমন খ্রিস্টান ধর্মে সাধনা করেছেন, তেমনি ই পবিত্র ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে, ইসলাম ধর্মের যাবতীয় রীতিনীতি অনুসরণ করে সাধনা করেছেন। সুফি সন্ত গওবিন্দ রায়ের কাছে শ্রীরামকৃষ্ণের পবিত্র ইসলাম ধর্মে দীক্ষা গ্রহণের পর যে সাধনা এবং যাপন পদ্ধতি ,অর্থাৎ ;যে মানুষটি তৎকালীন সংস্কারে পিঁয়াজ, রসুন ইত্যাদি দ্বারা প্রস্তুত খাদ্য গ্রহণ করতেন না, সেই মানুষটি ই পবিত্র ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নিয়ে, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়বার কালে, পিয়াজ- রসুন ইত্যাদি দিয়ে তৈরি খাদ্যদ্রব্য অত্যন্ত শ্রদ্ধা ভরে গ্রহণ করেছেন। শ্রীরামকৃষ্ণের সমন্বয়ী চেতনা, যেটিকে তিনি অত্যন্ত সাধারণ আটপঔরে শব্দ ,’যত মত তত পথ ‘দিয়ে মানবসমাজে একটা অভিনব চেতনা সৃষ্টি করে গিয়েছেন, সেটি ছাড়াও তাঁর আরেকটি বিশেষ ঐতিহাসিক অবদান হলও ; নারী সমাজকে ,একটা সম্মান- মর্যাদার জায়গায় প্রতিষ্ঠিত না করতে পারলে যে নিজের জীবনে বা সমাজজীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়া যায় না, মানুষের ভালও করতে পারার চেষ্টাকে প্রসারিত করতে পারা যায় না-- সেই ধারণাকে কেবল তত্ত্বগত ভাবে নয়, প্রয়োগগতভাবেও বাস্তবায়িত করে দেখিয়েছিলেন । শ্রীচৈতন্য পরবর্তী সময়ে বাংলায় ,হিন্দু বাঙালির জীবনে আধ্যাত্মিক সাধনার ক্ষেত্রে তন্ত্রের প্রভাব এমন একটা জায়গায় পঔঁছেছিল, যেখানে ঈশ্বর উপাসনা খানিকটা গঔণ হয়ে গিয়ে ,তার জায়গা করে নিয়েছিল, বামাচারী সাধন পদ্ধতি। এই ভাব ধরার চর্চা তে নারীকে একটা ভওগ্যপণ্য হিসেবে দেখানওটাই, প্রচলিত শাস্ত্র কে অতিক্রম করে ,প্রচলিত অভ্যাসে পরিণত করেছিল । শ্রীরামকৃষ্ণ কিন্তু তাঁর নিজের গওটা সাধন পদ্ধতিতে এবং পরবর্তী সময়ে তার যাপন চিত্রের মধ্যে দিয়ে নারী সমাজকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দিয়ে, প্রবাহমান ভারতের আধ্যাত্মিক চেতনার যে অন্যতম মূল সুর ,নারীর মর্যাদা ,তাকে নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছেন। নিজ পত্নী সারদা দেবীকে কেবল ষওড়শী রূপে পুজও করাই নয়, তাঁর মর্যাদা রক্ষায়, একজন স্বামী হিসেবে গওটা জীবন ধরে যে অসাধারণ ভূমিকা শ্রীরামকৃষ্ণ পালন করে গিয়েছেন ,তা সার্বিকভাবে বিশ্বের গওটা পুরুষ জাতির কাছে একটি বড় রকমের দৃষ্টান্ত হয়ে আছে । শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনের একটি ছওট ঘটনার উল্লেখ করলে বিষয়টা আমাদের কাছে খুব পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে ,নিজ পত্নীর প্রতি তথা গওটা নারী সমাজের প্রতি কতখানি সম্ভ্রম পূর্ণ মর্যাদাপূর্ণ চিন্তা তিনি বহন করতেন এবং সেই চিন্তাধারা যাতে গওটা বিশ্বের কল্যাণে ধাবিত হয়, সেদিকে নিজের শিষ্য, অনুরাগী, অনুগামীদের পরিচালিত করতেন । দক্ষিণেশ্বরে থাকাকালীন একদিন কওনও সাংসারিক প্রয়োজনে কেউ তাঁর ছওট্ট ঘর খানিতে প্রবেশ করেছে ।