বাংলার ফুড ব্লগার এবং নবজাগরণ

ফুড ব্লগার, শুদ্ধ উচ্চারণের তাগিদে ' ' কে ' ' করে উচ্চারণের রেওয়াজও দেখা যায়। একটা নতুন ধারা আমাদের রসনাকেন্দ্রিক। সমাজমাধ্যম আমাদের কত অজানা দুনিয়াকেই না খুলে দিচ্ছে-

 

 

 

তিন পিস পরোটা, আনলিমিটেড তরকারি, সঙ্গে একটা সেদ্ধ ডিম! এখানেই শেষ নয় এক টুকরো পেঁয়াজ এবং একটা কাঁচা লঙ্কা ফ্রি। ভাইরাল পরোটা বিক্রেতা রাজুদা এখন সেলিব্রেটি। গুমা থেকে ভোর রাতে একা বিরাট সরঞ্জামে করে পরোটা নিয়ে শিয়ালদহ কোলে মার্কেটে বিক্রি করতে আসেন তিনি। তাঁর কাহিনী হঠাৎ এখন সমাজমাধ্যমের ইউএসপি। সারাদিন ফুড ব্লগাররা ছেঁকে ধরছেন তাঁকে। এমনকি তাঁর বাড়ি পর্যন্ত গিয়ে তাঁর সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন। ফেসবুক খুললেই ভাইরাল রাজুদাকে নিয়ে মিমের বন্যা। একজন তো তাঁকে নিয়ে আস্ত একখানা র‍্যাপ বানিয়ে দিয়েছেন। শুধু রাজুদা একা নয়, উজ্জ্বলদার বিরিয়ানি, আমেরিকান দাদার বিরিয়ানি, ফোন পে পরোটা, গ্র্যাজুয়েট চাওয়ালা, অরুণদা, রাশিয়ান দিদি চা-ওয়ালা এনারা এখন নামিদামি ফিল্মস্টারদের টক্কর দিচ্ছেন। তাঁদের ভিডিও এখন ভাইরাল। এই ভাইরাল প্রজন্মের ফুড ব্লগার এবং তাঁদের কন্টেন্ট যেভাবে নবজাগরণ ঘটাচ্ছে, তাতে মনে হয় আগামী প্রজন্ম প্রথাগত পড়াশুনা ছেড়ে এই পথেই হাঁটবেন। আসলে এই পথটাও যে খুব একটা সহজ এমন নয়, তবে প্রথাগত বিদ্যার চেয়ে কিছুটা সহজ বটেই। 

 

 

 

তবে সহজ নয় কি কঠিন এই বিষয়ে একটা বিতর্কসভা হয়ে যেতে পারে, সেই বিষয়ে আলোচনাও হতে পারে বিস্তর কিন্তু ফুড ব্লগিং বাংলার অর্থনীতিতে কি কোনও প্রভাব ফেলতে পারবে? আদৌও এই ভাইরাল রাজুদার ভিডিও দেখে বাংলার মানুষের পেট ভরবে। একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে আপনার আশেপাশে বিরিয়ানির দোকান, ছোট ক্যাফে ইত্যাদি গজিয়ে উঠছে। বাঙালি চাকরি ছেড়ে ব্যবসার দিকে এগোচ্ছে। এটা কি বাংলার অর্থনীতির জন্য খুব ভাল খবর? সেই নিয়েও চায়ের দোকানে বিস্তর তর্ক চলে আজকাল। তবে একটা বয়সের পরে কর্মবিমুখ বাঙালি ৯টা-৫টার চাকরি ছেড়ে ব্যবসা করার লোভে হুটহাট করে একটা খাবারের দোকান খুলে দিচ্ছে। আর সেই দোকানের প্রোমোশন করতে গজিয়ে উঠছে অজস্র ফুড-ব্লগার। একটা ফোন ক্যামেরা হাতে নিয়ে জাস্ট বেরিয়ে পড়া। কোনও পিছুটান নেই। অমুক পাড়ায় তমুক কাকু ১ টাকায় সিঙ্গারা বিক্রি করছে, সেটা নিয়েই শুরু হয়ে গেল তাঁর ফুড ব্লগিং -এর যাত্রা। তারপরে যে কোনও দোকানে গিয়ে হুট করে ঢুকে দোকানদারের অনুমতি ছাড়াই শুরু হয়ে যাচ্ছে ভিডিও। বাংলায় দিনে দিনে ফুড ব্লগিং-এর মাফিয়া রাজ চলছে। আবার কিছু ফুড ব্লগার ইচ্ছাকৃত একটা স্ক্রিপ্ট সেট করে দোকানদারের সঙ্গে মারপিট করে একটা সিনেম্যাটিক প্লট তৈরি করে বেশ আলোড়ন ফেলে দিয়েছে। বাংলায় ফুড ব্লগিং করে কি আদৌ অর্থ উপার্জন করা যায়?  সেই উপার্জন দিয়ে কি আদৌ সংসার চালানো যায়

