প্রচেত গুপ্ত
২৯ মার্চ ২০২০ তারিখ এই কলামে করোনা নিয়ে ‘আশা’র কথা লিখতে শুরু করি। শেষ করি ১২ নভেম্বর ২০২০ তারিখে। শেষের পরেও আজ, ৬ ডিসেম্বর আবার লিখতে হচ্ছে। চিঠির ‘পুনশ্চ’র মতো। পৃথিবীতে কোভিড ১৯–এর ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু হতে আর মাত্র কয়েকটা দিনের অপেক্ষা।
কেন আবার লিখতে হচ্ছে?
২৯ মার্চ ২০২০ তারিখ আমার লেখার শিরোনাম ছিল, ‘জিততে হবে, আমাদের জিততেই হবে’। অনেকে হেসেছিলেন। বলেছিলেন, ভ্যাকসিন তৈরির জন্য কম করে ১২ বছর অপেক্ষা করতে হবে। এটা বেড়ে ২০ বছরও হতে পারে। আবার অন্ততকালও লেগে যেতে পারে। সেটার সম্ভবনাই বেশি। কত ভাইরাসের ভ্যাকসিন তো আজও বেরোয়নি। সার্স, মার্স, ঘার্স। এবারও বেরোবে না। সাধারণ মানুষ এই হতাশার কথা বলতেন, আবার ‘কিছু বিশিষ্টজন’–এর কাছে থেকেও শিখেছিলেন। রেডিও, টিভি, সেমিনার, ওয়েবিনারে তাঁরা বলতেন। পত্রপত্রিকায় ইন্টারভিউ দিতেন, লিখতেন। ভ্যাকসিন বেরোবে না, বেরোবে না, বেরোবে না। খেয়াল করে দেখবেন, এখন আর তাঁরা কিছু বলেন না। আগে দিনে দশবার দর্শন দিতেন, কুড়িবার শ্রবণ দিতেন, তিরিশবার কথন দিতেন। এখন অল স্টপ।
সে এখন তাঁদের না পাই, যতটা পেরেছি সেই সব ‘কিছু বিশিষ্টজন’–এর কথা রেকর্ড করে রেখেছি, পত্রপত্রিকা সংগ্রহ করেছি। অতিমারী তো একশো বছরে একবার আসে। সব ধরনের তথ্য রাখতে হবে না? ইচ্ছে আছে, তাঁদের নাম–পরিচয় উদ্ধৃত করে একটা লেখা লিখব। ইতিহাসের জানা উচিত, কোন সেই ‘কিছু বিশিষ্টজন’, যাঁরা মানবজাতির সভ্যতা, মেধা, বিজ্ঞানের উন্নতির ওপর ভরসা হারিয়েছিলেন। তাঁদের তাচ্ছিল্য করেছিলেন। এই তাচ্ছিল্যে গভীর সঙ্কটে মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন। আমার স্থির বিশ্বাস, কিছুদিনের মধ্যে এই ‘কিছু বিশিষ্টজন’ ড্যামেজ কন্ট্রোলের চেষ্টা শুরু করবেন। যা আগে বলেছিলেন, তার উল্টো কথা বলবেন। বলুন, সেটাও রাখব। তখন লেখার শিরোনাম হবে—
‘তিনি ভ্যাকসিনের আগে ও তিনি ভ্যাকসিনের পরে’।
১২ নভেম্বর ২০২০ তারিখ এই কলামে লিখেছিলাম, ভ্যাকসিন এসে গিয়েছে। জয় দুয়ারে। দেখলাম, যাঁরা আগে অবজ্ঞার হাসি হেসেছিলেন, তাঁরা দুটো ভাগে ভাগ হয়ে গেলেন।
একদল এমন ভান করছেন যেন ভ্যাকসিনের কথা তাঁরাও জানতেন। বলেননি এই যা। যেমন আমাদের পাড়ার ঘন্টুদা। ঘন্টুদার হাঁটাচলা, হাবভাব দেখলে এখন মনে হয়, সারা গিলবার্টের সঙ্গে তাঁর নিয়মিত হোয়াটসঅ্যাপ চালাচালি চলে। গুড মর্নিং, গুড নাইট জানাচ্ছেন। গিলবার্ট ম্যাডাম নিয়মিত ঘন্টুদাকে ভ্যাকসিনের আপডেট দিচ্ছেন। ঘন্টুদা এতদিন গোপন রেখেছিলেন। যাতে ভ্যাকসিনের ফমুর্লা ফঁাস না হয়ে যায়।
আরেক দল এখনও গেঁা মেরে রয়েছেন। তাঁরা ঘাড় বেঁকিয়ে বলছেন, ভ্যাকসিন এসেছে ঠিকই, কিন্তু সেটা পরের কথা, আগে প্রশ্নের জবাব চাই।
ভ্যাকসিনের দাম কত হবে? সব মানুষ কি সেই দাম দিতে পারবে? দাম কি চেকে দিতে হবে নাকি ক্যাশে? গুগ্ল পে? আমাজনের জঙ্গলে ভ্যাকসিন কবে পৌঁছোবে? ভ্যাকসিন কীভাবে রাখা হবে? তার জন্য আলাস্কা থেকে বরফ আনা হবে কি না? ভ্যাকসিন কীভাবে মানুষের কাছে পৌঁছোবে? গরুর গাড়িতে? নাকি জেট প্লেনে? সবথেকে বড় কথা হল, কবে আমি পাচ্ছি মহায় (পড়তে হবে মশাই)? আমি না পেলে মহায় ভ্যাকসিনের নিকুচি। মনে রাখবেন, ভ্যাকসিন মিথ্যে, আমাদের এই সব প্রশ্নই সত্যি। কালই জবাব চাই। দরকার হলে মাস্ক ছাড়া মিছিল বেরোবে।
