কথাতেই বলে , বাঙালির পায়ের তলায় সর্ষে। সুযোগ পেলেই বাঙালির মন ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে দেদার ছুট দিতে চায়।উনিশ শতক থেকে আজ একুশের শতকের দ্বিতীয় দশক, বাঙালির ভ্রমণ ঘিরে গল্পের আর শেষ নেই। এই ভ্রমণ বিলাস বাঙালির মন এবং মেধার বিকাশে যেমন বড় ভূমিকা পালন করেছে, তেমন ই বাঙালির হৃদয়কে প্রসারিত করবার ক্ষেত্রেও খুব বড় ভূমিকা পালন করেছে।
ভ্রমণ ঘিরে নষ্টালজিয়া নেই- এমন বাঙালি বোধহয় একজনকেও খুঁজে পাওয়া যাবে না। আজকের প্রজন্ম হোলডোল বগলদাবা করে বেড়াবার মজা থেকে বঞ্চিত।আর হোলডোল নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার গপ্পে ঢোকবার আগে যেটা থাকে , সেটা হল, সমস্ত জিনিষপত্র বোঝাই করবার পর হোলডোলটাকে গুটিয়ে ভাঁজ করবার গপ্পো।আর এই কাজে বাড়ির ছোট ছেলেপিলে যে বা যারা থাকে , তাদের যে সেই সময়ে কী অপরিসীম গুরুত্ব দিতেন বাড়ির বড়রা-- সে গুরুত্বের স্বাদ যারা পায় নি, তারা বুঝতেই পারবে না।
আজকের প্রজন্মের ছেলেপিলেদের মনে হতেই পারে হোলডোলের মত একটা জবরজং বস্তু নিয়ে বেড়াতে যাওয়া, সেই হোলডোল খুলে রাতে ট্রেনের ব্যাঙ্কে বিছানারা করা , নামবার স্টেশন এসে গেলে কষ্টেশিষ্টে সেই হোলডোল ভাঁজ করা, এবার ভাঁজ করবার সময়ে বাড়ির ছোটরা কেউ ভ্রমণসঙ্গী না হলে, তাদের অভাবে বাবা, কাকা, মামাদের নাজেহাল হওয়া-- এসবের মত বড্ড ঝকমারির ব্যাপার এখন আর অবশিষ্ট নেই, যাক , বাঁচা গেছে বাবা।
হোলডোল আর কঁচিকাচা-- এই সম্পর্কটা যে এত ই দুষ্টুমিষ্টি একটা সম্পর্ক ছিল , সেটা যাঁরা না দেখেছেন, তাঁরা ছাড়া অন্যদের পক্ষে ঠিক বুঝে ওঠাটাই মুশকিল। বেশ ঠেঁসেঠুঁসে তো হোলডোল ভর্তি করা হলো।সেটাকে রোল ও পাকানো গেল কোনো মতে।এবারে যে হোলডোলের ফিতের কাঁটা টা ঠিক ঠিক ঘরে আঁটকে দেওয়ার সময়েই গোল বাঁধতে শুরু করেছে।ওভারলোডের ঠেলায় কিছুতেই সবদিক ম্যানেজ করেও হোলডোলের ফিতেটাকে আর নির্দিষ্ট ঘরে আটকে দিতে পারছেন না বাড়ির সিনিয়ারেরা।
অতএব কি করা যায়? ডাক পড়লো বাড়ির খুদেদের। রোল করে রাখা হোলডোলের উপর চেপে বসলো এই কচিকাচার দল।তবু রক্ষা হচ্ছে না।দরকারে সেই কচিকাচার দল পাড়া ঝেটিয়ে সঙ্গী জুটিয়ে আনলো।সবাই মিলে হোলডোলের উপর বসে , লাফিয়ে ঝাপিয়ে কোনোমতে বাগে আনলো সে হোলডোল কে।তারপর পায়ে সর্ষের দানার তোড়ে ছুট ছুট আর ছুট।
বেড়াতে যাওয়া আর তার সঙ্গে রেলগাড়ির সম্পর্কটা একটা ঘন দুধে হালকা চিনির মত ব্যাপার। এখন যেমন বেড়ানো মানে এরোপ্লেনের হুঁশ দৌড়-- একটা সময়ে বাঙালির পকেট মারমিট করলেও জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বেড়াতে যাওয়ার সময়ে ধনী বাঙালিও প্লেনের কথা ভাবতেন ই না। ছোট সন্তানকে ঘুম পাড়াতে যেমন রেল গাড়ি ঘিরে গল্প বলা মা , দিদিমা, পিসীমা, মাসীমাদের একটা দস্তুর ছিল , ঠিক তেমনটাই রেলগাড়ি ঝিকমিক আর বাঙালির সুদূরের পিয়াসী মন সেকালের মত একালেও অনেকটাই মিলে মিশে আছে।
সেকালে বেড়াতে যাওয়ার সময়ে ট্রেনে জল যাওয়ার জন্যে ছোটো জলের কুঁজো নেওয়া ছিল আবশ্যক।সেকাল যখন একালে মিশতে শুরু করলো , তখন জলের কুঁজোর জায়গা নিয়ে নিলো ওয়াটার বটল।হরেক কিসিমের রঙচঙে ওয়াটার বটল। বেড়াতে যাওয়ার সময়ে পাশের বাড়ি থেকে আরো একটা এক্সট্রা ওয়াটার বটল চেয়ে নিয়ে যাওয়া-- এসব গুলো তে সেকালে কোনো পক্ষ ই কোনো কিছু মনে করত না।
