সম্রাট মুখোপাধ্যায়: হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের থেকে ঘটনাটা কি শুনেছিলেন উত্তমকুমার? বা ‘দেয়া নেয়া’র পরিচালক সুনীল বন্দ্যোপাধ্যায়? নাকি মিলটা ছিল নিছকই কাকতালীয়?
‘দেয়া নেয়া’ ছবিতে লোহার ব্যবসায়ী বাবা কমল মিত্রের পছন্দ নয় ছেলে উত্তমকুমার গান করে বা গানকেই জীবিকা হিসেবে নেয়। রূপালি পর্দার বাইরে একই ঘটনা ঘটেছিল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জীবনে। হেমন্তর বাবা কালিদাস মুখোপাধ্যায় ভাবতেন ছেলে গানবাজনা করলে ‘বখে’ যাবে। ১৪ বছর বয়েসে রেডিওতে প্রথম গান গাওয়ার সুযোগ পান হেমন্ত। বাবা তো শুনে রেগে কাঁই! পড়াশোনা ফেলে এসব কী! শেষমেশ মা কিরণবালা দেবী ‘ম্যানেজ’ করলেন। বাবার জন্য বাড়িতে পরিস্থিতি এতটাই সিরিয়াস ছিল যে, মাকে ছেলের রেডিওতে গাওয়া প্রথম গানটা শুনতে হয়েছিল অন্যের বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে।
রেডিওর একথা শুনে অনেক পাঠকের মনে জেগে উঠতে পারে ‘শাপমোচন’–এ পিতৃপ্রতিম দাদাকে লুকিয়ে উত্তমের গান গাওয়ার কাহিনীও। মজার কথা, এই ‘শাপমোচন’ দিয়েই কিন্তু উত্তম–হেমন্ত জুটির জনপ্রিয়তার শুরু। সঙ্গীত গবেষক সুশান্তকুমার চট্টোপাধ্যায়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী উত্তমকুমারের লিপে হেমন্ত প্রথম গান গেয়েছিলেন ‘সহযাত্রী’ ছবিতে। ১৯৫১ সালে। কিন্তু ওই ছবি যখন হয়, তখন তো উত্তম মহানায়ক উত্তম হননি। ফলে, এ তথ্য কেউ মনেও রাখেনি। ছবিটিও নষ্ট হয়ে যাওয়ায় এ তথ্য মিলিয়ে নেওয়ার সুযোগ নেই।
কিন্তু এটা নিশ্চিতই, উত্তম–হেমন্ত ‘দৈব’ জুটির জনপ্রিয় সূচনা ও প্রতিষ্ঠা একই ছবিতে। সুধীর মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘শাপমোচন’–এ। ১৯৫৫–য়। ‘বসে আছি পথ চেয়ে’, ‘শোনো বন্ধু শোনো’, ‘সুরের আকাশে তুমি যে গো শুকতরা’, ‘ঝড় উঠেছে বাউল বাতাস’— হেমন্ত কণ্ঠে চারটি গান। চারটিই সুপারহিট। সবচেয়ে বড় কথা, এ ছবির সঙ্গীত পরিচালনাও ছিল স্বয়ং হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের।
‘দেয়া নেয়া’র শেষ দৃশ্যে সজল চোখে ছেলের ‘গানে ভূবন ভরিয়ে দেবে’ শুনেছিলেন কমল মিত্র। আর হেমন্তর বাবাও মেনে নিয়েছিলেন ছেলের গান গাওয়া। যখন যুবক হেমন্তর কেরিয়ার থমকে, সে সময় কালিদাসবাবুই রেডিও স্টেশনে আবার খোঁজ করে বের করেছিলেন এক পরিচিতকে। ছেলেকে পাঠিয়েছিলেন সেখানে।
‘শাপমোচন’ ঘটেছিল হেমন্তর কেরিয়ারের। উত্তম–হেমন্ত দুই বন্ধুর পর্দার জীবন পর্দার বাইরের জীবন সব যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে।
বোম্বে, বর্ষায়
‘শাপমোচন’–এর সুর করার কথা হেমন্তর ছিল না। ছিল শচীন দেববর্মণের। শচীনকর্তাকে সে কাজে রাজি করাতে পরিচালক সুধীরবাবু বোম্বে যান। ডিস্ট্রিবিউটরদের চাপেই তাঁর এই সিদ্ধান্ত। কিন্তু ব্যস্ততার কারণে শচীনবাবু রাজি হলেন না। হেমন্ত তখন বোম্বেতেই। সুধীরবাবু সঙ্গীত পরিচালক খুঁজছেন শুনে দেখা করতে এলেন ‘সি গ্রিন’ হোটেলে। প্রবল জলঝড় তখন বাইরে। সেদিনই পাকা কথা দেনননি সুধীরবাবু। দিলেন পরদিন। বাকিটা তো ইতিহাস। প্রযোজনা ব্যয়ের পাঁচগুণ টাকা তুলেছিল এ ছবি বক্স অফিসে। এ ছবির গান রেকর্ডিং কিন্তু বোম্বেতে বসে করেননি হেমন্ত। কলকাতায় আসতেন তখন টেকনিশিয়ান স্টুডিওতে এ কাজ করতে।
১৯৫৬ সালে এ ছবির জন্য তৎকালীন ‘সিনে অ্যাডভান্স’ পুরস্কারটি পান হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। আর ওই অনুষ্ঠানেই তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে পুরস্কার নেন আরেক দীর্ঘকায় বাঙালি। সত্যজিৎ রায়। ‘পথের পাঁচালী’র জন্য। তবে উত্তম–হেমন্ত জুটির আরও বড় সাফল্য এল ১৯৫৭–তে।
সে এক বছর!
