সম্রাট মুখোপাধ্যায়
ঘরপোড়া গরু, সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায়।
গত রবিবারের ‘আজকাল’ তার প্রথম পাতায় সেই আতঙ্ক বয়ে আনল। এই খবরটায় যে, দর্শকের অভাবে কলকাতার বেশ কিছু সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যেতে বসেছে। যাদেরকে ‘সিঙ্গল স্ক্রিন’ হল বলা হয় ‘মাল্টিপ্লেক্স’–উত্তর সিনেমা–সংস্কৃতির কালে। যাদের ঐতিহ্য আছে, কৌলীন্যও আছে, অর্থবল আর এখন নেই ততটা।
ওই খবর এটাও জানাচ্ছে, এই বন্ধ হওয়া সাময়িক। এখন যেহেতু বাজারে বড় কোনও (পড়তে হবে ‘হিন্দি’ কোনও) রিলিজ নেই, তাই আপাতত কিছুদিন বন্ধ থাকবে হল। আবার তারা খুলবে ডিসেম্বরের শেষে ‘কাকাবাবু’ বা অন্য বড় কোনও ‘রিলিজ’ হাতে পেলে।
তাহলে এ খবরের মধ্যে এটুকু স্বস্তি ভাসানো আছেই যে, সব কিছু ঠিক হলে, আবার বড় ছবিরা ঝাঁক বেঁধে এলে আবার সিনেমার বাজার স্বাভাবিক হবে। আবার একে একে খুলিবে দেউটি।
কিন্তু দু–তিনটে খটকা ওই আশ্বাস ভেদ করেও থেকে যাচ্ছে। সেগুলো মাথা থেকে নামানো যাচ্ছে না।
এক, তাহলে বাংলার সিনেমার বাজার কি তার বাণিজ্যের জন্য হিন্দি সিনেমার বাণিজ্যের গায়ে হেলান দিয়ে থাকবে? খানিকটা ‘বাইপ্রোডাক্ট’–এর মতো (!)? গত এক দশকে নতুন মধ্য–ধারার বাংলা সিনেমা শক্তিশালী হয়েছে ভাষায়, প্রভাবে, দর্শক–আকর্ষণে। শুধু বাংলা সিনেমার নায়ক–নায়িকারাই নন, এখন একঝাঁক বাঙালি তরুণ পরিচালকও নক্ষত্রের মর্যাদা পান। বাজারে তাঁদের নামের সেই গ্রহণযোগ্যতা আছে। ইউটিউবে এইসব সিনেমার গান লাখ–ছড়ানো ‘হিট’ পায়। তারপরও এই আত্মবিশ্বাস–শূন্যতা কেন?
এরই সমকালে গত পৌনে এক দশক ধারাবাহিকভাবে আমরা একটি বিতর্কে অভ্যস্ত থেকেছি যে, বড় ব্যানারের হিন্দি ছবির হল ধরার চাপে আমাদের ঘরের বাংলার ছবি নাকি রিলিজের ‘চেন’ পাচ্ছে না। আমির–শাহরুখ–সলমন–রণবীরদ্বয়দের চাপে কোণঠাসা হয়ে যাচ্ছে জিৎ–দেব–সোহম বা আবির–পরম–ঋত্বিকেরা। একটা দাবি উঠছিলই, আঞ্চলিক শিল্প–সংস্কৃতির মুখ চেয়ে দক্ষিণী মডেলে ওই রাজ্যেও হল–পিছু বেঁধে দেওয়া হোক হিন্দু ছবির শোয়ের সংখ্যা। অগ্রাধিকার পাক বাংলা ছবি।
ওই বিতর্কের ভেতর বিভিন্ন নামী হল–মালিকদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে দেখেছি, তাঁরা দায়ী করতেন ভারতের বাণিজ্য–রাজধানী মুম্বইয়ের বিভিন্ন প্রযোজক সংস্থা তথা ‘ডিস্ট্রিবিউটর’ সংস্থার একচেটিয়া চাপকে। কখনও কিন্তু অর্থনৈতিক লাভালাভের প্রসঙ্গ তোলেননি।