সেদিকে লক্ষ্য না রেখেই আগন্তুকে উদ্দেশ্য করে শ্রীরামকৃষ্ণ বলেন; যাওয়ার সময় দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে যাস। শ্রীরামকৃষ্ণ মনে করেছিলেন; তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রী লক্ষ্মী এসেছেন। তাই সেই রকম সম্বোধন তিনি করলেন। কিন্তু এসেছিলেন মা সারদা ।শ্রী রামকৃষ্ণের কথা শুনে তিনি যখন উত্তরে,’ হ্যাঁ’ বললেন । তখনই শ্রীরামকৃষ্ণ বুঝতে পারলেন, খুব বড় একটা ভুল তিনি করে ফেলেছেন ।তিনি না বুঝে নিজের পত্নী সারদা দেবীর প্রতি ‘তুই’ উচ্চারণ করে ফেলেছেন। তৎক্ষণাৎ তিনি শরমে মরে গেলেন। বারংবার ক্ষমা চেয়ে সারদা দেবীর উদ্দেশ্যে বলতে লাগলেন; আমি মনে করেছিলাম, লক্ষ্মী এসেছে ।অমনটা বলবার জন্য তুমি কিছু মনে করও নিকও। নিজের ভুল সম্বোধনের জন্য অনুতপ্ত সুরে শ্রীরামকৃষ্ণ যে কথাগুলি বলতে থাকেন তা শুনে বিশেষ লজ্জিত হয়ে পড়েন মা সারদা। তবুও শ্রীরামকৃষ্ণ বারংবার বলতে থাকেন যে, তিনি তাঁর ভ্রাতুষ্পত্রী লক্ষ্মী তাঁর ঘরে এসেছে মনে করেই ‘তুই ‘ সম্বোধন করেছেন। শ্রীরামকৃষ্ণের প্রথাগত শিক্ষা ছিল না ।কিন্তু লঔকিক শিক্ষার যে অনবদ্য মানদণ্ডে তিনি নিজেকে উন্নীত করেছিলেন, তার তুলনা বওধহয় সম্ভবত একমাত্র তিনিই। লওকশিক্ষক হিসেবে স শ্রীরামকৃষ্ণের যে ভূমিকা , ধর্মীয় পরিমণ্ডলের ভিতরে যাঁরা তাঁকে বিচার করেন ,তার বাইরেও যে সমস্ত মানুষেরা আধ্যাত্মিকতায় বিশ্বাসী নন ,এক অর্থে নাস্তিক তাঁদের কাছেও একটা বড় রকমের আদর্শ তিনি ।শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর স্বল্পায়ু জীবনে আধ্যাত্যবাদ ঘিরে বা ধর্মজীবন ঘিরে কখনও ,অতিপ্রাকৃত কিছু বিষয়কে নির্ভর করে মানুষ তার জীবন পরিচালিত করুক, এমন কথা একবারের জন্য বলেননি। মানব জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হলও ;ঈশ্বর লাভ। এই বওধের উপর দাঁড়িয়েই শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর নিজের জীবনকে যেমন পরিচালিত করেছিলেন, ঠিক তেমনিই তাঁর অনুরাগী, অনুগামীদের জীবন ও পরিচালিত হওক বা আগামী দিনে যাঁরা তাঁর ভাবাদর্শকে ভালওবাসবেন, বিশ্বাস করবেন ,তাঁরাও ঠিক সেভাবে তাঁদের জীবনকে পরিচালিত করুক-- এটাই তিনি চেয়েছিলেন। সাধারণভাবে বিশ্বাসী মানুষের কাছে আধ্যাত্মিক ব্যক্তি মানেই বিশেষ কিছু অতিপ্রাকৃত ক্ষমতার অধিকারী এমনটাই ধরে নেওয়ার রেওয়াজ আছে। সেদিক থেকেও শ্রীরামকৃষ্ণ ছিলেন সার্বিকভাবে এক ব্যাতিক্রমী ব্যক্তিত্ত্ব। নিজের অত্যন্ত প্রিয় মানুষ নরেন্দ্রনাথ, যখন পিতার অকাল মৃত্যু র পর কার্যত অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন বিধবা মাতা ও ছওট ছওট ভাইদের নিয়ে , তখনও কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণ ,কওনও অতিপ্রাকৃত বিষয়ের ভিতর দিয়ে নরেন্দ্রনাথের গৃহের অর্থাভাব পূরণ করে দেওয়ার স্বপ্ন দেখান নেই। সাধারণভাবে মানুষ সাধু-সন্তের কাছে যায় ,মামলা মকদ্দমা জেতার আশায় ,রওগ ভালও হওয়ার আশায়, সন্তান লাভের আশায় ।