১৯৫৭–য় ‘পৃথিবী আমারে চায়’–এর নীলামবালা ছ’ আনা’ জনপ্রিয়তার রেকর্ড ভেঙে দিল। হেমন্ত–জায়া বেলা মুখোপাধ্যায় একবার লিখেছিলেন, ‘সে সময় বাচ্চা–বুড়ো সকলে আমার কর্তার এ গানটা গেয়ে বেড়াত।’ ওই বছরই ‘চন্দ্রনাথ’–এ হেমন্তর গান ছিল। ‘ওই রাজার দুলালি সীতা’ প্রযোজনা ব্যয়ের ৭০০ শতাংশ টাকা লাভ করে এ ছবির উত্তম–সুচিত্রা জুটির সবচেয়ে বড় হিট হয়। ‘শাপমোচন’–এর পরে আবার এক বার বিমলচন্দ্র ঘোষের কথায় সুর বসয়ে ম্যাজিক দেখালেন হেমন্ত ‘তাসের ঘর’ ছবিতে। ‘শূন্য ডানা মেলে’ গানে ব্যারিটোনে ঢলে পড়ল যেন স্বর্গীয় বিষাদ!
তবে এই বছরে সব ছাপিয়ে গেল হেমন্ত সুরারোপিত ‘হারানো সুর’। দুটি মাত্র গান। ‘তুমি যে আমার’ আর ‘আজ দুজনার দুটি পথ ওগো’। দুটিই ইতিহাসের গ্যালারিতে চলে গেল। দ্বিতীয় গানটি হেমন্ত গাইলেও উত্তমের লিপে নয়। রেডিওতে বাজছে। দর্শকরা হতাশ। উষ্মা তাদের মনে। তখন সামনে এল এক তথ্য। একটি দৃশ্যে পর্দায় উত্তম সুচিত্রাকে ডাকছে ‘রমা রমা’ বলে। ডাবিংয়ে উত্তম ছিলেন না। ডাকটা ডেকেছেন হেমন্ত। আবার এই বছরই হেমন্ত একটা অদ্ভূত কাণ্ডও করেছিলেন। ‘জীবনতৃষ্ণা’ ছবিতে নিজের জন্য তুলে রাখা গান ‘সাগর সঙ্গমে’ গাইতে দিয়েছিলেন ভূপেন হাজারিকাকে দিয়ে। বলে দিয়েছিলেন কীভাবে ‘লং শর্টে’ উত্তমকে রাখতে হবে।
জুটি ভেঙে যায়
তবু এ সখ্যও ভেঙেছিল। নানা কারণে। যে সুধীরবাবুর ছবি দিয়ে দুজনের জুটির শুরু, সেই সুধীরবাবুর ছবি ‘দুই ভাই’–তেই যেন একটা দাঁড়ি পড়ল ছ’বছর পরে। ‘তারে বলে দিও’ হেমন্তের সুরে ও কণ্ঠের যুগলবন্দীতে উত্তমের লিপ–এ জনপ্রিয় হল। তারপর ভুল বোঝাবুঝি। দূরত্ব। একসময় আবার কাছাকাছি এলেন দুজনে। কিন্তু এরপর দেখা গেল, উত্তমের ছবিতে হেমন্তর সুর হলে হেমন্ত প্রধানত গাইছেন রবীন্দ্রসঙ্গীত, সেই সব সোনালি বালুকাবেলার গান নায়!