 

 

'১০০ এন্ড এভোব' নামের এক চ্যানেলের ফুড ব্লগার দীপের কথায়, 'এখন কেউই অত ভেবে কিছু করে না। আজকাল ইয়ং জেনেরেশনের ফুড ব্লগার হঠাৎ করে ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে বাড়ির সামনে যা পাচ্ছে তারই ভিডিও বানাচ্ছে। কেন করছে, কী করছে সেগুলোর খেয়াল রাখছে না' তাঁর কথায় উঠে এল স্থায়ী চাকরি না থাকার প্রসঙ্গ। তিনি জানালেন, 'এক পড়ুয়ার হঠাৎ ইচ্ছে তাঁর অমুক বন্ধু ভিডিও বানিয়ে কিছু পয়সা বানিয়েছে তাই তাঁকেও বানাতে হবে। ব্যস, সেও ওই দলে ভিড়ে গেল। এবার আসলে কী হচ্ছে এবং কী হবে সেটা বলা মুশকিল। আসলে কেউই আগামী পাঁচ বছরে এই ফুড ব্লগিং কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সেই ভেবে কাজ করছে না। আজকের জন্য করছে।' তিনি আরও নির্দিষ্ট করে বললেন, ' যে কয়েকজন ফুড ব্লগার টিকে আছে তাঁদের কিন্তু একটা নির্দিষ্ট ভিত্তি আছে। তাঁরা একটা প্রসেস ফলো করে।' প্রসঙ্গত ফুড ব্লগিং কী সেটা কত লোকে জানে আর কত লোকে জানে না, সেই নিয়ে বাঙালিদের মধ্যে বোধের অভাব আছে। শুধু তাই নয়, কী দেখাচ্ছি এবং কেন দেখাচ্ছি সেই নিয়েও যথেষ্ট খামতি আছে। তবে কিছু ব্লগার সাধারণ কিছু মানুষের ভিডিও ভাইরাল করে পয়সা উপায় করছেন এবং একটা বড় অংশের জেনারেশন হঠাৎ চাকরির ফাসট্রেশন কাটানোর জন্য ফুড ব্লগিং করছে। শুধু তাই নয়, অল্পবিস্তর উপার্জনও করছেন। একটা সময় লোকে বলত বাঙালি ব্যবসা করতে ভয় পায়, সেই বাঙালি এখন চুটিয়ে ব্যবসা করছে। ফুডকা নামক চ্যানেলের ফুড ব্লগার ইন্দ্রজিৎ লাহিড়ী এই কথাকে সমর্থন করে জানালেন যে, 'ভাল হচ্ছে তো। কিছু মানুষজন তো তাঁদের নেশাকে খুঁজে পাচ্ছে। যে ভিডিও বানাচ্ছে এবং যার ভিডিও বানাচ্ছে দুজনেরই লাভ হচ্ছে। একজন পরোটা বিক্রেতার যদি আগে ২০০ পরোটা বিক্রি হতো আর এখন যদি ৪০০ হয় তাহলে ক্ষতি কী?' তিনি আরও যোগ করলেন, 'জীবন যে দিকে এগোচ্ছে সেখানে আরও ফোনে ঝুঁকে থাকার প্রবণতা বাড়বে এবং এই ধরণের কন্টেন্ট লোকে দেখবে। সরাসরি না হলেও ঘুরপথে অর্থনীতির চাকা ঘুরবে।'   

 

