বাগান সাজিয়ে রেখে মালি চলে গেলেন 

শিল্পীর মননলোকের সৃজনে তার পরিবেশ বড় রকমের প্রভাব ফেলে। দেশভাগের যন্ত্রণা নিজের জীবনে এবং পারিপার্শ্বিকতায় কী প্রভাব ফেলেছিল আর সেই প্রভাব কীভাবে জীবনের ছন্দকে বদলে দিয়েছিল, মনোজ মিত্রের বীক্ষায় তা ধরা দেয় হৃদয় নিংড়ানো সুরে--

 

 

 অবিভক্ত বাংলায় ১৯৩৮ সালে  জন্ম হয়েছিল শিশুটির। খুলনা জেলার সাতক্ষীরার ছোট্ট গ্রাম ধূলিহর। পৈতৃক একান্নবর্তী পরিবারে বড় হয়ে ওঠা। ছোট্ট মনোজ মেধাবী ছাত্র ছিলেন। কিন্তু পড়াশোনার থেকে তাঁকে বেশি আকর্ষণ করত থিয়েটার আর অভিনয়। তাঁর গ্রামে, সেই ব্রিটিশ আমলে, শহরের মতো থিয়েটার হত। যাত্রা নয়, পুরোদস্তুর শহরের মতো থিয়েটার। 

 


মনোজের বাবা অশোক কুমার মিত্র কিন্তু একদম পছন্দ করতেন না ছেলে নাটক-থিয়েটার নিয়ে মাতামাতি করুক। মনোজ নাটকের আসরে যাবে, কারো বারণ শুনবে না। একবার তো গ্রামের সবাই রামের সুমতি নাটক করছে আর মনোজ সবার সামনের সারিতে বসেছে দেখতে। সেই সময়ে ছেলেরা মেয়ে সেজে অভিনয় করত। চরিত্র বাস্তবানুগ করতে যারা মেয়ে সেজেছে, বারবার কাপড় তুলে মাথায় টানছে। কারও অভিনয়ে যেন প্রাণের ছোঁয়া নেই। তারপর রামের সেই পোষা মাছগুলোর সময়ে চরিত্রাভিনেতা দুটো জীবন্ত মাছ নিয়ে মঞ্চে চলে এল। আর মাছ দুটো ঝুড়ির মধ্যে থেকে স্টেজে লাফিয়ে পড়ল। সে এক হুলুস্থুল কাণ্ড। সব দর্শক মঞ্চের কাছে চলে এসেছে জ্যান্ত মাছের লাফালাফি দেখার জন্য। 

 


বালক মনোজ সেদিনের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছিলেন যে, দর্শক নাটকের মধ্যে জীবনের পরশ খোঁজে। তিনি নিজে একবার অভিনয়ের সময়ে জামার মধ্যে জীবন্ত হাঁস নিয়ে স্টেজে উঠেছিলেন। হাঁসের নখের আঁচড়ে বুক পেট রক্তাক্ত হয়ে গেলেও ওইটুকু বয়সে দর্শকদের আগ্রহ তৈরি করতে নিজে যন্ত্রণা সহ্য করেছিলেন। অভিনয়কে বাস্তবানুগ করতে কতটা নিষ্ঠা থাকতে একজন শিশু এই কষ্ট স্বেচ্ছায় মেনে নেয়। 

 


প্রবাদপ্রতিম নাট্যকার, অভিনেতা, অধ্যাপক মনোজ মিত্র। শৈশব থেকে তাঁর ধ্যান, জ্ঞান, মনন ছিল একমাত্র নাটক। স্বাধীনতার পর প্রথমে খুলনা ভারতের অংশ হবে কথা হলেও পরে পাকিস্তানে যুক্ত হয়ে যায়। মনোজ মিত্রের পরিবার এপারে চলে আসেন। স্কুল শেষ করে স্কটিশ চার্চ কলেজে দর্শনে অনার্স নিয়ে পড়ার সময় সিদ্ধান্ত নেন নাটক আর অভিনয় হবে তাঁর জীবনের উদ্দেশ্য। মেধাবী ছাত্র মনোজ দর্শনে স্নাতকোত্তর করে কলেজে অধ্যাপনায় যোগ দেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা শুরু করেন। বাবা চেয়েছিলেন মনোজ পড়াশোনা নিয়ে থাকুক। দর্শনের বিদগ্ধ অধ্যাপক হোক। 

 

 

কিন্তু যে মানুষ মঞ্চের পাদপ্রদীপের আলোতে হাজার দর্শকদের সামনে তাঁর নিজের দর্শন তথা দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত করতে চেয়েছেন, ক্লাসরুমের চার দেয়ালের পরিসর তাঁর মননের পরিতৃপ্তি কী করে দেবে ? প্রতিদিনের যাপনচিত্রের ছোট ছোট তুচ্ছ ঘটনা, যা হয়তো আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়; সেই সাধারণ মানুষের গল্প তাঁর নাটকের মূল প্রতিপাদ্য কাহিনি হবে তিনি ঠিক করেন। তাঁর লেখা প্রথম নাটক 'মৃত্যুর চোখে জল'। মনোজ মিত্রের পিতামহ বৃদ্ধ বয়সে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। পায়ের আঙুল বেঁকে গিয়েছিল কোনও অসুখে। ঠাকুরদার এই কষ্ট কিশোর মনোজকে এতটাই নাড়া দিয়েছিল যে এই নাটকে তরুণ বয়সে ঠাকুরদার চরিত্রে অভিনয় করে তাঁর ভালোবাসা, সহমর্মিতা উজাড় করে দিয়েছিলেন।‌ 

 

 

