সম্রাট মুখোপাধ্যায়: আশিস বর্মনের গল্প থেকে ‘ইন্টারভিউ’ ছবি করার কথা মৃণাল সেন ভাবেন ১৯৫৫ সালেই। তাঁর প্রথম ছবি ‘রাতভোর’ করার পরেই। নানা কারণে সে ছবি করা হয়নি।
এর বছর পনেরো পরের কথা। ১৯৬৯–এ ‘ভুবন সোম’ করার পরে তখন দেশজোড়া খ্যাতি। প্রযোজক মহলেও ঘুরছে আবার মৃণাল সেনের নাম। কারণ তিনি কম পয়সায় কম সময়ে ছবি করেন এটা সবাই জেনে গেছে।
এমনই সময় একদিন এক অবাঙালি ভদ্রলোক, দুটি কোলিয়ারির মালিক, নাম দয়ালশঙ্কর সুলতানিয়া এসে হাজির মৃণালবাবুর কাছে। ইচ্ছা তাঁর ছবি প্রযোজনা করবেন। শুনতে চাইলেন মৃণালবাবুর আগামী পরিকল্পনার কথা। এর মধ্যে মু্ম্বই থেকেও দু’জন প্রযোজক এসে ঘুরে গেছে মৃণালবাবুর কাছ থেকে। তাঁদের দাবি ছিল ‘ভুবন সোম’–এর মতো হিন্দি ছবি করতে হবে। এবং তা ‘মিষ্টি’ কোনও গল্প থেকে।
এদিকে সময়টা ১৯৭০। সমস্ত পৃথিবী উত্তাল। দেশে নকশালবাড়ির আগুন জ্বলছে। প্যারিসে দু’বছর আগের ছাত্র বিক্ষোভের জেরে দুনিয়া জুড়ে তারুণ্যের জোয়ার। কান চলচ্চিত্র উৎসবে নিজের ছবি ‘স্ক্রিনিং’–এর সময় আসন ছেড়ে দাঁড়িয়ে গোদার মাও–এর নামে স্লোগান দিয়েছেন। মৃণাল সেনের অন্যতম আকর্ষণভূমি ল্যাটিন আমেরিকার বন্ধু ফার্নিনান্দ সোলানাস বানিয়েছেন ‘দ্য আওয়ার অফ দ্য ফার্নেস’ (যার ‘কাট’ পরে মৃণাল সেন ব্যবহার করবেন ‘পদাতিক’ ছবিতে। যে ছবিতে বলা হয়েছে, ‘আমরা যুদ্ধের চাইতে শান্তিকে বেশি ভয় পাই।’
প্রযোজকের টাকার থলি
এর মধ্যে সুলতানিয়া ভদ্রলোকের নাটকীয় প্রবেশ। অসমাপ্ত চিত্রনাট্যের অংশবিশেষ শোনালেন মৃণাল। বলা বাহুল্য, শেষটা চেপে রেখে। নাটকীয়তার ঘটনাটা ঘটল এর পরে। হবু প্রযোজক বললেন, ‘এ ছবির পুরো টাকাটাই আমি দেব।’ এবং হাতের ব্যাগ থেকে নগদ দেড় লাখ টাকা বের করে তুলে দিলেন সামনে বসে থাকা বিমূঢ় মৃণালবাবুর হাতে! জানালেন, তিনি রাজস্থান যাচ্ছেন। এক হপ্তা পরে ফিরে এসে কাগজপত্রে চুক্তি সারবেন। বলে চলে গেলেন।
এবার মৃণালবাবু তো পড়লেন ফাঁপরে। এতগুলো টাকা! নগদে! কোনও রসিদে সই করালেন না ভদ্রলোক! ছবির জন্য আর কত টাকা লাগবে, তাও জানতে চাইলেন না! হতবাক মৃণালবাবু শুধু রান্নাঘর থেকে গীতা সেনকে ডেকে তাঁর হাতে টাকার বান্ডিলগুলো দিলেন। বললেন তুলে রাখতে। তিনিও শুনে অবাক! এ আবার কী সমস্যা! কিছু না বুঝে টাকায় হাতও দেওয়া যাবে না!
