Parted Crafts: এপার ওপার স্মৃতিময় একাকার

রিয়া পাত্র

'এপারে ওপারে ঢিল ছুঁড়ে ডাকাডাকি, ওদিকের গ্রামে রোদ্দুর কিছু বেশি'...এই গল্প শুনে বড় হয়েছেন বহু মানুষ, হবেন আরও অনেকে।

এক সময়ের সকালে যাঁরা একসঙ্গে রোদে বসেছিলেন, এখন তাঁরা দুই বাংলায়, মধ্যিখানে চর। তবু একজনের কথায় অন্যজনের চোখ চিকচিক করে। একজনের খোঁজ করে অন্যজনের পরবর্তী প্রজন্ম। এভাবেই এগিয়ে যায় গল্প, গল্প মেশে বাস্তবের মাটির উঠোনে। সেরকম কিছু গল্পের সম্ভার আইসিসিআর-এ। এমনিতেই শীতের শহরের আনাচে কানাচে ভরে থাকে চমক, কোনও গ্যালারির মাঝ বরাবর পড়ে থাকে লাল পাড়ের সাদা শাড়ি। থাকে শিকড়ের সন্ধান, সেই সন্ধানে এক পেশা থেকে অন্য নেশায় গিয়ে পৌঁছনো। আর এই সমস্তকিছু নিয়েই শীত শুরুর সন্ধেতে আইসিসিআর- এ চলছে এক প্রদর্শনী। পার্টেড  ক্রাফটস।  দেশভাগ, এক দেশ থেকে আলাদা হয়ে দুই দেশের হস্তশিল্প, কারুশিল্প, তার ওপর দেশভাগের প্রভাব, ৭৫ বছরে দাঁড়িয়ে দুই দেশ থেকে হাতড়ে তথ্য তুলে এনেছেন অর্চি ব্যানার্জি। ইউনিভার্সিটি অফ দ্য আর্টস, লন্ডন থেকে মেড ফেলোশিপ পেয়েছেন অর্চি, বিষয় ছিল ফ্যাশন ডিজাইন, সেখান থেকে শুরু কাজের। ফেলোশিপ পেয়েই অর্চি যোগসূত্র স্থাপন করেন দুই দেশের শিল্পের মধ্যে, খুঁজে বের করেন দেশভাগের ৭৫ বছরে কতটুকু মিলে আছে, আর বদলে গিয়েছে কতটা। ভারত বাংলাদেশ, দুই দেশে ছড়িয়ে থাকা ৬ গোষ্ঠীর ১০০ জন কারিগরের সঙ্গে কথা, দীর্ঘ গবেষণার ফল অর্চির এই প্রদর্শনী। আইসিসিআর কলকাতাতে এই প্রদর্শনী চলছে ২৫ নভেম্বর থেকে, দুপুর ৩ টে থেকে রাত্রি ৮ টা পর্যন্ত। এই প্রদর্শনী চলবে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত। 

