ধীমান দাশগুপ্ত- সুম্বাওয়া দ্বীপ, জাভা সুমাত্রা দ্বীপপুঞ্জের মাঝখানে ভারত মহাসাগরের সুন্দা স্ট্রেইটের মাঝে একখণ্ড ডাঙ্গা। সেখানে কেউ থাকেনা। একটা পাহাড় কেবল মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে, তার নাম ট্যাম্বোরা। তখনো আজকের ইন্দোনেশিয়ার নামকরন হয়নি। ওলন্দাজ বা ডাচদের দখলীকৃত এই দ্বীপপুঞ্জের নাম ছিলো বাটাভিয়া। প্রাচীন বৌদ্ধ সভ্যতা, প্রচুর হিন্দুর বাস, ইসলামের প্রসার ঘটেনি। এক ওলন্দাজ জরিপকার কিন্তু খেয়াল রাখছিলেন। কয়েক বছর ধরে ২৮০০ ফিট উঁচু এই পাহাড়টা আস্তে আস্তে বাড়ছিল। যখন ৩২০০ ফুটে পৌছল, স্বদেশী নৌবাহিনীর কর্তাদের জানালেন তিনি। কেউ পাত্তা দেয়নি, কারণ ওই ছোট্ট দ্বীপে জন বসতি নেই, চাষাবাদ হয়না। ১০ই এপ্রিল ১৮১৫, সকাল ১০টা ২৬, স্মরণকালের প্রচন্ডতম অগ্ন্যুৎপাতটি শুরু হল। ট্যাম্বোরার উদগিরনের তুলনামূলক উপমা ১৩,০০০ হিরোসিমা আণবিক বোমার সমান। এতে পৃথিবীর একটিও প্রান বাঁচার কথা নয়। তবে বিস্ফোরণটি ঘটেছিল ভূপৃষ্ঠের সাড়ে চার কিমি নিচে এবং তার ফল স্বরূপ যে বিধ্বংসী মেঘটা তৈরি হয়, সেটি ভূপৃষ্ঠের ৫২ কিমি ওপরে। সেদিন সকালের সুনামিতে ৭০,০০০ মানুষ মারা যায় তৎক্ষণাৎ, এবং আনুমানিক ৮০,০০০ মানুষ পাইরোক্লাস্টিক ফ্লো, অর্থাৎ আগ্নেয়গিরি থেকে নির্গত ছাইয়ের স্রোতের মধ্যে পড়ে। সমগ্র ওলন্দাজ নৌবাহিনী ধ্বংস হয়ে যায়। মৃতের সংখ্যাটা সেইদিন দেড় লক্ষ হলেও, এই উদ্গিরনেরে ফলে চার বছরে, ১৮১৫ থেকে ১৮১৮’র মধ্যে সারা বিশ্বে ১৫ লক্ষ মানুষ মারা যান। তখন পৃথিবীর জনসংখ্যা ৭০ কোটির আশপাশে, এবং সেই অনুপাতে এটা একটা বিশাল প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ট্যাম্বোরা সেদিন সকালে বায়ু মণ্ডলের ৫২ কিলোমিটার উপরে এক লক্ষ কিউবিক কিলোমিটারের বেশি লোহা এবং সিলিকা (কাচ) ভর্তি পাইরোক্লাস্টিক ছাই ছুঁড়ে দিয়েছিলো। পৃথিবীর ঘূর্ণনের বায়ু স্রোত বা করিয়ালিস ফোর্স ধরে এই ছাই আট পরতের এক আয়না মেঘ তৈরি করে; ঢেকে ফেলে সারা পৃথিবীর আকাশ। ফেরত চলে যায় সূর্যের সব আলোক কনিকা। এক অনন্ত রাত্রি নেমে আসে, পৃথিবী তার প্রাপ্য তাপের কণামাত্র পায়নি এই চার বছরে। ভূবিজ্ঞানে এই সময়টাকে উল্লেখ করা হয়েছে ‘ট্যাম্বোরান ইভেন্ট – দ্য ইয়ার্স উইদাউট সামার’ নামে।
সুইটজারল্যান্ডে ১২০ দিন টানা বৃষ্টির পরে ভয়াবহ বন্যা হয়েছিলো ১৮১৫ সালে। সারা পৃথিবীতে ফসল ফলা বন্ধ হয়েছিলো – সূদূর কানাডাতে এক কনা গম ফলেনি। ধান চাষের সবচেয়ে উর্বর অঞ্চল, দক্ষিণ চীনে, খাদ্যের অভাবে মানুষ চিনেমাটি চুষে বেঁচে থাকার চেষ্টা করেছে। লন্ডনের সকাল এগারোটার আকাশকে সন্ধ্যা সাতটা বলে মনে হতো। ১৮১৭ সালে দক্ষিণবঙ্গে গঙ্গাবক্ষে জন্ম নিলো কলেরা জীবানু ভিব্রিও কলেরে – সমুদ্র ধরে ছড়িয়ে গেলো সারা পৃথিবীতে। লক্ষ লক্ষ মানুষ মরতে লাগলো। এই বীভৎসতাকে দেখে মেরী ওলস্টোনক্রাফট শেলী লিখলেন তাঁর উপন্যাস ফ্রাঙ্কেন্সটাইন, এবং লর্ড বায়রন লিখলেন ডার্কনেস নামের মহাকাব্য।
