প্রচেত গুপ্ত
চারপাশে কত ‘অমানু্ষ’দের কথা শুনছি, দেখছি, চিনছি।
কোভিড আক্রান্তদের ওপর এই অমানুষেরা কী অসভ্যতাই না করছে! সাধারণ মানুষ তো আছেই, ডাক্তার, ব্যাঙ্ককর্মী পর্যন্ত বাদ যাচ্ছে না। বাদ যাচ্ছে না তাদের আত্মীয়রাও। কাউকে রাস্তায় ফেলে মারা হচ্ছে, কাউকে ‘জুতো পেটা’ করা হচ্ছে। কাউকে নিজের বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না, ফ্ল্যাটে থাকতে দেওয়া হচ্ছে না, আবাসনে গাড়ি ঢোকাতে দেওয়া হচ্ছে না।
এদের অপরাধ কী?
এদের বা এদের আত্মীয়দের কোভিড হয়েছে। অনেকের সেরেও গিয়েছে। অথবা কোভিড হয়নি, এরা বিভিন্ন জরুরি পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত। ব্যাঙ্ক, অফিস, পুরসভা, স্বাস্থ্য দপ্তর হাসপাতাল থেকে কাজ সেরে বাড়ি ফিরছেন। সেটাও অপরাধ। ডাক্তার কেন হাসপাতালে যাচ্ছেন? ব্যাঙ্ককর্মী কেন ব্যাঙ্কে? পুরসভার কর্মী কেন পথে ঝঁাট দেবেন? স্বাস্থ্যকর্মীরা কেন হাসপাতালে রোগীর সেবা করবে? অমানুষরা ‘রে রে’ করে উঠছে। বলছে, ‘এদের পাড়ায় ঢুকতে দেব না, বাড়িতে ঢুকতে দেব না।’
এই অমানুষেরা কারা?
সবাই চেনা পরিচিত। পাড়া প্রতিবেশী। এলাকা, বিভিন্ন আবাসন, ফ্ল্যাটবাড়ির মাতব্বর, মোড়লের দল। একরকম গুন্ডাই বলাই যায়। এরা বেশিরভাগই শহুরে ‘শিক্ষিত’, ‘ভদ্রলোক’। ছাত্রাবস্থায় তিনবার জয়েন্ট ফেল করেছে। পঁাচবার ব্যাঙ্কের পরীক্ষায় গোল্লা পেয়েছে। পুলিশ একবার রাস্তায় কান মুলে দিয়েছিল। ধরাধরি করেও শালাকে পুরসভার চাকরিতে ঢোকাতে পারেনি। সেই থেকে রাগ। এখন গায়ের ঝাল মেটাচ্ছে। আমি হলফ করে বলতে পারি, এরা বাড়িতে স্ত্রী ছেলেমেয়ের ওপর হম্বিতম্বি করে। শ্বশুরবাড়ি থেকে ছলাকলায় পণ আদায় করে। বাবা–মাকে ঠিকমতো খেতে দেয় না। ভাই, বোনকে সম্পত্তি থেকে ঠকাতে চেষ্টা করে। এদের দলে আবার উল্টোটাও আছে। বাড়িতে স্ত্রীর কাছে কেঁচো। ছেলের বউ হয়তো বাড়িতে বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারে না। তাই বাইরে বেরিয়ে লেজ নাড়ে। হম্বিতম্বি করছে, পুলিশ সাজে। কোভিড রোগী বা আত্মীয়দের অত্যাচার করছে।
আচ্ছা বলুন দেখি এদের কী শাস্তি হওয়া উচিত? মাথা নেড়া করে গাধার পিঠে চাপিয়ে পাড়া ছাড়া করলে কেমন হয়? খররদার এসব একেবারেই নয়। নিজের হাতে আইন নেওয়া কোনওভাবে উচিত নয়। দেশে যে আইন রয়েছে, মাননীয় বিচারকরা যা পারেন তার মধ্যে দিয়েই যেতে হবে। আমার মাথায় একটা প্ল্যান এসেছে। সে কথায় পরে আসছি।
আমার এই কলম কিন্তু অমানুষদের নিয়ে লেখবার জন্য নয়। এই কলম মানুষদের কথা বলে। আজও বলবে। সবাইকে মুগ্ধ করবে। মানুষ হিসেবে গর্ব বোধ হবে। বলে রাখি, আমি একজনের গল্প বলছি ঠিকই, কিন্তু তাকে অনেকের ‘প্রতিনিধি’ হিসেব ধরছি। এরকম গর্ব করবার মতো মানুষ আরও অনেকে রয়েছে। রয়েছে বলেই তো পৃথিবীটা বসবাসের যোগ্য। তাই নয় কি?