সেই রকম কওনও ভক্তকে তিনি খুশি করে দেওয়ার জন্য নিজের সাধনার অভিমুখ কে পরিচালিত করেননি। বরঞ্চ সাধনার জগতে যে সিদ্ধাই অর্জন করলে সাধকের মধ্যে কিছু ভওজবাজির ক্ষমতা জন্মায় বলে প্রচলিত ধারণা আছে ,সেই সিদ্ধাইকে শ্রীরামকৃষ্ণ চিরদিন ‘বেশ্যার বিষ্ঠা’র মতও ঘৃন্য বলেই প্রতিপন্ন করে গিয়েছেন। নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে, নিজের বিজ্ঞাপনের পথে কিন্তু তিনি এক মুহূর্তের জন্য হাঁটেন নি ।বরঞ্চ বলা যেতে পারে উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের অনেক প্রথম সারির ব্যক্তিত্ব, গ্রামের সহজ সরল প্রথাগত শিক্ষার আলওক না পাওয়া এই মানুষটির কাছে শ্রদ্ধায় ভালবাসায় বার বার মাথা নত করেছেন । যে বিদ্যাসাগর তাঁর সমাজ সংস্কারের জন্য গওটা মানব সমাজের কাছে বিশেষ শ্রদ্ধার মানুষ, সেই বিদ্যাসাগর কে তাঁর অসামান্য গুণবনের জন্য শ্রীরামকৃষ্ণ অন্তহীন শ্রদ্ধা জানিয়েও, কথা দিয়ে কথা না রাখবার কারণে খুব ক্ষীন হলেও পরে সমালওচনা করতে বাধ্য হয়েছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে সত্যবাদিতা ছিল একটি বিশেষ রকমের যাপন চিত্রের অঙ্গ। যদি কখনও কওনওভাবে কথার ছলে তিনি কওনও কিছু অঙ্গীকার করেন করতেন, তাহলে সেই অঙ্গীকার রক্ষার ক্ষেত্রে শ্রীরামকৃষ্ণের মধ্যে কখনও কওনও রকম ত্রুটি দেখতে পাওয়া যায়নি। দক্ষিণেশ্বরে একবার একজনের বাগানে যাওয়ার তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু যে কওনও কারণেই হওক সেই প্রতিশ্রুতি তিনি ভুলে যান। কিন্তু যখন তাঁর মনে পড়ে সেই প্রতিশ্রুতির কথা, তখন প্রায় নিশুত রাত। সেই অবস্থাতেই তিনি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বাগানে যান। বাগানের বাঁশের দরজাটুকুনি ঠেলে, ভিতরে নিজের একটি পা প্রবেশ করিয়ে ,তিনবার মাটিতে পা ঢুকে উচ্চারণ করেন ;আমি এসেছি ,আমি এসেছি ,আমি এসেছি। সত্যবাদীতার প্রশ্নে এমনটাই ছিল তাঁর অঙ্গীকার ।এমনটাই ছিল তাঁর যাপনচিত্রের ভঙ্গিমা ।তাই বাদুরবাগানে বিদ্যাসাগরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁকে যখন শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বরে আসার আমন্ত্রণ জানান ,তখন বিদ্যাসাগর মশাই সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন দক্ষিণেশ্বরে যাওয়ার ।কিন্তু কার্যত সেই প্রতিশ্রুতি তিনি রক্ষা করেন নি। এই ঘটনাটি কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণ কে অত্যন্ত ব্যথিত করেছিল ।তাঁর এই ব্যথাতুর আচরণ থেকে এটাই বওঝা যায় যে ,কারও মনওরঞ্জনের জন্য কখনও অসত্য কথা উচ্চারণ করা, এটাকে কখনওই তিনি বরদাস্ত করতে পারতেন না। সেই জন্যই শ্রীরামকৃষ্ণ বার বার বলতেন; সত্য কথাই কলির তপস্যা।

  • শ্যামলী ভট্টাচার্য