 

 

বাংলার ফুড ব্লগাররা কি পারবেন বাংলায় নবজাগরণ ঘটাতে? একটা নবপ্রজন্ম কি শুধু ব্লগ আর ভ্লগেই জীবন কাটাবে? জীবনের সবটুকু ক্যামেরা বন্দি করবে অথবা অভিনয় করে নিজেদের দুঃখ ঢাকবে? ক্যামেরার সামনে কী ঘটছে এবং আমরা ক্যামেরার পিছনে কী দেখছি সেই নিয়ে বিস্তর সন্দেহ আছে দর্শকদের মনে। যদিও অনেক অভিজ্ঞ লোকেরা বলে অন্ধের মতো কিছু বিশ্বাস করতে হবে না। ঘটনাস্থলে কী ঘটছে, সেটা জানা জরুরি। ফুড ব্লগার দীপের কথায়, 'আমি শুনেছি রাজুদার পরোটা খাবার লাইন আর ভিডিও করার লাইন আলাদা। বিক্রি কতটা হচ্ছে সেই নিয়ে সন্দেহ আছে, উপরন্তু ভিডিও করার ভিড় বেশি হচ্ছে।' এই ভিড়েই কি ভিড় হয়ে যাচ্ছে আগামী প্রজন্ম? একটা হুজুগে সমাজ শুধুমাত্র সমাজমাধ্যমে ভাল থাকার জন্য নিজের শিকড় ভুলে যাচ্ছে! একটা শ্রেণি অন্য শ্রেণিকে নিয়ে খিল্লি করে সুখে থাকছে? একটা মানুষের ক্রাইসিস এখন কমেডির বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে। যেখানে গভীরে গিয়ে জানার ইচ্ছে কম, শুধুমাত্র একটা সোনালি মোড়কে ভাল থাকার বৃথা চেষ্টা চলছে। শুধু তাই নয়, একটা যুব সমাজ শুধুমাত্র ব্লগিং করে অর্থ উপার্জন করার কথা ভাবছে, সেটাও যে খুব একটা সহজ এমন নয়। ফুড ব্লগার ইন্দ্রজিৎ লাহিড়ীর কথায়, 'ফুড ব্লগিং করে অর্থ উপার্জন করা সহজ নয়। তবে একটা কথা বুঝতে হবে চাহিদা থাকলেই প্রোডাকশান বাড়বে! এত বিরিয়ানির দোকান হয়েছে, সেখানে তো লোকে লাইন দিয়ে কিনছে। কিছু লোকের তো কর্মসংস্থান হচ্ছে। খারাপ কী?’ তিনি আরও জানালেন যে, ‘আমার ফুড ব্লগিং করার নীতি অন্য। আমি কিন্তু একটা জায়গায় পৌঁছে কাজ শুরু করেছি। আমি সবসময় একটা গল্পকে বলার চেষ্টা করি, সম্প্রতি জেলেদের মাছ ধরা নিয়ে একটা ভিডিও আসবে।‘ 

 

 

 

বাঙালি গল্প বলতে ভুলে যাচ্ছে। সম্ভ্রম ভুলে যাচ্ছে। এখন সবটাই নিউ নর্মাল হয়ে উঠেছে। কিছু করার আগে ভাবছি না। জাস্ট করে ফেলছি। ফুড ব্লগিং করতে গিয়ে অনেকে দোকানদারের যেমন ভাল হয়েছে আবার ক্ষতিও কম হয়নি। কিছু মানুষ যেমন হঠাৎ সেলিব্রেটি হয়ে উঠেছিল তেমনি তাঁরা হুট করে উবেও গিয়েছে। বাংলার নবজাগরণ ঘটেছে কিন্তু সেটা ফুড ব্লগিং-এর নয়, উপরন্তু মানসিকতার। যেখানে লুকিয়ে আছে শর্টকার্টে শাহরুখ খান হওয়ার প্রবণতা। একদিন রাজুদা হারিয়ে যাবে, উজ্জ্বলদাও বিরিয়ানি বিক্রি করা ছেড়ে দেবে। কিন্তু এই উদভ্রান্ত মানসিকতার কবে পরিবর্তন হবে?

  • আদিত্য ঘোষ