গৌতম রায়: আমাদের যে প্রজন্মটা এখন সিনিয়র সিটিজেনের সোপানের দিকে ধীরে ধীরে এগোতে শুরু করেছি, আমাদের কাছে নারায়ণ দেবনাথের প্রয়াণ শৈশব, কৈশোর ছেঁড়ার বেদনা বয়ে আনা একটা খবর।
সময়ের সঙ্গে পাল্লা রেখে বদলে যায় শিশুর শৈশব। আজকের শিশু, কিশোরেরা আমাদের কালের মতো করে শৈশব, কৈশোরকে উপভোগ করে না। উপভোগের উপকরণ আমাদের কালে একালের মতো ছিল না। কিন্তু ছিল খোলা মাঠ। ছিলেন ঠাকুমা, দাদু, দিদিমা, মাসি, পিসিরা। আর ছিল হাঁদা ভোঁদা, বাঁটুল দি গ্রেট, নন্টে ফন্টে। কী সব সৃষ্টি করছেন, সেসব জানা বোঝার বয়স হওয়ার অনেক আগেই এইসব চরিত্রগুলো আমাদের ঘরের মানুষ হয়ে গিয়েছিলেন। সেই ঘরের মানুষেরা আজ ও পরের কাছে চাবি রাখেননি ঘরে প্রবেশের জন্য। আজ ও নিজেকে খুঁজতে নিজেই নিজের শৈশবের তালা খুলতে পারে আমাদের প্রজন্ম নারায়ণ দেবনাথের রেখে যাওয়া চাবিটা দিয়েই।
শিশুর মনের নাগাল পাওয়া, কিশোরের বয়ঃসন্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তার মনের বিকাশে রঙিন স্বপ্ন আঁকা মুখের কথা নয়। একটা সময় স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ও আবহমান বাংলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছেলেভুলানো ছড়া সংগ্রহ করে প্রকাশ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের নিজের জীবনে মাতৃহারা ভুবনে পরিচারক পরিবৃত শৈশব যাপনের একটা যন্ত্রণা ছিল। সেই যন্ত্রণা থেকেই শিশুর ভুবনকে একটা রঙিন ভাবনা মোড়কে মুড়ে দেওয়ার তাগিদ তিনি চিরদিনই অন্তর থেকে অনুভব করতেন। আর সেই অনুভূতির স্ফুরণই ছিল দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার থেকে শুরু করে অবনীন্দ্রনাথের শিশু কিশোর মননলোক সৃষ্টির অন্যতম অনুপ্রেরণা।
দক্ষিণারঞ্জন ,অবন ঠাকুর দের প্রেক্ষিতকে সময়ের জলছবি তে রাঙিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে লীলা মজুমদার, সত্যজিৎ রায়দের সঙ্গে এগিয়ে এসেছিলেন কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়রা। কামাক্ষীপ্রসাদের লেখার গুণমুগ্ধ পাঠক ছিলেন অর্থনীতিবিদ অশোক মিত্র থেকে শুরু করে অতি সাধারণ পাঠক। গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বৈদগ্ধ্ মেশা ফ্যান্টাসি শিশু, কিশোর চিত্তে তৈরি করত এক অন্য ভুবন। এই সময়কালেই ছেলেভুলানো আঙ্গিকেই গভীর জীবনদর্শন মেশানো কালজয়ী ছড়া সৃষ্টি করতেন অন্নদাশঙ্কর রায়। শ্রীরামকৃষ্ণের বাড়িতে মিছ এসেছে, যার পেটে আর জিভে যা সয়, তেমন রান্না করে দিচ্ছেন মা, সেই উপমার মতো অন্নদাশঙ্করের ' তেলের শিশি ভাঙল বলে ' থেকে শুরু করে ' গিন্নি বলেন' এর ,' যেখানে যা কিছু ঘটে অনিষ্টি' , সেই উপমারই ছিল সার্থক উপস্থাপনা।