সেকাল একালে এসে ঠেকবার পর দূরপাল্লা, কাছপাল্লা-- পায়ের নীচে সর্ষে দিয়ে যেদিকেই বের হওয়া যাক না কেন, হরেক কিসিমের বোতল বন্দি পানীয় জল ট্রেনেই মিলবে।বাড়ি থেকে জল বয়ে আনা- এখনকার প্রজন্ম সেসব জানেই না।যেমন তারা দেখে নি ট্রেনে রাতের সাওয়ারী হলে বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে আসবার ব্যাপার স্যাপার।
ট্রেনের সিটে আসনপিড়ি হয়ে বসে বাড়ি থেকে আনা শালপাতায় লুচি আলুরদম খাওয়ার মজাটাই আলাদা রকমের ছিল। রাতের রেলগাড়ির সমস্ত নিস্তব্ধতাকে খান খান করে ছুটে চলেছে।সেই গতিবেগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হরেক মানুষের হরেক রকমের খাবারের গন্ধে মাতোয়ারা কম্পার্টমেন্ট ।অবাঙালি যাত্রীদের আচারের গন্ধের সঙ্গে বাঙালির ফোড়নের গন্ধ মিলেমিশে একটা অন্যরকম মৌতাতে মাতিয়ে দিচ্ছে পায়ের নীচের সর্ষের দানাগুলোকে।
ট্রেনের কমড়ার সাজসজ্জার ও অদল বদলে সেকালের স্বাদ গন্ধে এসেছে অনেক বদল।এককালে নন এসি ফার্স্ট ক্লাস কামরা, সেখানে কুপ গুলো কেমন আলো আঁধারির রহস্য তৈরি করতো।সত্যজিৎ রায়ের ' জয়বাবা ফেলুনাথ' বা সমরেশ বসুর ' গোগোল' কে ঘিরেই সেই ফার্স্ট ক্লাস কামরা আর তার কুপের স্বাদ মেটাতে হবে আজকের প্রজন্মকে। এই কুপের আপার বাঙ্কে শুয়ে ঢাকনাওয়ালা লাল, নীল আলোর খোলোস আর শৈশবের মিলে মিশে যাওয়ার স্বাদ যাঁরা একবার পেয়েছেন, সে স্বাদ তাঁদের পক্ষে কখনো ভুলে যাওয়া সম্ভবপর নয়।
আজ থেকে তিরিশ চল্লিশ বছর আগেও মধ্যবিত্ত বাঙালির ভ্রমণে অফবিট জায়গা এতটা জ্বলজ্বলে হয়ে ওঠে নি। তীর্থের তাগিদে হিমালয় বনাম প্রকৃতির নেশায় হিমালয়-- এই টানাপোড়েনে বাঙালি যেন তার বেড়ানোর নেশাকে আরো শক্ত পোক্ত করে তুলতে পেরেছে।মা লেডি যোগমায়া দেবী তীর্থের আকর্ষণে পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে হিমালয়ে আর পুত্র উমাপ্রসাদ হিমালয়কে ঘর বাড়ি পাতিয়ে মায়ের সঙ্গী-- এদৃশ্য যে এককালে কেবলমাত্র ৭৭ নম্বর রসা রোডেই আবদ্ধ ছিল-- এমন টা ভেবে নেওয়ার কোনো কারন নেই।পথের নেশায় পথ কে ঘর পাতিয়েছিলেন যেমন হিমালয় পথিক উমাপ্রসাদ, তেমন ই তাঁর সঙ্গী হয়েছিলেন সেযুগের নামকরা শিশু চিকিৎসক মণি বিশ্বাস, তাঁর পত্নী ভক্তি বিশ্বাসেরাও।ভ্রমণ নেশারু রামানন্দ ভারতী ( লীলা মজুমদারের দাদামশাই) থেকে উমাপ্রসাদ হয়ে কালকূট- সমরেশ বসু থেকে আজকের প্রজন্ম-- এই পায়ের নীচে পর্ষের দানা ফেলে, সেই গড়ান্তিতে পদযুগল কে অভ্যস্থ করে নেওয়ার যে ট্রাডিশন , সেখানেই যেন লুকিয়ে আছে আর একটা অন্য বাঙালিয়ানা। এই বাঙালিয়ানাতে কোনো খাদ নেই।রয়েছে কেবলমাত্র ই আনন্দ, অনাবিল আনন্দ।পথের নেশায় পথকে মিতালি পাতানোর মধ্যে দিয়ে পথচলতি জনপদ থেকে শুরু করে মানুষ-- কত যে অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে জীবনতরণীকে বয়ে নিয়ে চলে ।সে চলার পথ কখনো মসৃণ হয়।কখনো বা অতি বন্ধুর।কিন্তু পথের প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করে লক্ষ্যে শেষপর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া- তার মধ্যেই ধারণ করে থাকে চিরন্তন বাঙালির অদম্য জেদ।দুর্জয় কে শেষ পর্যন্ত জয় করবার আনন্দ।তখন আনন্দ আর আনন্দ।কেবলমাত্র আনন্দ। এই আনন্দের স্রোতে ভেসে যাওয়ার নাম ই সুদূরের পিয়াসা। এ পিয়াস কখনো বাঙালির মিটবে না।ভ্রমণের নেশাতে কখনো কোনোমতেই ক্লান্ত হবে না বাঙালি।