সম্রাট মুখোপাধ্যায় : ● আর্টিক্ল ১৫। পরিচালনা: অনুভব সিনহা। অভিনয়ে: আয়ুষ্মান খুরানা, ঈশা তলোয়ার, কুমুদ মিশ্র, মনোজ পাওয়া, মহঃ জিশান আয়ুব, সায়নী গুপ্তা, নাসের।
একটা জলা পেরোনোর গল্প। নোংরা একটা জলা। মরা শুয়োর আর বিষ্ঠায় পরিপূর্ণ একটা জলা, যেখানে নামে শুধু নিম্নবর্ণের মানুষেরা।
অথচ ওই জলাটা যদি পেরোনো যায়, তার ওপারেই আছে জীবনের আশ্বাস। দেশের প্রাণযন্ত্রটা যেন ধুকপুক করে বাঁচছে সেখানে। শুধু জাতি–ধর্ম–দল ভুলে সবাইকে নামতে হবে ওই ‘শুয়োরতাল’–এর মতো জলায়।
রাজনৈতিক থ্রিলার। যা পোরা আছে এক পুলিশি তদন্ত কাহিনির ভেতরে। কিন্তু এই ছবি, অনুভব সিনহার এই ‘আর্টিক্ল ১৫’ শুধু থ্রিলার নয়, এ এমন এক মানবিক কাহিনি, যা দেখতে গিয়ে অজান্তেই বারবার চোখের কোল ভিজে ওঠে। অসংখ্য রাজনৈতিক রূপকের ব্যঞ্জনা ছড়ানো ছবি জুড়ে, কিন্তু কখনই সে সব রূপক জটিলতার গহ্বরে ঢুকে পড়েনি। বরং কোথাও কোথাও দুঃসাহস দেখিয়ে অনুভব কিছু কিছু কথা অভাবনীয় রকমের সোজাসাপটা করে বলে দিয়েছেন।
এ ছবির নায়ক উত্তরপ্রদেশ পুলিশ বাহিনীর এক এসিপি আয়ান রঞ্জন (আয়ুষ্মান খুরানা), যে প্রথম লালগাঁওয়ের মতো এক প্রত্যন্ত গ্রামীণ অঞ্চলে পোস্টিং পেয়েছে কর্তাভজা না হতে পারার ‘অপরাধে’। তার বান্ধবী (ঈশা তলোয়ার) শহরের নামী মিডিয়ার সাংবাদিক। আয়ান নিজেও আদ্যন্ত শহুরে, এলিট জীবনযাত্রা থেকে আসা একজন মানুষ, যার কাছে এই লালগাঁও যেন ভিন্ন এক গ্রহ। অভিজ্ঞতা তাকে দ্রুতই বুঝিয়ে দেয়, সে যেন ‘ইন্ডিয়া’র অধিবাসী। আর যে ‘ভূখণ্ডে’ সে এসেছে তা হল ‘ভারত’। এই আলো–অন্ধকারের দ্বন্দ্বটিকে পর্দায় ভারি চমৎকার দৃশ্যগ্রাহ্য রূপ দিয়েছেন চিত্রগ্রাহক এওয়ান মুলিগান। তাঁর ক্যামেরায় অন্ধকারের দৃশ্য এক নতুন মাত্রা পেয়েছে। এওয়ান মুলিগানের এই ক্যামেরা–কারুকার্য ছাড়া পর্দায় লালগাঁও কখনও গোটা ভারতের প্রতিভূ হয়ে উঠতে পারত না।
আয়ান এ অঞ্চলের কর্মভার বুঝে নেওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পাঁচটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটে। আপাতভাবে পাঁচটি ঘটনা বিচ্ছিন্ন। কিন্তু আয়ান তার বিশ্লেষণী মন দিয়ে বোঝে যে, এরা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। একটা পাপ চাপা দিতে অন্য একটা পাপকে ডেকে আনা হচ্ছে। যে সত্যকে চাপা দিতে এতসব ঘটনার অবতারণা এবং জাতপাত ইত্যাদি বিভেদমূলক রাজনীতিকে প্রশ্রয় দিয়ে যাওয়া, তার পেছনে আছে আসলে শ্রমের বাজারকে সস্তা রাখার কু–অভিসন্ধি।
এই মূল উৎসে পৌঁছতে পারে বলে এ ছবির নায়ক চরিত্রটিকে আদ্যন্ত অন্যরকম লাগে। সে একজন দুঁদে পুলিশ অফিসার। অথচ হিন্দি ছবির ‘কোড’ মেনে দুষ্ট দমনে সে একবারও অ্যাকশনে নামে না। গোটা ছবিতে ভিলেনের দল একবারও তাকে শারীরিকভাবে আক্রমণ করে না। বরং এই অফিসারকে ঘিরে চাপের দৃশ্যটি তৈরি হয় অন্যভাবে। মূল সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে থানায় নিয়ে এসে জেরা করছে আয়ান। আর জেরার ভেতরেই চূড়ান্ত দমচাপা টেনশনের দৃশ্যটি তৈরি করেন অনুভব।
আবার এ ছবিতে দুটো প্রেমের গল্প আসে। দুটোই যেন ‘আউটসাইডার’ বলিউড ঘরানায়। প্রথমটায় আয়ান আর তার বান্ধবীর মধ্যে যোগাযোগ হয়ে চলে শুধু ফোন কলে, তাও সেখানে ‘রোমান্টিক’ সংলাপ নেই, আছে শুধু তর্ক। আর দ্বিতীয় প্রেমটি আসে ওই অঞ্চলের এক প্রতিবাদী, ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’–এ থাকা নেতা নিষাদ (মহঃ জিসান আয়ুব অনবদ্য অভিনয় করেছেন, এ ছবি হয়তো তাঁকে নায়কের বন্ধু সাজার একঘেয়েমি থেকে মুক্ত করবে) আর তার প্রেমিকা গৌড়া (সায়নী গুপ্তা)–র মধ্যে। সেও এক অন্য–ভাবনার প্রেম হয়ে আসে।
এ ছবিতে সিবিআই যেন সেই সুপ্রিম কোর্টের বলা ‘রাজনৈতিক তোতা’। সিবিআই অফিসারের চরিত্রে নাসের যে অভিনয় করেছে, তা ভোলা যাবে না। একইভাবে আয়ানের দুই অধস্তন অফিসার মনোজ পাওয়া আর কুমুদ মিশ্র মুখোমুখি হলেই যেন বিস্ফোরণ ঘটেছে। আর আয়ুষ্মান খুরানার ক্ষেত্রে কোনও প্রসংসাই যেন যথেষ্ট নয়। হিন্দি ছবিতে পুলিশ হিসেবে তিনি স্পষ্ট করেছেন এক মৌলিক চরিত্রকে।