এই ঋদ্ধ সময়েই কিন্তু নারায়ণ দেবনাথের কার্টুন সাম্রাজ্যের বিস্তার। দীনেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'দুরন্ত ঈগল' তখন যেমন একদিকে কিশোর চিত্তে জাগাচ্ছে দেশকে ভালোবাসার তাগিদ, সেই সময়কালের সমান্তরাল রেখাতেই চলছে বাঁটুল, হাঁদা ভোঁদার সেই অপূর্ব সৃষ্টি। কিশোর চিত্তকে উদ্দেশ্যবিহীন আজগুবি মনোরঞ্জনের দিকে ঠেলে দেওয়ার প্রবণতা তখন ও শিশু কিশোর সাহিত্যে তৈরি হয়নি। হেমেন্দ্রকুমার রায়রা যেসব রহস্য কাহিনি সৃষ্টি করতেন, সেগুলিতেও বৌদ্ধিক দুনিয়ার একটা বড় জায়গা ছিল। শিবরাম চক্রবর্তী শিশুচিত্তকেও জীবনের অম্লমধুর যে স্বাদ দিতেন, সেখানেও একটা দর্শন থাকত, অর্থ থাকত। সেই ধারাকেই কার্টুনের দুনিয়াতে, আজকের অডিও ভিস্যুয়ালের মতো করে মেলে ধরেছিলেন নারায়ণ দেবনাথ।
লিখতে হয় বলে যেমন কিশোর সাহিত্যের জন্য কখনও কলম ধরেননি অবন ঠাকুর থেকে সুকুমার রায় হয়ে লীলা মজুমদারদের প্রজন্ম, ঠিক তেমন ভাবেই , কার্টুন আঁকতে হবে, 'শুকতারা' র পাতা ভরাতে হবে— এই ভাবনা থেকেই একমাত্র কার্টুন আঁকেননি নারায়ণ দেবনাথ। কিশোর চিত্তকে বিনোদনের উপকরণ জুগিয়েও তার চেতনার জগতে একটা বার্তা দেওয়া, বাংলা কার্টুন সাহিত্যে তেমনটা বোধহয় নারায়ণ দেবনাথের আগে কেউ করেননি। সময়কালেও কেউ করতে পেরেছিলেন কি না সন্দেহ। এই সন্দেহটা আরও তীব্রই হয়ে থাকল ভাবীকালের জন্যে।
নারায়ণবাবুর সৃষ্ট কার্টুনগুলো যদি একটু ধারাবাহিকভাবে দেখা যায়, তাহলে যে বিষয়টার উপর সবার আগে নজরে পড়বে তা হল বিষয় বৈচিত্র্য। অর্ধশতকেরও বেশি সময় ধরে একজন স্রষ্টা একটি–দু’টি চরিত্রকে এত সমসাময়িক সমাজবীক্ষণের বৈচিত্র্যময়তায় কীভাবে মেলে ধরতে পারলেন, সেটা ঘিরেই হয়তো আগামী দিনে গবেষণা হবে। নারায়ণবাবু কিন্তু তাঁর কার্টুনের চরিত্রগুলিকে সমসাময়িকতায় মেলে ধরতে কখনও রাজনীতির চলমান প্রবাহের ধারপাশ দিয়ে হাঁটেননি। কিন্তু রাজনীতির প্রবাহিত চিত্রে না ঢুকেও চলমান সমাজে কোনটা ভালো আর কোনটা ভালো নয়, মন্দ- সেটা ধরিয়ে দেওয়া, এই সামাজিক দায়বদ্ধতার বাইরে কিন্তু নারায়ণ দেবনাথের একটা কমিকসও নেই।
নারায়ণ দেবনাথের সৃষ্টিতে দুষ্টের দমনের স্বার্থে হিংসা এসেছে। কিন্তু সেই হিংসা সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সামাজিক জীবনে হিংসা প্রদর্শনের নিত্যনতুন যেসব উপকরণ, সেই উপকরণের গড্ডলিকা প্রবাহে কখনও নিজেকে মিশিয়ে দেয়নি। বাটুল ই হোক বা দুষ্টু হাঁদাকে উচিত শিক্ষা দিতে আপাতভাবে একটু বোকা, গোবেচারা মনে হওয়া ভোঁদার কর্মপদ্ধতি-- কোনও কিছুতেই ন্যায় প্রতিষ্ঠার নামে বোমা, গুলি, বন্দুক, বেয়নেট, কার্তুজকে সেভাবে আনেননি নারায়ণ দেবনাথ। শিশুর, কিশোরের কোমল মনোবৃত্তিকে কখনও হিংসার তাড়নায় অন্যখাতে বইয়ে দেওয়া-- এটা তাঁর সৃষ্টিকর্মের বেসিক চরিত্র বিরোধী ব্যাপার ছিল।
