আজকালের প্রতিবেদন- বিরোধী যুক্তিকে সামাজিক মূল্য দিতে হবে। এমনটাই মনে করেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। তাঁর অভিমত, বিরোধী যুক্তিকে হিংসা হিসেবে দেখলে হবে না। তঁার কথায়, ‘যে–বিষয়ে প্রতিবাদ করছি, তা ভালভাবে জানার প্রয়োজন আছে। প্রতিবাদের বিষয় তখনই ঠিক হবে, যখন কী নিয়ে বিরোধ করছি তা জানা থাকবে। প্রতিবাদ মনে আসবে না, এটা বলা যায় না। একদিকে যে–রকম বিরোধিতা ও পরিবর্তনের প্রচেষ্টা, তার সঙ্গে হৃদয় ও মাথার যোগ থাকা দরকার। কী ভুল হয়েছে, কেন আমরা চিন্তিত, তা জানা দরকার।’ বলেছেন, ‘যখন মনে হয় বড় রকম ভুল হচ্ছে অথবা সংবিধান, মানবাধিকার–বিরোধী কাজ হচ্ছে, তখন লোকের মনে দুশ্চিন্তা হয়। প্রতিবাদের নানা কারণও সেখানেই আছে।’
সোমবার নবনীতা দেবসেন প্রথম স্মারক বক্তৃতায় এক প্রশ্নের উত্তরে এ কথা বললেন অমর্ত্য সেন। রবীন্দ্র সদনে অমর্ত্যর এদিনের আলোচনার বিষয় ছিল: বিরোধী যুক্তি। নবনীতা দেবসেন তঁার গবেষণা, লেখালিখি ইত্যাদিতে যে বিরোধী যুক্তির অবতারণা করতেন, অমর্ত্য তারই এক সামগ্রিক পরিচয় দিলেন। প্রধান অতিথি ছিলেন শঙ্খ ঘোষ, সভাপতি অধ্যাপক পার্থ চট্টোপাধ্যায়। অমর্ত্য সেন বলেন, ‘নবনীতার লেখায় রবীন্দ্রনাথের প্রভাব ছিল এবং মৌখিক মহাকাব্য সম্পর্কে গভীর উৎসাহ ছিল তঁার। অ্যালবার্ট লর্ড এবং গিলম্যান পারি এ বিষয়ে কাজ করেছেন। এ ধরনের কাজ ভারতীয় মহাকাব্য নিয়ে আগে কেউ করেননি। তিনি সীতায়ন শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন। বাল্মীকি রামায়ণের মধ্যে ন্যায় ও ন্যায্যতার যে–কাঠামোয় মেয়েদের দেখানো হয়েছে, নবনীতার বিশ্লেষণে সেক্ষেত্রে বিরোধী যুক্তি ও প্রাসঙ্গিকতা উঠে এসেছে। ভারতীয় সংস্কৃতিতে বাল্মীকি রামায়ণের ব্যাপকতা উপেক্ষা করা অসম্ভব। কিন্তু সামাজিক মূল্য দেওয়ার ক্ষেত্রে তা নিয়ে অনেক কথাই বলা যায়। পুরুষ–প্রধান দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়ে এবং ন্যায্যতা প্রসঙ্গে বাল্মীকি রামায়ণে পক্ষপাতিত্বের বিষয় রয়েছে।’ অমর্ত্য সেন বলেছেন, ‘উইলফ্রেড ওয়েন যুদ্ধে গিয়েছিলেন। তিনি যখন মারা যান, তখন তঁার পকেটে একটি কবিতা পাওয়া গিয়েছিল। পাশে লেখা ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ওয়েনের মা রবীন্দ্রনাথকে লেখা চিঠিতে সে–কথা জানিয়েছিলেন।’ এদিনের ভাষণে বাল্মীকি রামায়ণ, মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাদবধ কাব্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে নবনীতা দেবসেন সেখানকার চরিত্রগুলিকে যে–দৃষ্টিতে দেখেছিলেন, তার ব্যাখ্যা দেন অধ্যাপক সেন। তিনি জানান, দেশের লেখা অন্য দেশে পরিবেশন করা নিয়ে কৌতূহল ছিল নবনীতার। এদিন নবনীতা দেবসেনের রচনাবলি দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত হল।
রসিক অমর্ত্য
রসিক অমর্ত্য সেন। সোমবার এক অনুষ্ঠানে বললেন, ‘আমেরিকায় অনেকেই ভাবে, ইংরেজিতে নামের শেষে ‘ওয়াইএ’ থাকলে তিনি নারী। আমার নামও ‘ওয়াইএ’ দিয়ে শেষ হচ্ছে। তাই অনেক মহিলাই চিঠি লিখতেন ড. মিস সেন বলে। আমরা এক সময় ফেমিনিস্ট ইকনমিক্স নিয়ে কাজ করেছি। অনেক লেখাও ছাপা হয়েছে। সেই সূত্রেই আমেরিকান ইকনমিক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হই। একদিন চিঠি এসেছিল, লেখা ছিল ‘ড. মিস সেন, দে উইল নেভার আন্ডারস্ট্যান্ড আস’। পত্রলেখিকা ভেবেছিলেন, আমি হয়ত নারী!’ অমর্ত্য বলেন, ‘হ্যঁা, নিজেকে নারীবাদী বলি। যে বঞ্চনা দেখি, তার মধ্যে দিয়েই অন্যান্য সমস্যা দেখতে পাই। তাই একজন নারীর হয়ে বলার চেষ্টা করেছি। নারীদের বঞ্চনার কথাগুলি ভেবে দেখলে, বঞ্চনার স্বরূপ বোঝার সুযোগ আছে।’
নবনীতা দেবসেন স্মারক বক্তৃতায় অমর্ত্য সেন। রয়েছেন শঙ্খ ঘোষ ও পার্থ চট্টোপাধ্যায়। রবীন্দ্রসদনে, সোমবার। ছবি: বিজয় সেনগুপ্ত