যে কারণে ট্যাম্বোরার প্রায় অকথিত ইতিহাসের উপস্থাপনা, তাঁর কারণ ট্যাম্বোরা নয় এবং অত মানুষের অকথিত মৃত্যুও নয়। এগারোর শতকে ইজিপ্ট এবং সিরিয়ায় এক ভূমিকম্পে এক ঝটকায় এগারো লক্ষ মানুষ মারা যায়। তেরোর শতকে ইউরোপে মাউন্ডার ক্ষুদ্র হিমায়নে অনাহারে এবং ব্যুবনিক প্লেগে মারা যান প্রায় চব্বিশ লক্ষ মানুষ। পনেরোর শতকে চীনে ২২ বছর ব্যাপী বন্যা হয়, এবং ষোলোর শতকের প্রথমার্ধে এক ভূমিকম্পে প্রায় ৬ লক্ষ মানুষ মারা যান। এগুলো বড়সড় কথিত ঘটনা। এছাড়া অকথিত ঘটনা, অনামী দেশে অথবা মানুষের তৈরি হত্যালীলা, মন্বন্তর যা আছে তা তো আছেই। ১৯১৪য় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে আশি বছর পরে ১৯৯৩ রাষ্ট্রসংঘের হিসেব বলছে, মানব সম্মতিক্রমে ১৮.৭ কোটি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে দুটি বিশ্বযুদ্ধে মাত্র সাড়ে ছয় কোটি মানুষ মারা গিয়েছিলেন। মনুষ্যকৃত হত্যালীলা আকারে অনেক অনেক বড়! কথাটা ছুঁড়ে দিলেন বিংশ শতকের ভূতাত্ত্বিকরা এবং ভূপদার্থবিদরা। ট্যাম্বোরার মতন ঘটনা যখন ঘটে, কেন ঘটে? এর মধ্যে কি কোন অন্তর্নিহিত নকশা রয়েছে?
আশির দশকের শেষের দিক। রোনাল্ড রেগান আর মারগারেট থ্যাচারের পৌরোহিত্যে জন্ম নিলো IPCC বা ইন্টার গভর্নমেন্টাল প্যানেল ফর ক্লাইমেট সায়েন্স – বক্তব্য মনুষ্য ব্যবহৃত জৈবিক জ্বালানির ফলে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বাড়ছে, এবং পৃথিবী একদিন বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাবে। উদ্দেশ্য দেরিতে হলেও ধরা পড়ে গেছে – এই গ্রহের ৭০% মানুষ থাকে দক্ষিণ এশিয়ায় এবং নিম্ন সাহারা আফ্রিকায়। তাঁদের যদি উষ্ণায়নের জুজু দেখিয়ে তেল ব্যবহার কম করানো যায় তবে একই উৎপাদনের হারে (১৯৭২র পর থেকে তেলের উৎপাদন বাড়েনি) উন্নত দুনিয়ার রাষ্ট্রগুলি কম দামে তেল কিনতে পারবে। কাজও হল। ১৯৯৭ থেকে ২০১৬ অবধি তেলের দাম পড়েছে। সমস্যাটা শুরু হল এবার। ইরান আমেরিকাকে তেল বেচবে না, বেচবে না ব্রিটেন সহ জি৭ দেশগুলিকে জানিয়ে দিলো সাফ। আসল সমস্যাটা কিন্তু শুরু হয়েছিলো দুই দশক আগে। একদল বিজ্ঞানী জানিয়ে দিয়েছিলেন যে তারা উষ্ণায়নের তত্ত্বের সঙ্গে সহমত নন। রাষ্ট্রসংঘ যা বলছে সবই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