সময় বদলেছে। চেতনার অদলবদল ঘটেছে। নিত্য নতুন প্রযুক্তি শিশু-কিশোর চিত্তকেও অনেক কিছু আগের দিনের শিশু- কিশোরদের তুলনায় অন্যরকম করে ভাবতে শিখিয়েছে। আজকের দিনে কো–এড ইস্কুলের বহুল প্রচলন বয়ঃসন্ধির সময়কালকে অন্যরকম করতে গিয়ে ভাল করছে, না মন্দ করছে— এই বিতর্কের ভিতরেই বলতে হয়, নারায়ণ বাবু যখন কার্টুনের ভুবন সৃষ্টি করতে শুরু করেছিলেন, তখন কো এডুকেশন আজকের মতো জলভাত না হলেও কি সদরে, কি মফস্সলে শিশু-কিশোর বেলায় খেলাধুলার ভিতর দিয়ে লিঙ্গ বিভাজনের মানসিকতা বিরুদ্ধ চেতনার বীজ সেইসব মনে অঙ্কুরিত হত। যৌনতার এতো বিশ্বায়ন হয়তো তখন বাঙালি শিশুচিত্তে হয়নি। তাই আজ ক্লাস সিক্স, সেভেনের একটি শহুরে ছাত্র তার শিক্ষয়িত্রী ঘিরে নিজেদের ভিতরে যে পরিণত আলোচনার ভান দেখায়, তখন কিন্তু সেই প্রেক্ষিতটা ছিল না।
নারায়ণ দেবনাথ সেকালটাও দেখেছেন। একালটাও। কালের সঙ্গে তাল মেলানোর তাগিদে কিন্তু তিনি কখনও অতি আধুনিক করেননি তাঁর চরিত্রগুলোকে। আবার যৌনতার দূরাভাষকে উহ্য রেখে বিজ্ঞানকে বেমালুম অস্বীকার করে গিয়েছেন, তেমন অভিযোগও কিন্তু একটি বারের জন্যেও নারায়ণ দেবনাথ সম্পর্কে করা যাবে না। বিজ্ঞানমনষ্কতাই শুধু নয়, বিজ্ঞান- প্রযুক্তির নিত্য নতুন আবিষ্কার, গবেষণা— সেগুলি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিজের চরিত্রগুলিকে তিনি চিত্রিত করে গিয়েছেন কালে কালান্তরের বুকে- তেমন স্রষ্টাও কিন্তু নারায়ণ দেবনাথ ছিলেন না। শিশু-কিশোর চিত্তে ফ্যান্টাসির দুনিয়া নির্মাণে নারায়ণ দেবনাথের মুন্সিয়ানার সবথেকে সার্থক উপস্থাপনা বোধহয় এইটাই যে, বার্ধক্যের দ্বারপ্রান্তে আসা একজন মানুষেরও ডিপ্রেশন কাটাবার ক্ষেত্রে বাঁটুল, তার পিসিমা, নন্টে-ফন্টে, হাঁদা-ভোঁদা বা তাদের পিসেমশাই আজও অত্যন্ত সক্রিয় একটা ওষুধ!
একজন স্রষ্টার একটা, দু’টো, তিনটে চরিত্র নিয়ে অর্ধশতকেরও বেশি সময় সমান জনপ্রিয় থেকে যাওয়াটা কিন্তু আদৌ কোনও মুখের কথা নয়। নারায়ণ দেবনাথের মতো ধারাবাহিক জনপ্রিয়তার ট্র্যাক রেকর্ড বাংলা বা ভারতীয় অন্যান্য ভাষার শিশু সাহিত্য তো কোন ছাড়, আন্তর্জাতিক দুনিয়ার শিশু সাহিত্যের কোনও স্রষ্টার জীবনে ঘটেছে কি না তা নিয়ে রীতিমতো সংশয় আছে।
এই যে হাল্কা চালে জীবনের অনেক অনেক জটিল কথা বলতে পারার মতো ক্ষমতা, জীবনকে খুব গভীরভাবে, পরম মমতায় উপলব্ধি না করলে সম্ভব নয়। দেশভাগ, রাজনৈতিক চাপান-উতোর, দাঙ্গা, মনুষ্যত্বের সঙ্কট, অর্থনৈতিক সঙ্কট, নিজের ব্যক্তিজীবনের অর্থনৈতিক সমস্যা— এসব কিছুকেই যেন নীলকন্ঠের মতো আপন শিল্প সত্তায় ধারণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন নারায়ণ দেবনাথ। সেই সামর্থ্য তাঁর জনপ্রিয়তাই শুধু নয়, কালজয়ী হওয়ার টিআরপি।
Police: বয়স্কদের সঙ্গে ভাব জমিয়ে প্রতারণা! নতুন চক্র ধরল কলকাতা পুলিশ
SSC Scam: ফের ডিভিশন বেঞ্চের দ্বারস্থ পার্থ, প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীর মামলা থেকে সরলেন দুই বিচারপতি
SSC: রক্ষাকবচ দিল না হাইকোর্ট, পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে হেফাজতে নিতে পারবে সিবিআই
East West Metro: বন্ধ হয়ে গেল ইস্ট ওয়েস্ট মেট্রো প্রকল্পের কাজ, কেন?