শুক্রবার ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪
সম্পূর্ণ খবর
AA | ০৩ জুন ২০২৩ ১৯ : ৪৩Rishi Sahu
শ্যামশ্রী সাহা: সদ্য মুক্তি পেল ‘অর্ধাঙ্গিনী’। ছবির পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়। একাধারে তিনি কাহিনিকার, চিত্রনাট্যকার। ছবি দেখার আগে প্রতিবেদকের প্রশ্ন ছিল, সামাজিক কোন বার্তা পৌঁছে দেবে 'অর্ধাঙ্গিনী'? পরিচালক জানিয়েছিলেন, 'বন্ধুত্বের বার্তা'। আরও একটি প্রশ্নও ছিল। ‘বিজয়া’, ‘বিসর্জন’, ‘কাবেরী অন্তর্ধান’ ছবিতে নিখুঁত ভাবে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন নারীর মনের কথা। যে কথা বুঝতে পুরুষের আজন্ম কেটে যায়, সে কথা এত সহজে কীভাবে বলেন? কৌশিকের উত্তর ‘‘নারীর মনের কথা পুরুষ ছাড়া কে বলবে এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে? এই সমাজে নারীকে একদিকে পুজো করা হয়েছে। অন্য দিকে স্বামীর চিতায় তুলে দেওয়া হয়েছে। তাই বারবার আমার মনের দরজায় কড়া নাড়ে নারী-মন।’’ সময় এগিযেছে, প্রগতিশীল এই সমাজে নারী তাঁর অধিকার জয় করে নিয়েছে। প্রমাণও করেছে বারবার, ‘আমি নারী আমি মহিয়সী।’ তবুও পুরুষের জটিল মনস্তত্ত্বের শিকল থেকে মু্ক্ত হতে পারেনি। আজও সংসার ভাঙলে আঙুল ওঠে স্ত্রীর দিকেই। প্রশ্ন ওঠে, কেন সে স্বামীকে বেঁধে রাখতে পারল না? সন্তানের জন্ম দিতে না পারলে, কিংবা বারবার কন্যাসন্তানের জন্ম দিলেও কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয় মেয়েদেরই।
এমনই দু’জন নারীর জীবনের ওঠাপড়ার গল্প ‘অর্ধাঙ্গিনী’তে। একজন স্বার্থপর, অক্ষম পুরুষের সক্ষমতার দায়ভার বয়ে নিয়ে যেতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়েছে দুই নারী। ভবানীপুরের বনেদি চট্টোপাধ্যায় পরিবারের মেজ ছেলে সুমন (কৌশিক সেন)।
স্ত্রী শুভ্রা (চূর্ণী গঙ্গোপাধ্যায়)। নিঃসন্তান এই দম্পতি বিয়ের ১৭ বছর পর আলাদা থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। যৌথ সিদ্ধান্ত ঠিক বলা যায় না। বরং বাধ্য হয়েই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে যেতে হয়েছে শুভ্রাকে। কারণ হিসাবে সুমন মতপার্থক্যের যুক্তি খাড়া করেছে। ১৭ বছর ঘর করার পর খুব চেনা মানুষটাই অচেনা হয়ে গিয়েছে। তার উপস্থিতিও এখন বিরক্তিকর। এমন আরও অদ্ভুত যুক্তিতে আলাদা হয়ে গিয়েছে দুটো মন।
বিচ্ছেদের কিছুদিন পর সুমনের সঙ্গে আলাপ মেঘনার (জয়া আহসান)। বাংলাদেশের এই উঠতি গায়িকা সদ্য স্বামীকে হারিয়েছে। বাড়ির অমতে সুমন বিয়ে করে মেঘনাকে। ভবানীপুরের অভিজাত পরিবারে ঠাঁই পায় না মেঘনা। সুমন-মেঘনার নতুন সংসার ভালই চলছিল। সব হিসাব পাল্টে যায় হঠাৎ সুমনের সেরিব্রাল অ্যাটাকে। আবার অসহায় মেঘনা। এবার তিনি কী করবেন?