‘আ, জবাব চাই, জবাব দাও। আ, কোভিড ভ্যাকসিনের কালো হাত ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও। আ, ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও। আ বড়লোকের দেশে তৈরি ভ্যাকসিন তোমায় আমরা মানছি না মানব না। আ, রক্তচোষা ভ্যাকসিন তোমায় আমরা মানছি না, মানব না। ভ্যাকসিন তুমি নিপাত যাও, নিপাত যাও।’
এই জন্যই আজ আবার লেখা। সকালে খবরের কাগজে দেখলাম, লন্ডনে ভ্যাকসিন পৌঁছেছে। ভারতেও কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু হবে। চারপাশে যেন আলো জ্বলে উঠল। দীর্ঘ অন্ধকারের পরে আলো।
আমি যে ভ্যাকসিনের ওপর গোড়া থেকে ভরসা রেখে এসেছিলাম, তা কি আমি বিজ্ঞানী বলে? না। চিকিৎসক বলে? না। জ্যোতিষী বলে? না। বিশিষ্টজন বলে? না। আমি একজন অতি সাধারণ মানুষ। মানুষকে বিশ্বাস করেছিলাম। তার মেধাকে বিশ্বাস করেছিলাম। বিজ্ঞানের উন্নতিতে বিশ্বাস করেছিলাম। বিশ্বাস করেছিলাম, অতীতের অতিমারীর সঙ্গে কোভিডের তুলনা ভুল হবে। বিশ্বাস করেছিলাম, পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ বিজ্ঞানী চেষ্টা করছেন। তাঁরা একটা কিছু হদিশ দিতে পারবেন। তাঁরা ইন্টারভিউ দেন না, অসাধ্য সাধন করেন। করেছেনও। শুধু আমি নই, আমার মতো পৃথিবীর কোটি কোটি সাধারণ মানুষ, যাঁরা ‘কিছু বিশিষ্টজন’ নন, তাঁরাও ভরসা রেখেছিলেন। শুধু বিজ্ঞানী নন, সেই সাধারণ মানুষও আজ জিতেছেন।
ভ্যাকসিনের দাম কেমন হবে? কীভাবে সব জায়গায় পৌঁছোবে? ধনী–দরিদ্র নির্বিশেষে সবাই পাবে তো? অবশ্যই এগুলো জরুরি প্রশ্ন। কিন্তু সবার আগে তো ভ্যাকসিন চাই। ভ্যাকসিন দেওয়াই শুরু হল না, তার আগেই এ সব! ৫ ডিসেম্বর ২০২০ পর্যন্ত গোটা বিশ্বে করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন ১৫,১৮,৭৩৪ জন। আমাদের দেশ মঙ্গল গ্রহে নয়। এই বিশ্বেই। এখানেও বহু মৃত্যু হয়েছে। করোনা এমন অসুখ, দেশ মানে না। মনে রাখতে হবে, শুধু ‘আমি’ ভ্যাকসিন পেলে কোনও লাভ নেই, ‘তোমার’ও লাগবে। আফ্রিকারও লাগবে, আমেরিকারও লাগবে। উই আর দ্য ওয়ার্ল্ড।
আসুন, ভরসা রাখি। ভরসা রাখি, ভ্যাকসিন আমরা সবাই পাব। পেতেই হবে। না পেলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করব। এখন সে সময় নয়। এখন অন্য সময়। যেদিন মানবদেহে প্রথম করোনা প্রতিষেধক দেওয়া হবে (ট্রায়াল হিসেবে নয়, প্রতিষেধক হিসেবে), আমরা যে যেখানে থাকি, তুমুল করতালি দিয়ে বিজ্ঞানীদের অভিনন্দন জানাই। সব দেশের সব মানুষ যেন সেই করতালির আওয়াজ শুনতে পায়। সেই করতালিতে করোনার সঙ্গে কুসংস্কার, হিংসে, স্বার্থপরতা, মানুষকে ভরসা না করার অসুখ ভেসে যাক। সভ্যতার এক উজ্জ্বল দিনের সাক্ষী হতে চলেছি আমরা। আসুন বিশ্বাস করি, একদিন ক্যান্সারের প্রতিষেধকও এভাবে আবিষ্কার হবে। হবেই।
তৈরি থাকুন। সেদিনও আসছে।