পরবাস নাটকের মূল চরিত্র বাংলাদেশ থেকে তাঁদের বাড়িতে আশ্রয় নিতে আসা একজন সাধারণ মানুষ। এই ভদ্রলোক কিছুদিন পর চাকরি পেয়ে অন্যত্র চলে যান। কিন্তু যেটুকু সময় তিনি ছিলেন‌ এক নিঃসম্পর্কীয় পরিবারে, তিনি হয়ে উঠেছিলেন মনোজদের পরমাত্মীয়। দৈনন্দিন জীবনের ভালোবাসা, আবেগ, শ্রদ্ধা তাঁর কাছে ছিল বেঁচে থাকার পাথেয়। 
 

 

১৯৪৩ সালে গণনাট্য সংস্থা স্থাপিত হওয়ার পর নাটক ছিল মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের ভাষা। সারা বিশ্বে যখন মেহনতি মানুষের লড়াইয়ের সংস্কৃতির একটা অংশ ছিল নাটক, এদেশের বামপন্থী আন্দোলনেও তার ব্যতিক্রম ছিল না। মনোজ মিত্রের নাটকে সমসাময়িক আর্থ-রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিবাদ আর বিদ্রোহ বারবার উঠে এসেছে। তাঁর প্রকাশভঙ্গি ছিল অনন্য। ১৯৬৯ সালে লেখা চাক ভাঙা মধু নাটকে তিনি লিখেছেন, বনের সাপের চেয়েও সমাজের মধ্যে মানুষের চেহারায় বাস করে যে সাপ, সে আরও বিষধর। যাদের দয়ায় সুদখোর অঘোর ঘোষ বেঁচে ওঠে, তাদের আগে ছোবল দেয়। সমাজের পরজীবী মানুষের টাকায় বাঁচা লোকদের কখনো বিশ্বাস করতে নেই। নাটকটি দেশজ ভাষায় সংলাপের মধ্যে দিয়ে মানুষের মন আরো স্পর্শ করেছে। মাটির ছোঁয়া লাগা গরিব শোষিত মানুষের ঘরের কথা শোনা যায় এই নাটকে।  

 


মনোজ মিত্রের সবচেয়ে চর্চিত জনপ্রিয় নাটক সাজানো বাগান-এ আমরা গরিব বাঞ্ছারামের বাগান জবরদখল করতে জমিদারের মধ্যে সেই এক পরজীবী, অত্যাচারী শোষক শ্রেণির ছবি দেখতে পাই। সাধারণ মানুষের মন জয় করা এই নাটক অন্যায়ের বিরুদ্ধে সৎ মানুষের জয়ের কথা বলে। সাধারণ মানুষের গল্প তিনি বলেছেন এমন সাদামাঠা ভঙ্গিতে যে মানুষ মনোজ মিত্র ও তাঁর সৃষ্টির আপনজন হয়ে উঠেছে। বিদগ্ধ গবেষক ও সাধারণ দর্শক সবার ভালো লাগে কারণ তিনি নতুন দিনের গল্প শোনান। তাঁর নাটকে অত্যাচারী ধনী কখনোই সাধারণ গরিব প্রতিপক্ষের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারে না। সাজানো বাগান নাটকটি যেন চিরকালের এক সমাজচিত্র।

 


ধর্মের নামে রাজনীতি তিনি বরদাস্ত করতে পারতেন না। চোখে আঙ্গুল দাদা আর নরক গুলজার নাটকদুটিতে ধর্ম নিয়ে ব্যবসা আর রাজনীতিকরণের তীব্র প্রতিবাদ করেছেন। আপাত হাসির নাটক বলে পরিচিত নাটকদুটি তাঁর মেধা, প্রকাশভঙ্গি ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার স্বাক্ষর বহন করে। তাঁর সৃষ্ট  সাধারণ মানুষের চরিত্রগুলি সব সময় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে অনন্য। ঋজু, সৎ এবং আত্মমর্যাদায় বলীয়ান। ঝড় ঝঞ্ঝা, প্রলোভন তাদের নত করতে পারে না। আমাদের দেশের খেটে খাওয়া নির্লোভ মানুষের চরিত্রায়ণ। তাঁর চরিত্র সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে বোঝা যায় মানুষের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ও ভালোবসা। 

 


প্রথম জীবনে দর্শনের অধ্যাপক হতে চাননি নাটকের জন্য। তাঁর নাটকের প্রতি যে বাল্যপ্রেম, তাকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে অবশ্য রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটক বিভাগে অধ্যাপক পদে যোগদান করেন। কালক্রমে বিভাগীয় প্রধান হন। নাটক তাঁর ব্যক্তিত্বের অবিচ্ছিন্ন অংশ। তাই নাট্যচর্চা ও নাটকের অধ্যাপনাকে বেছে নিয়েছিলেন। তৈরি করেছেন অনেক শিল্পী, তরুণ নাট্যকার। নাট্যচর্চাকে যাতে ছাত্ররা যাপন করে নেয়, তার জন্য সব সময় উৎসাহ দিতেন। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য তৈরি করে গেছেন একঝাঁক মালি, যারা নতুন ফুল ফোটাবে। 

 


১৯৮৫ সালে পেয়েছেন সঙ্গীত নাট্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার শ্রেষ্ঠ নাট্যকার হিসেবে। অজস্র পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। জীবনের শেষ পাতায় এসে আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন তাঁর আত্মজীবনীমূলক লেখা 'মনোজাগতিক'-এর জন্য। তবে একজন শিল্পীর কাছে সবচেয়ে বড় পুরস্কার অগণিত মানুষের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা।

  • সংহিতা বাগচি 
img
আগের পাতা
সম্মোহন