উষ্ণায়ন বিরোধী বিজ্ঞানীদের মধ্যে পথিকৃৎ যারা তাঁদের মধ্যে রয়েছেন হার্ভার্ডের রিচার্ড লিন্ডজেন, ডঃ ডন ইস্টারব্রুক, নাসার প্রাক্তন বিজ্ঞানী জন কেসি, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ডেভিড আর্চিবল্ড প্রমুখ। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হলেন সেন্ট পিটারর্সবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী হাবিবিবুল্লোহ ইস্মাইলোভিচ আব্দুসসামাটোভ। উনি মিলুতিন মিলাঙ্কোভিচের সূর্য নিয়ে কাজ, যা মিলাঙ্কোভিচ সাইকেল নামে প্রসিদ্ধ, তার ওপর নানা পরীক্ষা নিরিক্ষা করে জানাচ্ছেন, সূর্য মাঝে মাঝে ছুটিতে যায়। সূর্যের গায়ের গভীর চৌম্বকীয় ক্ষেত্র বা সান স্পটগুলি একটা সোলার সাইকেলে সর্বাধিক ৫৫০টির বেশী যাকে ‘সোলার ম্যাক্সিমা’ বলে এবং সর্বনিম্ন শূন্যে নেমে যায়, যাকে ‘সোলার মিনিমা’ বলে। সানস্পটের অস্তিত্ব যখন থাকে না, তখন সূর্যের চৌম্বকীয় ক্ষেত্র উল্টে যায় – অর্থাৎ উত্তর মেরু চলে যায় দক্ষিণে, দক্ষিণ চলে আসে উত্তরে। আর যেহেতু পৃথিবীর চৌম্বকীয় ক্ষেত্র সূর্যের উপর নির্ভরশীল, এই গ্রহেরও চৌম্বকীয় ক্ষেত্র উল্টে যায়। শেষ সোলার ম্যাক্সিমা ১৮৮০ নাগাদ ঘটেছিলো – ১৮৮৩ সালে উদ্গিরিত হয়েছিলো ক্রাকাটোয়া বালি দ্বীপপুঞ্জে। উদ্গীরনের শব্দ মানুষের পৃথিবীর ইতিহাসের প্রচন্ডতম – ৪০০০ কিমি দূরে অস্ট্রেলিয়ার মরুপ্রদেশে এবং পেশোয়ারে শোনা গিয়েছিলো। এর ফলে ঘটা সুনামিতে মারা যান ৭০,০০০ মানুষ, রাত্রে ঘুমের মধ্যে। আর গত সোলার মিনিমা – সেটা ঘটেছিলো ১৮১৫র আশেপাশে তারই ফল ট্যাম্বোরা।
বিজ্ঞানী জন কেসি তার ‘দ্য কোল্ড সান’ গ্রন্থে জানাচ্ছেন গড়ে ২০৬ বছরে একবার করে সোলার মিনিমা আসে। এটা ভূমিকম্প, অগ্নুৎপাত ছাড়াও ঝড় ঝঞ্ঝার সময়। এসময় ফসল নষ্ট হয়, খাদ্যাভাব দেখা দেয়, দেখা দেয় মহামারী, প্রবল প্রানহানি ঘটে। অস্ট্রেলিয়ার রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ডেভিড আর্চিবল্ড তাঁর সাম্প্রতিক গ্রন্থ ‘দ্য টোয়াইলাইট অফ অ্যাবান্ডান্সে’ দেখাচ্ছেন, কেন একুশ শতকে জীবন দুর্বিষহ, যন্ত্রণাময় এবং ছোট হয়ে আসবে। ১৮৮০র দশকে সানস্পটের সংখ্যা ছিলো ৫৫০র বেশি, ২০১৭তে তা দাড়িয়েছে ২৩টিতে। অর্থাৎ পৃথিবী একটি সোলার মিনিমার খুব কাছাকাছি রয়েছে। একটি সহজ পাটিগণিত – ১৮১৫ বা ট্যাম্বোরার বছরের সঙ্গে জন কেসি নির্দিষ্ট ২০৬ যোগ করলে আমরা ২০২১ পাই। যেহেতু এটা একটা গড় সংখ্যা সালটা একবছর এদিক ওদিক হতে পারে। তবে এটা পরিষ্কার যে এই গ্রহের সমগ্র প্রাণ এক প্রবল বিপর্যয়ের দিকে চলেছে এবং সেই দিনটার খুব দেরি নেই। এই সম্পর্কে মানুষের কিছু করারও নেই। কিন্তু, তাই বলে কি জানবো না, ভাববো না আগত পরিস্থিতি নিয়ে।