যাই হোক, দু’জনেরই দুশ্চিন্তা কাটিয়ে যথাসময়ে দয়াশঙ্কর সুলতানিয়া ফিরে এলেন। ছবির জন্য প্রয়োজনীয় বাকি টাকাও দিলেন। আর জানালেন, তিনি ছবির প্রযোজক হবেন না। প্রযোজনা স্বত্ব থাকুক ‘মৃণাল সেন প্রোডাকসন্স’–এর হাতে। তিনি পরিবেশক হয়েই খুশি।
কলকাতা জুড়ে সেবার প্রচণ্ড গরম। তবু পাগলের মতো দৌড়ঝাঁপ আর দ্রুততায় কাজ শুরু হল। দুই থেকে আড়াই মাসে ছবি শেষ। খরচও হল ওই দুই থেকে আড়াই লাখের ভেতরেই। মৃণাল সেন আবার দেখালেন কত কম বাজেটে বুদ্ধি করে আউটডোর ছবি বানাতে পারেন তিনি। এবং ছবি বাণিজ্য–সফলও হল। সুলতানিয়া তাঁর টাকা কিছু অতিরিক্ত সমেত ফেরত পেলেন।
বছরের শেষ দিকে ১৯৭০–এর ১৩ নভেম্বরে মুক্তি পেল ‘ইন্টারভিউ’। গ্লোব, রাধা আর পূর্ণতে। তবে এ ছবি শুরুর দিকে ততটা ভাল করেনি। আসলে একেবারে নতুন আঙ্গিকে বানানো। ‘ফ্রিজ শট আর শার্প কাট’–এ ভর্তি এ ছবির সম্পাদনা। সঙ্গে নানারকম পরীক্ষামূলক ‘ট্রিটমেন্ট’। যেমন নায়ক (রঞ্জিত মল্লিক) এসপ্ল্যানেড থেকে ট্যাক্সি ধরছেন ভবানীপুর যাবেন বলে, আর তাঁর বন্ধু সেই ট্যাক্সিতেই উঠতে চাইছেন উত্তর কলকাতার মানিকতলায় নামবেন বলে। স্থানিক বাস্তবতাকে পর্দার বাস্তবতা দিয়ে আক্রমণ করার উদ্দেশ্যেই মৃণালবাবুর ইচ্ছাকৃত এই দৃশ্যের অবতারণা। একটি ফোন–দৃশ্যে সাউন্ডট্র্যাক আর ভিস্যুয়াল উপস্থাপনার আলাদা হয়ে যাওয়া। স্বাভাবিকভাবেই এ ছবির সঙ্গে ধাতস্ত হতে একটু সময় লেগেছিল দর্শকের। তাও শহরে তিন সপ্তাহ দর্শক ধরে রাখতে সমস্যা হয়নি এ ছবির।
এরপর পাড়ি দিল চেকোস্লোভাকিয়ার দুনিয়াখ্যাত চলচ্চিত্র উৎসব ‘কার্লোভি–ভ্যারি’তে। সেখানে এ ছবির সূত্রে রঞ্জিত মল্লিক তাঁর অভিনয় জীবনের প্রথম ছবিতেই পেলেন সেরা অভিনেতার সম্মান। পরে শ্রীলঙ্কার চলচ্চিত্র উৎসবে এ ছবি সেরা ছবির সম্মান পেল।
এরই মাঝে কলকাতায় এ ছবি রি–রিলিজ করেছে। মেট্রো সিনেমায়। এবং ছবির শেষে মুহুর্মুহু স্লোগান উঠেছে ‘মৃণাল সেন যুগ যুগ জিও’। ছবি ব্যবসা দিল ভালই। দয়াশঙ্করবাবুই পরের ছবি ‘কলকাতা ৭১’–এর প্রযোজক হলেন। এরই মাঝে তৃতীয় সপ্তাহে গ্লোবে একদিন ছবিটি দেখতে গেছেন মৃণালবাবু। ছবি শেষের পরে এক মহিলা দর্শক ক্ষ্যাপানোর ঢঙে বলে উঠল ‘এ ছবি কি গুন্ডা–বদমায়েশ, ক্রিমিনালদের ছবি নয়? কী বলেন সবাই?’ সেদিন ভাগ্যিস কেউ এ কথার উত্তর দেননি!
