ডাঃ পল্লব বসুমল্লিক: হপ্তাখানেক বাঁধনহীন, শেকল–ছেঁড়া অখণ্ড আনন্দের অবসর। শারদ উৎসব বাঙালিকে উদ্বেল, উত্তেজিত, আলোড়িত করে। আর উৎসবে বঙ্গজীবনের অঙ্গ— দেদার খাওয়া–দাওয়া। সে ‘ইটিং আউট’ হোক কিংবা বাড়িতে চর্ব্য–চোষ্য–লেহ্য–পেয়। লুচি–মণ্ডা–বিরিয়ানি–রোল–চাউমিন থেকে দেশ বিদেশের হরেক কুইজিন। এদিকে ‘গ্যাসে–অম্বলে’ বাঙালির নোলার সাধ আর পেটের সাধ্যে বিস্তর ফারাক। চোঁয়া ঢেকুর, বুক জ্বালা, পেট ফাঁপা, বদহজম নিত্যসঙ্গী। পুজো বলে তো সে–সব ছাড় দেবে না! তার ওপর একসঙ্গে এত গুরুপাক ভোজন। এনআরসি আতঙ্কের চেয়েও কারও কারও মনে চেপে বসেছে ‘অ্যান্টাসিড’ ভীতি! এমন তথ্য ব্যাপক ছড়ানো হয়েছে— র্যানিটিডিন থেকে নাকি ক্যান্সার অবধারিত। কারণ রীতিমতো কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে ইউএসএফডিএ (মার্কিন ওষুধ ও খাদ্য নিয়ন্ত্রা)। তা এটা তো আজকের ঘটনা নয়, শুধু প্রচারিত হচ্ছে হালে। র্যানিটিডিন থেকে তৈরি এন–নাইট্রোসোডাইমিথাইলঅ্যামিন (এনডিএমএ) দীর্ঘদিন খেয়ে চললে যে পেটে ক্যান্সারের ভয় আছে তা বিশ্বে নানা গবেষণাপত্রে এক দশক আগেই বহুল প্রচারিত। কেউ আমল দেননি। যেমন আরও একটি চালু ওষুধ ফ্যামোটিডিন অবিরাম খেয়ে চললে হার্টে নাকি কিছু অসঙ্গতি ধরা পড়ে। গবেষণায় এটা সামনে আসার পর থেকেই বাঙালির অত্যন্ত বিশ্বস্ত ব্র্যান্ডটির বিক্রি অবশ্য এখন তলানিতে। ঠাকুর দেখতে বেরোনো কিংবা বাসে–ট্রামে–মেট্রোয় সওয়ার অনেক মানুষের সঙ্গে গত তিন দিন বিস্তর কথা হল। উৎসবের তোড়ে তাঁদের একেবারে ‘ডোন্ট কেয়ার’ মনোভাব। অনেকে বললেন, যা হয় হোক, অ্যান্টাসিড তো খেতেই হবে। সমীক্ষার জন্য ঘুরলাম শহরের মধ্যে এবং উপান্তে। আন্দুল রোড, ঘটকপুকুর বাজার, আমতলার বড় ওষুধের দোকানেই ওটিসি (ওভার দি কাউন্টার) এখনও দেদার বিকোচ্ছে র্যানিটিডিন। কয়েকজন দোকানি বললেন, কী করব, প্রেসক্রিপশনও পাচ্ছি যে। বরং শহরে নামী দোকানগুলোয় অনেকক্ষেত্রে বলা হচ্ছে, নিদানপত্র চাই।
অনেক বিশেষজ্ঞ–চিকিৎসকের সঙ্গে আলোচনা হল। তাঁদের একটাই বক্তব্য— যে কোনও ওষুধ মানেই তো রাসায়নিক। দীর্ঘদিন ব্যবহারে শরীরে বিক্রিয়া হবেই। বুঝে ব্যবহার করতে হবে। সংযত থাকা প্রয়োজন। যেমন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাঃ সন্দীপ চক্রবর্তী বললেন, ‘অ্যান্টাসিডের প্রয়োজন বদহজম, অম্বল বা অ্যাসিড রিফ্ল্যাক্স, পেটে আলসার কিংবা গ্যাস্ট্রাইটিসে। বাঙালির সমস্যা অন্যত্র। সাধারণ অ্যান্টাসিডে তাঁদের মন ভরে না। অ্যাসিডিটি–সম্পর্কীয় জটিল সব রোগে যে ওষুধ ব্যবহৃত হয়, সেগুলোই কাউন্টার থেকে বিনা প্রেসক্রিপশনে কিনে নেন সবাই’। খুব ভুল বলেননি তিনি। এখন আর সাধারণ অ্যান্টাসিড ক্যালসিয়াম কার্বোনেট, ম্যাগনেশিয়াম হাইড্রোক্সাইড, অ্যালুমিনিয়াম হাইড্রোক্সাইড, সোডিয়াম বাইকার্বোনেট বা সাইমেথিকনে কারই বা মনে শান্তি আসে! চাই এইচ টু রিসেপ্টর অ্যান্টাগোনিস্ট (সাইমেটিডিন, র্যানিটিডিন, ফ্যামোটিডিন, রক্সাটিডিন) জাতীয় ওষুধ। নয়তো আরও জোরালো পিপিআই (প্রোটিন পাম্প ইনহিবিটর্স) যার অন্তর্ভুক্ত ওমেপ্রাজল, ল্যান্সোপ্রাজল, প্যান্টোপ্রাজল, র্যাবেপ্রাজল প্রভৃতি। মেডিসিন অতি–বিশেষজ্ঞ ডাঃ সুকুমার মুখার্জি সাবধানবাণী শোনালেন, ‘কোনও অ্যাসিড কমানোর ওষুধই লাগাতার খেয়ে চলা ঠিক না। ডাক্তার না বললে সে ওষুধ দয়া করে খাবেন না। প্রেসক্রিপশন না থাকলে দোকানিরও তা দেওয়া উচিত না। সরকার এ ব্যাপারে কড়া পদক্ষেপ নিক। একসময় থ্যালিডোমাইড ট্র্যাজেডি ঘটেছিল। সালফোনামাইডেও বিস্তর সমস্যা। কেন্দ্র ফার্মাকো–ভিজিলেন্স চালু করেছে। নিয়মিত তদারকি প্রয়োজন। ড্রাগ কন্ট্রোলারদের দায়িত্ব বাড়ল’।
তাহলে পুজোয় কী করবেন? পানভোজন সবই চলুক। সবক্ষেত্রে পরিমিতি থাকবে এমন না। খুব সমস্যায় পড়লে পরিচিত ডাক্তারবাবুকে একবার ফোন করে নিন। গ্রামেগঞ্জে স্বাস্থ্যকেন্দ্র খোলা থাকবে, সাহায্য ও পরামর্শ নিন। র্যানিটিডিনের মতো প্রশ্নচিহ্নে ঝুলে থাকা ওষুধ এড়িয়ে চলাই ভাল। একান্তই খেতে হলে অল্পদিনের জন্য খান, আবার কিছুদিন বন্ধ রাখুন। প্রাগৈতিহাসিক শোনাতে পারে। নির্ভাবনায় চলুক ডাইজিন বা জেলুসিল, ট্যাবলেট নয়তো লিকুইড আকারে। গত ৭০ বছরে ভারতীয় বাজারে সর্বাধিক বিক্রিত ব্র্যান্ড এ দুটি। ভরসা রাখুন।
Aajkaal © 2017