আজকালের প্রতিবেদন- অবশেষে বরফ গলল!
জুনিয়র ডাক্তারদের সব ‘ক্ষোভ–অভিমান’ নিমেষে শুষে নিলেন মাত্র দুটি বাক্যবন্ধনীতে— ‘লক্ষ্মী ছেলেরা আমার, কাজে যোগদান করো। মাথা ঠান্ডা করে সুন্দরভাবে কাজ করো...।’
মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি যখন এই মন্তব্য করছেন, তাঁর সামনে আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তাররা বসে। রয়েছেন রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষ আধিকারিকরাও। যে আন্দোলনে গত সাত দিন ধরে সরকারি হাসপাতালগুলিতে চলছিল অচলাবস্থা, রোগীদের দুর্ভোগ, সমস্যার সমাধানে সর্বোচ্চ পর্যায়ের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং। এদিন নবান্নে আয়োজিত সেই বৈঠকেই জুনিয়র ডাক্তারদের সামনে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী তখন— ‘ম্যাডাম’ এবং ‘অভিভাবক’। মমতার আন্তরিক আবেদন ও ‘লক্ষ্মী ছেলেরা’ শুনেই হাততালিতে ফেটে পড়লেন সেই আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তাররাই। মন জয় করলেন মমতা। যার রেশ ছড়িয়ে পড়ল গত কয়েকদিনের আন্দোলনের ‘আঁতুড়ঘর’ এনআরএস হাসপাতালেও। আর সেই সঙ্গে রাজ্য জুড়ে সরকারি হাসপাতালের জুনিয়র ডাক্তারদের কর্মবিরতি প্রত্যাহার হল।
নবান্নে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর ফিরে এসে এনআরএসে জিবি বৈঠক করেন জুনিয়র ডাক্তাররা। পরে রাতেই কর্মবিরতি তুলে নেন তাঁরা। তালা ভেঙে খুলে দেওয়া হয় হাসপাতালের গেট। মুখ্যমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে ডাক্তাররা জানান, দ্রুত কাজে ফিরবেন তাঁরা। পাশাপাশি তাঁদের পরামর্শ, রোগীর আত্মীয়দেরও সচেতন হতে হবে। কোনও পরিস্থিতিতেই ডাক্তারদের মারধর করা যায় না। সবার কাছে এই বার্তা পৌঁছতে হবে। প্রচুর মানুষ কষ্ট পেয়েছেন। তাঁদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী ডাক্তাররা।
এদিকে নবান্নে বৈঠকে ডাক্তারদের শুধু ‘মাথা ঠান্ডা’ করে কাজ করতেই বলেননি মমতা, তাঁর আরও মন্তব্য, ‘ডাক্তারদের মানুষ ভগবান ভাবে। বহু মানুষ চিকিৎসা না–পেয়ে সমস্যায় রয়েছে। তোমাদের দাবিটা যুক্তিসঙ্গত। গুরুত্ব দিয়ে আমরা দেখছি। সরকার সবরকম ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু তোমরা আগে আন্দোলন তুলে নাও, কাজে যোগ দাও।’ মুখ্যমন্ত্রীর আশ্বাস পেয়ে জুনিয়র ডাক্তারদের তরফেও বলা হয়, ‘ম্যাডাম, এই অচলাবস্থার এখানেই ইতি টানছি। কিন্তু আমাদের বৈঠকের নির্যাস হাতে পেলে ভাল হয়। আমরা ফিরে গিয়ে জানাব সবাইকে।’ মমতা তখন হাসতে হাসতে বলেন, ‘ঠিক আছে, সে–সব দিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু তোমরা এখানে বলে যাও, কাজে যোগ দিচ্ছো। পুরোটাই টিভিতে লাইভ দেখানো হচ্ছে। তোমরা যা চেয়েছিলে তাও করে দিয়েছি। এটুকু বললে বাংলার মানুষ আশ্বস্ত হয়। তোমাদের মানুষ ভালবাসে। ভালবাসারই লোক তোমরা। এখানে মিষ্টি করে কাজে যোগ দিচ্ছো বলো। আর ওখানে গিয়ে জোরালো করে বলবে।’