টেলিফোনে বুলবুল
যাই হোক, মৃণালবাবুর অগ্রিম টাকা নিয়ে সঙ্কট তো কাটল। কিন্তু ছবির পরে গীতা সেন জড়িয়ে পড়লেন আর এক বিপদে! এই ‘রিয়েল’–এর বিপদে।
ছবির সব কিছুই ‘রিয়েল’, স্থান–কাল–পাত্র। ঘটনা ঘটেছে মাত্র একটি দিনে। সাকিন কলকাতার চেনা পথঘাট এবং ট্রাম। পাত্র–পাত্রীরা সবাই নিজের নিজের নামেই চরিত্র হয়ে উঠেছে। নায়ক রঞ্জিত (রঞ্জিত মল্লিক), নায়িকা বুলবুল (বুলবুল মুখার্জি), চরিত্রাভিনেতা শেখরকাকু (শেখর চট্টোপাধ্যায়)। নায়কের মা হয়েছিলেন করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি শুরু হয় এক চলমান ট্রামের দৃশ্যে, যেখানে দেখা যায় নায়ক রঞ্জিত মল্লিককে। আর দেখা যায়, দাঁড়ানো রঞ্জিতের পাশেই বসে ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাচ্ছে এক যুবতী। যে ম্যাগাজিনেও রঞ্জিতের মুখ। এবং সঙ্গে হেডলাইন— ‘মৃণাল সেনের নতুন আবিষ্কার রঞ্জিত মল্লিক’। বোঝা যায়, গোদারীয় বা ব্রেখটীয় পদ্ধতিতে মৃণাল সেন এমন এক সুড়ঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন দর্শককে, যেখানে সিনেমা–বাস্তব আর বাইরের–বাস্তব অনবরত জায়গা বদল করছে। ছবির ক্যামেরাম্যানকে দেখা যায় ছবির চিত্রগ্রহণ করতে। ছবির এক জায়গায় নায়িকা বুলবুল নিজের নম্বর বলে যে ফোন নম্বরটি বলে, সেটি মৃণালবাবুর নিজের নম্বর। ছবি বেরোনোর পর বুলবুল–সন্ধানী কতজনের ফোন যে ধরতে হয়েছে গীতা সেনকে!
এ সব বাদ দিলে বিষয়, গল্পের দিক থেকে কিন্তু এ ছবি ভীষণ সহজ–সরল। বলা উচিত এ ছবি যেন চার্লি চ্যাপলিনের আত্মাকে বহন করছে। যে চ্যাপলিন মৃণাল সেনের আজীবনের প্রিয়। এক নিম্ন–মধ্যবিত্ত যুবক, যাকে আমরা ছবি জুড়ে শহরের পথে পথে ‘ভ্যাগাবন্ড’–এর মতো ঘুরে বেড়াতে দেখি, যার সমস্যাটি বৃহত্তর বিচারে আপাত–ক্ষুদ্র। অথচ তার দিক থেকে ভাবলে অস্তিত্বের সংগ্রাম। তার একটি কোট দরকার। পরের দিনের ইন্টারভিউ বোর্ডে চাকরির পরীক্ষায় পরে যাওয়ার জন্য। সে তার নিজের কোটটি পায় না লন্ড্রিতে স্ট্রাইক হওয়ার ফলে। বন্ধুর থেকে ধার নেওয়া কোটটি হারিয়ে ফেলে বাসে, পকেটমারকে ধাওয়া করতে গিয়ে (সিকোয়েন্সগুলোর সঙ্গে চ্যাপলিনিস্ক ঢঙের মিলগুলো ভাবুন)। এবং শেষমেশ ধুতি–পাঞ্জাবিতে সেজে বিদেশি কোম্পানিতে যায় ‘ইন্টারভিউ’ দিতে। বলাই বাহুল্য, তার চাকরিটি হয় না।
ছবির শেষে কিন্তু চ্যাপলেনীয় ঢঙে নয়। দেখা যায় এক বস্ত্রবিপণিতে বিদেশি পোশাক পরিহিত এক ম্যানিকুইনকে। ওই বিপণির কাচে ঢিল ছোঁড়ে রঞ্জিত। ওই ম্যানিকুইনকে নগ্ন করে। যৌবনের বজ্রনির্ঘোষের প্রতিনিধি হয়ে ওঠে সে যেন। এ যেন চ্যাপলিনের গল্পকে গোদারের ভাষায় বলা। আর শেষমেশ তাকে পৌঁছে দেওয়া হয় ল্যাটিন আমেরিকান গেরিলা সিনেমার ক্রোধে। শুরু হয়েছিল ‘কলকাতা ত্রয়ী’। এ ছবির পরে ‘কলকাতা ৭১’ (১৯৭১) এবং ‘পদাতিক’ (১৯৭২)। মজার কথা, ‘কলকাতা ৭১’ শুরু হত এক বিচার দৃশ্য দিয়ে, যেখানে আদালতে কাঠগড়ায় তোলা হয়েছে রঞ্জিতকে বস্ত্রবিপণিতে হামলা চালানোর জন্য।