প্রথম দৃশ্যেই এই ছবির প্রাণ-প্রতিষ্ঠা করেছেন চূর্ণী। ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে চোখের সামনে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে ‘প্রাক্তন’। মন চাইছে ছুটে যেতে। কিন্তু দুটো পা অভিমান, অপমানের শিকলে বাঁধা। দ্বিধা-দ্বন্দ্বের প্রত্যেকটা মুহূর্ত বাঙ্ময় চূর্ণীর অভিব্যক্তিতে। ‘শুভ্রা’ কি খুব স্বার্থপর? নাকি অসহায়? দোলাচলে ফেলেছে দর্শককেও। ১৭ বছরের সংসার ছাড়ার মুহূর্তও একইভাবে প্রাঞ্জল করে তুলেছেন চূর্ণী। অভিব্যক্তি আর একটিমাত্র সংলাপে। একটি দৃশ্যে নিজের প্রিয়জন ও সংসারকে ‘রানিং কমেন্ট্রি’ দিয়ে অন্যের হাতে সাজিয়ে তুলে দিচ্ছে শুভ্রা। এই অভিনব ভাবনাকে বোধহয় একমাত্র রূপ দিতে পারেন চূর্ণীই।
অপর দিকে, মেঘনা আপাতদৃষ্টিতে সুমনের সঙ্গে সুখে থাকলেও সুমন কি সত্যিই তাকে ভালবেসে বিয়ে করেছিল? নাকি তুরুপের তাস হিসাবেই ব্যবহার করেছে? উত্তর প্রেক্ষাগৃহের জন্যই তোলা থাক।
শুভ্রার জানা মোক্ষম সত্যিকে আড়াল করার প্রয়াসে সার্থক জয়া। কখনও ক্ষোভে ফেটে পড়ছেন, কখনও অসহায় আর্তিতে নিজেকে উজাড় করেছেন। এই দৃশ্যের প্রত্যেকটা সংলাপে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধেছেন দর্শককে। ঘরের চার দেওয়ালের ‘কোর্টরুম’-এ মুখোমুখি শুভ্রা ও মেঘনার কথোপকথনে একদিকে যেমন ভেঙেছে মেঘনা, অপর দিকে নিজেকে গুটিয়ে পৌরুষত্বের মিথ্যে আস্ফালনের মুখোশ খুলেছে শুভ্রা। এভাবেই, একজন ‘অর্ধাঙ্গিনী’ সহযোদ্ধা। আর একজন সহমর্মী প্রতিপক্ষ। জয়া ও চূর্ণীই যে এই ছবির দুই সুতো, তা বোঝাতে কার্পণ্য করেননি পরিচালক। সুমনের চরিত্রে কৌশিক সেন যথাযথ। তবে দুই সুতোর মাঝে গিঁটের মতো উজ্জ্বল অম্বরীশ। দুই নারীর মধ্যে যোগসূত্র তৈরি করা এই পুরুষটিকে দর্শকের চোখে 'মহান' করে তুলতে তিনি সার্থক। আত্মীয়তা, বন্ধুত্বের আসল বার্তা এখানেই। কৌশিক সেনের মায়ের ভূমিকায় লিলি চক্রবর্তী আজও অসাধারণ। আর ‘বিহু’ (দামিনী বেণি বসু) দর্শকের ভারাক্রান্ত মনে যেন দখিনা হাওয়া। দামিনীর মতো অভিনেত্রীকে দর্শক পর্দায় আরও বেশিক্ষণ দেখতে চাইবেন আগামী দিনে।
ছবিতে জয়ার আগের জীবনের কিছু মুহূর্ত থাকলে মন্দ হত না। অনুপমের দক্ষ সঙ্গীত পরিচালনায় আরও দু-একটা গান থাকতেই পারত। শুরু করেছিলাম বন্ধুত্বের বার্তা দিয়ে। অনুভবী ভাবনা, নিপুণ চিত্রনাট্যের শেষ দৃশ্যে বন্ধুত্বের বার্তা শুধু শুভ্রাই দিল!