এনআরএস হাসপাতালে ডাক্তার নিগ্রহের জেরে আন্দোলনে নেমেছিলেন ‘ইন্টার্ন’রা। এক রোগী মৃত্যুর ঘটনার পর পরিবারের লোকজন তুমুল গন্ডগোল করে হাসপাতালে এসে। ডাঃ পরিবহ মুখার্জির খুলিতে ইটের আঘাত লাগে। গুরুতর জখম হয়ে তাঁকে ভর্তি করা হয় মল্লিকবাজারে নিউরো সায়েন্স হাসপাতালে। মমতা এদিন বৈঠকে জুনিয়র ডাক্তারদের সামনে বলেন, ‘তোমরা যা যা প্রস্তাব দিয়েছ, সবটাই আমি কার্যকর করব। আমার কাছে লুকোছাপার কিছু নেই। প্রশাসনিক বৈঠকও আমি সংবাদ মাধ্যমের সামনেই করি। তার কারণ, সবটাই খোলামেলা আলোচনা হওয়া উচিত। আমার ওপর রাগ করো, অভিমান করো, সরকারের বিরুদ্ধে গালি দাও, কিন্তু আমি চাইব কাজে যোগ দাও তোমরা। আমার ছোট্ট ভাইটি (পরিবহ) ভাল হয়ে উঠুক। ওর পরিবারের সঙ্গে কথা হয়েছে। এখন স্থিতিশীল আছে। যত তাড়াতাড়ি তোমরা কাজে যোগ দেবে, আমি তত দ্রুত ওর কাছে যাব। তোমরা কাজ করছ না বলে আমিও দেখতে যেতে পারছি না। এটা নিজের বিবেকের কাছে খুব লাগছে।’
প্রসঙ্গত, রবিবার রাত থেকেই সুর নরম করে আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তাররা। এর আগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিও আন্দোলন প্রত্যাহারের আবেদন জানিয়েছিলেন। অন্য বেশ কয়েকটি রাজ্যে ডাক্তারদের আন্দোলন ঠেকাতে অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা আইন অর্থাৎ ‘এসমা’ প্রয়োগ করা হয়েছে—সেকথাও মনে করিয়ে দেন মুখ্যমন্ত্রী। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ ছাড়াও জুনিয়র ডাক্তারদের ইন্টার্নশিপের মেয়াদ বৃদ্ধি করতেও আইন রয়েছে রাজ্যের হাতে বলে জানান মুখ্যমন্ত্রী। রাজ্যের স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিকর্তা প্রদীপ মিত্র নবান্নের তরফে বৈঠকে যোগদানের চিঠি দিয়ে আসেন আন্দোলনকারী ডাক্তারদের হাতে। যদিও সোমবার সকালে জিবি বৈঠকের পর জুনিয়র ডাক্তাররা দাবি তোলেন, ‘সবটাই লাইভ টিভি ক্যামেরার সামনে করতে হবে।’ মুখ্যমন্ত্রী রাজ্য প্রশাসনের তরফে সব দাবিই মেনে নেন। ফলত, নবান্নে বৈঠক শুরু হয় বিকেল ৪টে ১০ নাগাদ। তার আগে বাসে করে নবান্নে নিয়ে আসা হয় জুনিয়র ডাক্তারদের পক্ষে ৩১ জন প্রতিনিধিকে। বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ২ জন করে প্রতিনিধিকে আসতে বলা হয়। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে এই বৈঠকে ছিলেন স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য, মুখ্যসচিব মলয় দে, স্বরাষ্ট্র সচিব আলাপন ব্যানার্জি, অতিরিক্ত মুখ্যসচিব (স্বাস্থ্য দপ্তর) রাজীব সিনহা ও স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিকর্তা প্রদীপ মিত্র। ছাড়াও ডিজি বীরেন্দ্র, নগরপাল অনুজ শর্মা, নিরাপত্তা উপদেষ্টা সুরজিৎ করপুরকায়স্থ প্রমুখ। ছিলেন ডাঃ সুকুমার মুখার্জি এবং ডাঃ অভিজিৎ চৌধুরিও। টানা দেড় ঘণ্টারও বেশি বৈঠক চলে নবান্নে।
