সম্রাট মুখোপাধ্যায়: ● থাপ্পড়। পরিচালনা: অনুভব সিনহা। অভিনয়ে: তাপসী পান্নু, পাভেল গুলাটি, কুমুদ মিশ্র, রত্না পাঠক শা, তনভি আজমি, রাম কাপুর, গীতিকা বিদ্যা, মায়া সারাও।
‘থাপ্পড়’ খাওয়ার ব্যথা থেকে থাপ্পড়ের স্মৃতি ভয়ঙ্করতর। গালে নয়। এর আঘাত ছাপ ফেলে মনে। ‘থাপ্পড়’ আসলে এক ক্ষমতার ভাষা।
আর ‘থাপ্পড়’–এর সেই ‘গুঞ্জ’ বা প্রতিধ্বনি শুনি আমরা ছবি জুড়ে। ‘থাপ্পড়’ সিনেমায়। ছবিতে এক পার্টির দৃশ্যে চড়টা খায় স্ত্রী অমৃতা (তাপসী পান্নু)। মারে তার স্বামী বিক্রম (পাভেল গুলাটি)। এই একটাই চড় ছবির কেন্দ্রে। কিন্তু চিত্রনাট্য যত এগোয়, চড়ের প্রতিধ্বনি তত যেন বাড়তে থাকে। আর অসংখ্য উপবৃত্ত জুড়তে থাকে মূল গল্পের আশপাশে।
এই যে মূল কাহিনির পাশে কতকগুলো ছোট ছোট বৃত্ত গড়ে দেওয়া, আলাদা আলাদা চরিত্রদের নিয়ে, এটা বুনতে গিয়ে বেশ একটা অন্যরকম ‘সিনেমা–টিক’ ভাষার প্রয়োগ করেছেন পরিচালক অনুভব। যেটা খুব একটা সরল টানটান ‘ন্যারেটিভ’–এ গল্পটা বলে না, বরং বেশ ভাঙচুর করেই বলে, খানিকটা ইচ্ছাকৃত একঘেয়েমি তৈরি করেই বলে (অমৃতার অলসভাবে কাটা দিনগুলোকে চেনাতে–বোঝাতে কত যে একই রকম ‘সিকোয়েন্স’ ছবিতে ঘুরে ঘুরে আসে!), অথচ মজা হচ্ছে যে এ ছবি আবার বেশ ‘কমিউনিকেট’ও করে দর্শকদের সঙ্গে। হয়তো তা সমস্যাটির সার্বিকতায়। প্রায় প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ও নারীই সমস্যাটির সঙ্গে একাত্ম বোধ করবে ও নিজের প্রতিচ্ছবি কোনও না কোনওভাবে দেখতে পাবে। এখানেই এ ছবির ব্যাপ্তি ও সার্থকতা। নারীর যন্ত্রণার গল্প বলতে বসেও একপেশে চেনা–ছকের নারীবাদী ‘টেক্সট’ হয়ে ওঠেনি।
ছবি শুরু হয় প্রায় কোলাজের মতো কিছু বিচ্ছিন্ন মুহূর্ত জুড়ে। প্রতিটি আলাদা আলাদা সিকোয়েন্সে আলাদা আলাদা পুরুষ–নারী (তারা প্রেমিক–প্রেমিকা বা দম্পতি)। সামান্য আঁচড়ে, অল্প কথাতেই তাদের চরিত্র ও সম্পর্ক উন্মোচিত হতে শুরু করে। এখানে বাছতে গিয়ে সমাজের নানা স্তর থেকে, নানা শ্রেণি থেকে এইসব জুটিকে তুলে এনেছেন অনুভব। কেউ হয়তো বিবাহবিচ্ছিন্ন ‘এলিট’ উদার নারী, কেউ বাড়িতে কাজ করার ‘বাই’, কেউ নিছক গৃহবধূ, কেউ বা আবার সেই গৃহবধূর মা কিংবা শাশুড়ি, কেউ হয়তো উকিল। কেউ হয়তো স্বামীর সঙ্গে কথা বলছে, কেউ বলছে বৈধ প্রেমিকের সঙ্গে। কারও পাশে হয়তো অবৈধ প্রেমিক। ফলে গল্পের খোলসগুলো আলাদা, কিন্তু কিছুদূর এগোলেই দেখা যাবে গল্পের মূল সুতোটা এক। পুরুষতন্ত্রের সরব কিংবা নীরব চাপ। আর সে–চাপ এতটাই গভীরে যে এমনকী নারীও নিজের অজান্তে সেই পুরুষতন্ত্রের বক্তব্যকেই মনে মনে সমর্থন করে, ভুলবশত নিজের বক্তব্য বলে ভাবে। প্রচার করে। জামাইয়ের হাতে বিনা কারণে চড় খাওয়া মেয়েকে মা বলে, ‘ওইটুকু তো স্বামী–স্ত্রীর মধ্যে হয়েই থাকে।’ শাশুড়ি বোঝায়, ‘মেয়েদের অনেক কিছু সহ্য করে নিতে হয়।’ যদিও সেই শাশুড়ি নিজে ডিভোর্স না নিলেও স্বামীর থেকে আলাদা থাকেন ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে। এমনকী, একজন মহিলা উকিল, যিনি নিজে স্বামীর নানারকম অন্যায়ের মুখোমুখি হয়ে অন্য–প্রেমে মানসিক প্রেরণা খোঁজেন, যিনি বিবাহ–বিচ্ছেদের মামলার একজন সফল ও বিশেষজ্ঞ উকিল, তিনিও বলেন, ‘ব্যস, এটুকুই কারণ? মাত্র একটা চড়!’