বদলে গেল উত্তর
রঞ্জিত মল্লিক তখন ইউনিভার্সিটির ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। ভবানীপুরে নিজেদের যৌথ পরিবারের পুজোয় থিয়েটার করেন। অভিনয়ের অভিজ্ঞতা বলতে এটুকুই। শুনেছিলেন ভবানীপুরেই মৃণাল সেন সিনেমা করছেন যুবকদের সমস্যা নিয়ে। সাহসে ভর করে দেখা করতে গেলেন। ‘অভিনয়ের অভিজ্ঞতা আছে’— এ প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘শুনলাম আপনি যুবকদের সমস্যা নিয়ে ছবি করছেন। তাই আপনার কাছে এলাম, যদি একটা সুযোগ দেন, কারণ ওই সমস্যাটা আমি জানি, আর কিছু জানি না।’
স্ক্রিন টেস্টে সেদিন গেলেন মৃণালবাবু শুধু অভিব্যক্তি দেখাতে বললেন, ‘খিল খিল করে হাসো, ভীষণ রেগে যাও, বিরক্ত হও, অবাক হও, গম্ভীর হয়ে দু’পাশে তাকাও’। মাসখানেক পরে ডাক পেয়ে যেদিন শুটিংয়ে গেলেন, কোনও স্ক্রিপ্ট বা ডায়াগল পেলেন না। মৃণালবাবু বললেন, ‘ডায়ালগ আবার কী! তুমি থানায় অফিসারের প্রশ্নের জবাবে যা মনে আসবে বলবে। শুধু মনে রেখো, দুপুর তিনটের সময় ইন্টারভিউ। ওখানে কথা বলতে সময় নিলে তুমি তা মিস করবে।’ মজার কথা, ওই দৃশ্যের শুটিং হঠাৎ করেই ঠিক করা হয়েছিল দক্ষিণ কলকাতার এক থানায়। আর সেখানে ডিউটিরত দুই অফিসারের একজন হয়েছিলেন পকেটমার (যিনি এই ধরনের চোর ধরায় বেশ ‘ওস্তাদ’ বলে জানিয়েছিলেন)। আর অন্যজন হয়েছিলেন পুলিশ অফিসার। একই ঘটনা ঘটে ইন্টারভিউয়ের দৃশ্যে। সত্যি সত্যিই এক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির বোর্ডরুম আর তার কর্তাব্যক্তিদের ব্যবহার করেছিলেন মৃণালবাবু ওই দৃশ্যে। কোম্পানির এক কর্তা ছবি দেখে মৃণালবাবুকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ছোকরা কি কোনও ‘মিলিট্যান্ট’ গ্রুপের সদস্য?
ওই দৃশ্যের শুটিং চলছে। ফ্লোরে আছেন নিমাই ঘোষ। সত্যজিৎবাবুর স্থিরচিত্রগ্রাহক। শুটিং দেখে মৃণালবাবুকে আড়ালে ডাকলেন। ডেকে বললেন, ‘মানিকবাবুর ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’তেও এরকমই একটা দৃশ্য আছে শেষ দিকে। প্রসঙ্গত, সত্যজিৎ রায়ও তখন তাঁর ‘কলকাতা ত্রয়ী’র প্রথম ছবি ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’র শুটিং করছেন। এরপরই নিমাইবাবু ফাঁস করে দিলেন, ওই ইন্টারভিউ বোর্ডে তিনি কী কী প্রশ্ন শুনেছেন। দেখা গেল একটি প্রশ্ন একেবারে কাছাকাছি হয়ে গেছে!
সত্যজিতের ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ তে ইন্টারভিউয়ে সিদ্ধার্থকে (ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়) প্রশ্ন করা হচ্ছে, ‘এই দশকের সবচেয়ে বড় ঘটনা কী?’ উত্তর আসছে, ‘ভিয়েতনামের যুদ্ধ’। আর মৃণালবাবুর ছবিতে রঞ্জিতকে জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে, ‘আজকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা কী? মৃণালবাবুর উত্তরটা ঠিক করে দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমার ইন্টারভিউ স্যর’।
নিজের বাড়িতে মৃণাল সেন। ছবি : সুপ্রিয় নাগ