এবার কিন্তু অন্য কথা শুনলাম! ‘করোনা’ একটা অন্যরকম বাস্তব সামনে এনে দিয়েছিল। যেখানে জোগান–পাইপে কেবলই বাংলা ছবি। সামনে বাংলা সিনেমার বাজার। উন্মুক্ত। ‘পথ রুধি’ কোনও ‘ভিন ঠাকুর’ দাঁড়িয়ে নেই। বাংলার সিনেমা–বাজার বাংলা সিনেমার বাজার দরেই আত্মসমীক্ষা ও সঞ্চয় সেরে নিতে পারত। তা ঘটল না।
জানি, পাল্টা প্রশ্নও তৈরি থাকবে। যে বাংলা ছবিগুলো যুক্তি পেয়েছিল পুজোর বাজারে, একমাত্র আংশিকভাবে ‘ড্রাকুলা স্যার’ ছাড়া তারা কেউই সেভাবে বাজার ধরতে পারল না কেন? মনে রাখতে হবে, বাজারটা কিন্তু ছিল পুজোর ছবির বাজার। যার বিশেষ একটি চরিত্র আছে। সেই পাঁচের দশকের মাঝামাঝি, উত্তম–সূচিত্রা, অগ্রদূত–অগ্রগামীর আমল থেকেই বাঙালির পুজোর ছবি অন্য রকম। ফুরফুরে মেজাজের রোমান্টিক। পারিবারিক। যা একটা ‘কী রহস্য, কী প্রেম’ সিনেমার শেষে ‘ফিল গুড’ হাওয়া আনে।
খেয়াল করতে হবে এবার যে সব ছবি এসেছিল পুজোর বাজারে, তারা ঠিক এই পর্যায়ে পড়ে না কিন্তু। পুজোয় এরা যুক্তি পাবে এমন কোনও জন্ম–পরিকল্পনাও লেগে ছিল না এদের গায়ে। আগেই মুক্তি পাওয়ার কথা। শেষ গ্রীষ্মে, ঘোর বর্ষায়। গণিতের গোলমালে চলে এল মধ্য শরতে। উপরন্তু পুজোর সময়ে প্যান্ডেলে ঢোকার বিধিনিষেধও হয়তো দর্শকমনে কোথাও পরোক্ষ প্রভাব ফেলে থাকবে।
ফলে বলতে চাইছি, সবটাই যে বাংলা সিনেমা ‘ফেল’ করে গেল, এমনটা না হয়তো। চোট কাটিয়ে ফিরে আসা একজন খেলোয়াড় প্রথম প্রথম আপাত ব্যর্থ হয়েও একজন দক্ষ অধিনায়ক কিংবা কোচের পরিচর্যায় টিমে থেকে যায়। এই শুশ্রূষা–কাল তাকে ফর্মে ফিরতে সাহায্য করে। কিন্তু সেই ধৈর্যটুকু, সেই লালনটুকু যেন এবার বাংলা সিনেমা পেল না।
সৃজিত–শিবপ্রসাদ–নন্দিতা–কৌশিক–রাজ–কমলেশ্বর–অরিন্দমদের ছবি বাজারে থাকলে বাজার একখানিই বিরূপ থাকত কিনা, তা কিন্তু পরখ হল না। আমি এক্ষেত্রে প্রযোজক সংস্থাগুলিকেও কিছুটা দায়ী করব। তারাও কিন্তু তাদের বেশ কিছু সঞ্চয় আগলে রাখল। যেখানে দরকার ছিল কয়েকটি ‘ওভারস্টেপ’ করে এগিয়ে আসার। নিরাপদ ‘স্টান্স’–এ খেলার অভ্যাস ছেড়ে। মনে রাখতে হবে, খাঁচার বাঘ আর বিনোদনের বাজারু দু’জনেই ঝুঁকি দেখার জন্য ছটফট করে।