অনুভব সিনহা এখন যে সব ছবি করেন, তার প্রতিটিই আমাদের নড়েচড়ে বসতে বাধ্য করে। প্রতিটি ছবিতেই তিনি কথা বলেন, কোনও–না–কোনও প্রান্তিকের অধিকার নিয়ে। ‘মুল্ক’–এ তা হয় দেশে মুসলিম নাগরিকদের অধিকার। ‘আর্টিকেল ১৫’–য় হিন্দু নিম্নবর্গের মানুষদের অধিকার। আর এবার ‘থাপ্পড়’–এ তা হয় নারীর আত্মসম্মানের অধিকার।
কোনও স্বামী চড় মারে। কেউ মারে না। সে হয়তো কথায় মারে। আসলে ক্ষমতার প্রকাশটা থাকে বিদ্ধ করার। অপমান করার। পার্টিতে অমৃতা চড়টা খায় নিজের দোষে নয়। বর যখন অফিস বসের সঙ্গে উত্তপ্ত তর্কে মত্ত, তাকে শান্ত করতে গিয়ে। পরের দিন সকাল থেকে অমৃতাকে নিজের কাছে টানার চেষ্টাও করে বিক্রম। অমৃতাও গোটা রাত জেগে থেকে (এই দৃশ্যে সোফা, চেয়ার একা টেনে গোছগাছ করে শারীরিক ব্যস্ততা দিয়ে মানসিক যন্ত্রণা ভোলার চেষ্টা করার দৃশ্যটি অনবদ্য) নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করে। চেষ্টা করে এরপরও বিক্রমের প্রতি রূঢ় না হতে। কিন্তু এটাও সে বোঝে, আর সরাসরি বলেও, যে সম্পর্ক ভেঙে গেছে। কারণ ওই একটা থাপ্পড় তাকে চিনিয়ে দিয়েছে তার জায়গাটা। শেষে যা ঘটে তা প্রত্যাশিতই ছিল। তবু যথেষ্ট নাটকীয়তা নিয়েই ঘটে।
এ ছবির চিত্রনাট্য যদি সবচেয়ে বড় জোর হয়, তবে তার পরের জোর হল ওই ছবির মহিলা শিল্পীদের অনবদ্য চরিত্র চিত্রায়ণ। তার ভেতর একদিকে রত্না পাঠক শা, তনভি আজমি, দিয়া মির্জার মতো অভিজ্ঞ অভিনেত্রীরা যেমন আছেন, তেমনই চমকে–দেওয়া দাপট দেখিয়েছেন মায়া সারাও (উকিল), গীতিকা বিদ্যা (কাজের মেয়ে) বা নয়লা গ্রেওয়াল (অমৃতার ভাইয়ের প্রেমিকা)। বিক্রম বা অমৃতা ভাইয়ের চরিত্রে দুই নতুন মুখ পাভেল গুলাটি আর অঙ্কুর রাঠি খুব ভাল। তিন অভিজ্ঞ অভিনেতা কুমুদ মিশ্র, রাম কাপুর আর মানব কাউল যখনই পর্দায় এসেছেন, চোখ টেনে নিয়েছেন। গোটা ছবি অনবদ্য সব ছোট–বড় চরিত্রায়ণে ভরপুর।