শুরুতেই মেডিক্যাল কলেজের জুনিয়র ডাক্তার অর্চিষ্মান ভট্টাচার্য মুখ্যমন্ত্রীকে জানান, আতঙ্কে কাজ করতে হয় তাঁদের। ডাক্তারদের মারধর স্পর্ধায় পরিণত হয়েছে। আমরা দ্রুত কাজে ফিরতে চাই। কিন্তু আপনি এমন একটি বার্তা পৌঁছে দিন, যাতে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পায় অপরাধী। অর্চিষ্মান বলেন, ‘আপনার প্রতি পূর্ণ আস্থা আছে আমাদের। সদিচ্ছা আছে আমরা বুঝি। যা হয়েছে কড়া ব্যবস্থা কতটা নেওয়া যায় তা দেখতে অনুরোধ করছি।’ মুখ্যমন্ত্রীও সহমত জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে। জুনিয়র ডাক্তাররা এদিন ১২ দফা প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলেন বৈঠকে। এরমধ্যে পুলিশি নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। জুনিয়র ডাক্তারদের অনেকেই অভিযোগ করেন, পেশাদার পরিকাঠামোর অভাবেই চিকিৎসা পরিষেবা ঠিকমতো দেওয়া যাচ্ছে না। পুলিশকে জানিয়েও অনেক সময় লাভ হয় না। সরকারের উচিত এইসব বিষয়গুলি গুরুত্ব সহকারে দেখা। সব শুনে মমতা বলেন, ‘আমি তো বহুবার ঘটনার নিন্দা করেছি, দুর্ভাগ্যজনক। আমি চন্দ্রিমাকে পাঠিয়েছিলাম তোমাদের সঙ্গে কথা বলতে। তোমরা কথা বললে না। আমি ভাবলাম আমাকে চাইছ না। তারপর রাজীব সিনহা, অনুজ শর্মা, ডিএম গিয়েছিলেন কথা বলতে। সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি।’ হাসপাতালের পরিকাঠামোর প্রসঙ্গ আসায় মমতা বলেন, ‘৩৪ বছর পর যখন আমরা ক্ষমতায় এলাম, তারপর থেকে হাসপাতালের উন্নয়নে অনেক কিছু কাজ হয়েছে। আগে বাজেট ছিল ৬৯০ কোটি টাকা, এখন তা বেড়ে ৯,৬০০ কোটি টাকা হয়েছে।’ পরিকাঠামোর উন্নতি হলেও ডাক্তারদের অভাব রয়েছে বলে এদিনও মন্তব্য করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর কথায়, ‘চেয়েছিলাম ৮০০০ ডাক্তার, পেয়েছি ২০০ জন। তাই বলব, বাংলা ছেড়ে তোমরা যেও না।’
হাসপাতালে ভাঙচুর এবং ডাক্তারদের ওপর নিগ্রহের বিরুদ্ধে আরও বেশি জনসচেতনার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন মমতা। তিনি বলেছেন, ‘কোনও সরকারই দুর্ঘটনা চায় না। সম্পত্তি নষ্টে আইন করেছি। সামাজিক জাগরণের আরও প্রয়োজন আছে। পুলিশকেও আরও কড়া হতে হবে।’ জুনিয়র ডাক্তারদের অভিযোগ, হাসপাতালে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ হয়। এটাও একটি গুরুতর সমস্যা। মমতা বলেন, ‘ঠিকই, এটা জেনুইন সমস্যা। সার্কুলার দিয়ে এটা বন্ধ করা হবে। একটা সিস্টেমে আসতে হবে সবাইকে।’
মুখ্যমন্ত্রী এদিন জানিয়েছেন, হাসপাতালগুলিতে ডাক্তারদের সুরক্ষায় এমার্জেন্সির সামনে কোলাপসিবল গেট লাগানো হবে। রোগীর সঙ্গে পরিজনদের প্রবেশ নিয়েও বিধিনিষেধ থাকবে। দুজনের বেশি ঢুকতে দেওয়া হবে না। গ্রিভান্স সেলকে আরও সক্রিয় করা হবে। রোগী কল্যাণ সমিতিতেও জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতিনিধি রাখা হবে। প্রত্যেক হাসপাতালে ৩ শিফটে একজন নোডাল পুলিশ অফিসার ও জনসংযোগ অফিসার থাকবেন। যাঁরা রোগীর পরিজনদের সঙ্গে সমস্যা হলে কথা বলবেন। এছাড়া ডেন্টাল হাসপাতালেও অ্যাম্বুলেন্স ও অন্যান্য পরিকাঠামোতেও গুরুত্ব দিচ্ছে রাজ্য সরকার।
দরদি প্রশাসক। নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। ছবি: আজকাল