বাংলা ও হিন্দু সিনেমার পরিসংখ্যান নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা জানেন, গত আধ দশকে এটা প্রায় একটা স্থায়ী প্রবণতায় পরিণত হয়েছে যে, বছরের প্রথম ছ’–সাত মাস বড় কোনও হিট থাকে না (একমাত্র ব্যতিক্রম থাকে যে মাসে শিবপ্রসাদ–নন্দিতাদের ছবিটি, আর একবার ছিল কৌশিক গাঙ্গুলির ‘বিসর্জন’)। নিভু আঁছের মতো ধিকধিক করে বক্স অফিস চলে। আগস্টের মাঝামাঝি থেকে অবস্থা বদলায়। হাওয়া তেজি থাকে দেওয়ালি পর্যন্ত। তারপর আবার এক মাস ভাটা। বড়দিনে ফের বড় ছবির হাওয়া আসে। তার মানে বছরে বক্স অফিসের ‘সিজন’ কিন্তু মেরেকেটে ৪ মাসের। বাকি ৮ মাস অপেক্ষায় টেনে নিয়ে যাওয়া।
এখানেই দু’নম্বর প্রশ্নটা। যে এবার সেই অপেক্ষাটা করলেন না কেন ওই হল–মালিকেরা?
৮ মাস নয়, ৮ সপ্তাহও দেখলেন না তাঁরা! অথচ যখন হল বন্ধ রেখেছিল প্রশাসন, তখন তাঁরাই চেঁচিয়েছিলেন আর্তরবে। হল খুলে দেওয়া হোক অবিলম্বে। তখন তো পরিস্থিতি আরও খারাপ ছিল। অথচ যখন খুলল, তখন কত তাড়াতাড়ি হাল ছেড়ে দিলেন তাঁরা! দেখার চেষ্টা হল না, পুরনো কোনও হিট ছবি ফিরিয়ে আনলে কী হয় (এই যেমন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতিই সে সুযোগ এনে দিয়েছে)। দেখার চেষ্টা হল না, টিকিটের দাম ন্যূনতম করে দর্শককে টেনেও আনা যায় কিনা হলে। এমন সব পরীক্ষা–নিরীক্ষার আগেই সামগ্রিক বন্ধের সহজতর পথ নিয়ে নেওয়া হল। আশার কথা অবশ্য এটুকুই, শহরের সব হল–কর্তৃপক্ষ এমনটাই ভাবেননি। কেউ কেউ এটাও ভেবেছেন ‘শো মাস্ট গো অন’। তার হদিশও ওই প্রতিবেদনে আছে।
তবে ওই দুটো প্রশ্নের পাশাপাশি একটা আড়াই নম্বর কথাও আছে। আর সেটা ভয়ের। বাঙালির বিনোদনে একসময় সাধের বাগান ছিল সাধারণ রঙ্গালয়। হাতিবাগানের ‘বোর্ড’ থিয়েটার। সেখানেও এককালে মন্দা এল। নয়ের দশকে তখন কিছুদিন–কিছুদিন এমনই সাময়িক বন্ধ রাখা হত ওইসব হল। পরবর্তী বড় কোনও ‘হিট’–এর অপেক্ষায়। দ্রুতই সে বাগিচা শুকিয়ে গেল। দর্শক অন্য বিনোদনে সরে গেলেন। এবারও তেমন কিছু ঘটবে না তো? মালিকেরা ভাবুন। সরকারও ভাবুক। আলোচনা হোক।
আজ আমরা যাদের ‘রিলিজ চেন’ নামের দু’শব্দের ইংরেজি গরিমায় ঢেকে ফেলি, তাদের অনেকেরই জন্ম হয়েছিল কিন্তু পরাধীনতার দিনগুলোয়। দ্বারোদ্ঘাটনে এসেছিলেন নেতাজি, নজরুল, কবিগুরুরা। সাহেবপাড়ার উত্তরে এ সব হল ছিল বাঙালির সাংস্কৃতিক গর্ব। তারা আজ বিনা যুদ্ধে সরে যাবে?