কৌশিক রায়: মার্চের শেষ।
নিউ মার্কেটের প্রচণ্ড ভিড়ে কেনাকাটা করে গরমে ঘামছে দুই তরুণী। উল্টো দিকে আইসক্রিমের গাড়ি দেখতে পেয়েই ছুটল সেদিকে। দুটো বাটার স্কচের কাপ হাতে নিয়ে শান্তি। কিন্তু এই স্বাদ, নানারকম কৃত্রিম ফ্লেভারে শরীর সুস্থ থাকছে কি? সেই কথা ভেবেই আট থেকে আশি সকলের জন্য শুধু ফল ব্যবহার করে নতুন ধরনের আইসক্রিম আবিষ্কার করেছেন যাদবপুরের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক অসীম চট্টোপাধ্যায়। এই আইসক্রিম তৈরি হয় শুধু ফলের রস দিয়ে। বিভিন্ন ঋতুকালীন ফল দিয়ে আইসক্রিম বানান অসীমবাবু। তাঁর বক্তব্য, 'কাপ, কোণ যেই আইসক্রিমই কিনে খান না কেন সেটা আমার মতে স্বাস্থ্যসম্মত নয়। স্বাদ আর আকর্ষণের প্রতিযোগিতায় অনেক বেশি কেমিক্যাল ব্যবহার হয় এই সমস্ত আইসক্রিমে।'
মানুষ যাতে সুস্থ থাকে এবং তার সঙ্গে সঙ্গে আইসক্রিমের স্বাদটাও উপভোগ করে সে কারণেই এই নয়া আইস ক্যান্ডি আবিষ্কার করেছেন অসীমবাবু। যাদবপুরের প্রাক্তন অধ্যাপক জানালেন, ভারতে কত বৈচিত্র। বছরের এক একটি ঋতুতে নানা ধরনের ফলমূল, শাকসবজি বাজারে আসে। যে ঋতুতে যে ফল বাজারে ওঠে তা দিয়েই আইসক্রিম বানান তিনি। বললেন, ‘সব ফল তো মানুষ ভালবাসেন না। কলা, পেঁপে এসব দিয়েও আমি আইসক্রিম বানিয়ে দেখেছি। আমি যে আইসক্রিম বানাই তাতে বলতে পারেন ৯৯ শতাংশই ফলের রস থাকে। স্বাদের জন্য শুধু একটু চিনি দিতে হয়।' প্রায় ৬০ রকম ফল দিয়ে আইসক্রিম বানিয়েছেন এই গবেষক। আম, জাম, আঙুর, সবেদা, কমলালেবু, কামরাঙা, কাঁঠাল, ডাব, আতা, আনারস, তরমুজ, লিচু কী নেই সেই তালিকায়। বাড়িতেই ল্যাব তৈরি করে নিয়েছেন নিজের মতো। সংবাদপত্রে অ্যাসিস্ট্যান্টের জন্য বিজ্ঞাপন দেন। যাঁরা এসেছেন, নিজের হাতে ট্রেনিং দিয়েছেন তাঁদের। সারাদিন বাড়িতেই অ্যাসিস্ট্যান্টদের নিয়ে গবেষণা চালান নিজের মনে। কখনও কখনও অনলাইনে ক্লাস করান রাজ্যের বাইরে থাকা ছাত্রদের।
তবে এই আইসক্রিম তৈরির পিছনে রয়েছে এক অন্য গল্প। ২০০৪-০৫ সালে এক কৃষক নেতা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অশোকনাথ বসুর কাছে এসেছিলেন চাষীদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে। তাঁর দাবি ছিল, চাষীরা ফল উৎপাদন করছে কিন্তু তা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছনো যাচ্ছে না, বাজারজাত করা যাচ্ছে না। যদি তাঁরা কিছু একটা করতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের থেকে সেই ভাবনা আসে তৎকালীন সহ উপাচার্য প্রফেসর সিদ্ধার্থ দত্তের কাছে। দুজনে মিলে তারপর যোগাযোগ করেন কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সঙ্গে। সেই শুরু গবেষণা। অসীমবাবু বলেন, ‘প্রথমে আমরা আবিষ্কার করেছিলাম ঠিকই। কিন্তু বাইরের মানুষের কাছে আমরা তা পৌঁছে দিতে পারিনি। তখন ছাত্রদেরই বিনামূল্যে আইসক্রিম খাওয়াতে শুরু করি। দিন কয়েকের মধ্যে এর কথা এত ছড়িয়ে পড়ে যে অন্যান্য কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও ছাত্রছাত্রীরা আসত এই আইসক্রিম খেতে।'
বিশ্ববিদ্যালয়ে এই প্রোজেক্ট বন্ধ হয়ে গেলেও সাধারণ মানুষের কথা ভেবে রিটায়ার করার পর নিজের বাড়িতে আবার গবেষণা শুরু করেন অসীমবাবু। এখন প্রায় একশোর ওপর দোকানে নিয়মিত পৌঁছে যায় তাঁর এই আইসক্রিম। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপকের বাড়িতে গোটা একটা ঘর জুড়ে স্টোররুম রয়েছে। তাঁর এই গবেষণায় কর্মসংস্থান হয়েছে প্রচুর মানুষের। এক একটি আইস ক্যান্ডির দাম ২০-২৫ টাকা করে। নামীদামী আইসক্রিম কোম্পানি থেকেও ডাক এসেছে অসীমবাবুর। কিন্তু তাঁর এই আইসক্রিমের যে স্বাস্থ্যকর দিক রয়েছে তা নষ্টের আশঙ্কায় এগোননি তিনি। দায়িত্ব রেখেছেন নিজের কাঁধেই। কাঁচামাল থেকে শুরু করে ফলের বাজার করা, আইসক্রিম বানানো থেকে বাজারে পৌঁছনোর খরচ অনেকটাই। পাশাপাশি অন্যান্য গবেষণার চাপ। সব মিলিয়ে বিজ্ঞানের জগতেই দিন কাটান যাদবপুরের এই গবেষক। চিন্তা রয়েছে একটাই, কীভাবে পরিবেশকে সুস্থ রাখা যায়, সাধারণ মানুষকে সুস্থ রাখা যায়।