প্রদর্শনী প্রসঙ্গেই কথা অর্চির সঙ্গে। ১৯৪৯-৫০-এ অর্চির পরিবার বরিশাল থেকে চলে আসে এপার বাংলায়। নদী পেরিয়ে ওপার থেকে এপারে এলেন যাঁরা, ফেলে এলেন জমি, দালান, গাঁয়ের লোক। তাঁদের কেউ এলেন এক কাপড়ে, কেউ নিয়ে এলেন বিয়েতে পাওয়া টিনের বাক্স, মায়ের বোনা ফুলতোলা কাঁথা আর আজলা ভরা স্মৃতি। অর্চি ছোট থেকে বড় হয়েছেন এপারে বসে ওপারের গল্প শুনে। ওপার থেকেই অর্চির পরিবারের মতোই এপারে এসেছিল আরও বহু পরিবার। নদীপথে পৃথক হয়েছিলেন যাঁরা, তাঁদের কেউ কেউ মিলে গেলেন কলকাতার রাজপথে। সেভাবেই একদিন অর্চির পরিবারের সঙ্গে দেখা হল ওপারে তাঁদের পুজোর প্রতিমা গড়তেন যিনি, সেই হীরালাল পালের। অর্চির কাছে ছিল বাড়ির প্রবীণদের মুখে শোনা ওপারের গল্প। অর্চি বড় হয়ে দেখলেন, আশেপাশে এরকম আরও অনেক মানুষ রয়েছেন, যাঁরা আনতে পারেন নি অনেক কিছু, শুধু ভেতরে নিয়ে এসেছেন তাঁদের কাজের গুণ। অর্চি জানান, তিনি প্রথম শিল্প, আর শিল্পের ওপর দেশভাগের প্রভাব উপলব্ধি করতে পারেন দুর্গা প্রতিমা দেখে। আদল, ঘরানা, নিজস্বতা, শিল্পে যে বিষয়গুলি থাকে, এবং দেশভাগের প্রভাবে বদলে গিয়েছে যা কিছু, একে একে সেসব খুঁজতে শুরু করেন তিনি।  ফ্যাশন ডিজাইন নিয়ে চেন্নাই থেকে পড়াশোনা করে লন্ডনে পাড়ি দেন অর্চি। সেখানের মেড ফেলোশিপ নিয়ে শুরু করেন কাজ, কাজ শুরু হয় শেকড় খোঁজার, পুরনো ভিটের সঙ্গে নতুন বসতবাড়ির মিল আর অমিল খোঁজার। আর খুঁজতে গিয়েই একে একে উঠে আসে নানা তথ্য। দুর্গা মুখ, শীতলপাটি, বেনারসি, শাঁখা, ঢাকাই, শোলার কাজ...সমস্তকিছু দু 'দেশেই হয়। অর্চি খুঁজতে শুরু করলেন পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের মৃৎশিল্পী, টাঙ্গাইলের তাঁত শিল্পী, বেনারসি বয়ন শিল্পী, শোলা কারিগর, শীতলপাটি তৈরির কারিগরিদের কাজ-কাহিনি, এই শিল্প এবং শিল্পীদের ওপর দেশভাগের প্রভাব। খুঁজে পেলেন, একই জিনিসের ওপর নতুন ভাবনার, নকশার দাগ। হাতের তৈরি থেকে শাঁখার ওপর মেশিনের দাগ, বেনারসির মোটিফ, ঢাকাই জামদানি আর টাঙ্গাইলের ঢাকাই একে একে দুই বাংলা ঘুরে জোগাড় করলেন তথ্য।  দুই দেশ জুড়ে খুঁজে বেড়িয়েছেন কী ছিল, আর কী আছে তার দলিল। মীরপুর থেকে শান্তিপুর, শাড়ির জমিতে জরির কাজ, ঢাকাইয়ের ছাপ খুঁজেছেন হন্যে হয়ে। সেসব কিছুকে একত্র করেই কিউরেট করেছেন, পার্টেড ক্রাফটস।

প্রদর্শনী জুড়ে হীরালাল পাল এবং তাঁদের মতো আরও অনেকেই যাঁরা ওপারে ফেলে এসেছেন অনেককিছু, শুধু নিয়ে এসেছেন শিল্পের রং, কর্মদক্ষতা, এবং যাঁরা রয়ে গিয়েছেন ওপারে, এখনও বুনে চলেছেন পুরনো সুর, তাঁদের কাজ আর কথা। এই নিয়ে অর্চি বুনেছেন তাঁর প্রদর্শনী। দেশভাগের ৭৫ বছরে শিল্পে তার প্রভাব, শিল্পীদের জীবনযাত্রা তুলে ধরেছেন তাঁর কাজে। প্রদর্শনীতে দর্শক অডিও ভিশ্যুয়াল মাধ্যমে দেখতে পাবেন কারুশিল্পীদের কাজ।

আকর্ষণীয় খবর