ভদ্রলোকের নাম দেবাশিস কংসবণিক। বছর চল্লিশ বয়স। বাড়ি কোন্নগরে। পুরসভার অ্যাম্বুল্যান্স চালান। পাড়ার ক্লাব ‘তরুণ দল’। সেখানকার শববাহী গাড়ি চালান। সেদিন ফোনে কথা হল। মানুষটি অকুতোভয়। ইতিমধ্যে বহু কোভিড পেশেন্টকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটেছেন। কখনও দ্বিধা করেননি। অনেকে বারণ করেছে। শোনেননি। শুনবেনও না। ক্লাবের শববাহী গাড়ি চালানোর সময় ভাবছেনও না কীসে মৃত্যু হয়েছে? এখানেই শেষ নয়। দেবাশিসবাবু আর তরুণ দলের সদস্যরা মিলে একটা বিশেষ টিম তৈরি করেছেন। এলাকায় কারও কোভিড হয়েছে সন্দেহ হলে চেষ্টা করছেন পৌঁছে যেতে। বাড়িয়ে দিচ্ছেন সহযোগিতা আর আশ্বাসের হাত। চিকিৎসক, কোভিড পরীক্ষা থেকে শুরু করে বাড়িতে রেশন, ওষুধ পৌঁছোনোর কাজে নেমে পড়ছেন সদর্পে। এমনকী হাসপাতালেও নিয়ে ছুটছেন। দেবাশিসবাবুর বাড়িতে বয়স্ক বাবা–মা। ঝুঁকি বেশি। (অনেকেই এই অজুহাতে বাড়িতে বসে পড়েছেন। ওদের কথা ভাবতে হবে না? রাস্তায় নামব কেমন করে? এদিকে সারা বছর কিন্তু বৃদ্ধ বাবা–মায়ের দিকে মুখ ফিরিয়ে দেখেনি। এখন দরদ উথলে উঠছে।) দেবাশিসবাবু কিন্তু পথে। বললেন, পুরসভার অ্যাম্বুল্যান্স চালানোটা তো আমার কাজ। করতেই হবে। তবে আমি শুধু কাজ হিসেবে দেখি না। এটা আমার দায়িত্বও বটে। কোভিড হলে রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে তো হবেই। আমি তো একা করছি না, একাজ বিভিন্ন জায়গায় অনেকে করছেন। সেই জন্যই তো রোগীরা হাসপাতালে যেতে পারছেন। আর ক্লাবের শববাহী গাড়ি চালানোটা আমার কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। মানুষের জন্য এইটুকু করতে তো হবেই। প্রথমদিকে চারপাশে সব শববাহী গাড়ি প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কেউ কেউ বলেছিল, আমাদেরটাও ক’টাদিন বন্ধ থাক। আমি রাজি হইনি। গাড়ি চালু রয়েছে। তবে সবথেকে কাজের যেটা হল, আমাদের ক্লাবের টিম তৈরি। এখন পর্যন্ত ৬ জনকে নিয়ে গিয়ে আমরা হাসপাতালে ভর্তি করেছি। শুধু সরকার বা প্রশাসন এই কাজ একা করতে পারবে না। সম্ভবও নয়। পাড়ায় পাড়ায় ক্লাবগুলো যদি এই ধরনের বিশেষ কোভিড টিম তৈরি করে, সমস্যা অনেকটা কমবে।’
দেবাশিস কংসবণিক এবং তার বন্ধুদের যদি ‘কোভিড যোদ্ধা’ আখ্যা দিই কারও আপত্তি আছে? যদি কুর্নিশ জানাই? মনে মনে মেডেল ঝুলিয়ে দিই? কেউ হিংসে করবেন?
না, করবে না।
আমি জানি দেবাশিসবাবু এবং তার বন্ধুদের মতো আরও অনেক সত্যিকারের ‘মানুষ’ এই কাজ করছেন। কোন্নগরেও করছেন। সারা রাজ্যেই করছেন। গোটা দেশেও করছেন। পৃথিবীর কথাই বা বাদ দিই কেন? কোভিড যেমন দেশের সীমান্ত মানে না, তার কাছে সবাই ‘মানুষ’, আমরাই বা মানব কেন?
যারা কাজ করছেন সবার নাম আমরা জানি না। তারা জানাতে চানও না। আমি খোঁজাখুঁজি করে দেবাশিসবাবুদের কথা জানতে পেরেছি। নিজে উদ্যোগী হয়ে কথা বলেছি। সবার হয়ে সামনে তুলে ধরলাম। এটা কোনও প্রচার নয়। দৃষ্টান্ত।
হিংসে, দলাদলি, ঝগড়া, পরস্পরকে দোষারোপ ভুলে সবাই কাজ করছেন বলেই তো পৃথিবীটা ‘অমানুষ’দের হাতে চলে যায়নি।
এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি।
ক’দিন ভ্যাকসিনের খবর বিশ্বজুড়ে ফলাও করে বেরোনোর পর, মানুষের মনে আশা জেগেছে। যে ‘পণ্ডিত’রা বলেছিল, কতকিছুরই তো ভ্যাকসিন বেরোয়নি, কোভিডেরও বেরোবে না, তাদের মুখে চুন কালি পড়েছে। এই ‘পণ্ডিত’দের আমি চিনি। আমার, আপনার পাশেই আছে। এরা চায় না মানুষ একটু আশা পাক, একটু হাসুক। এর মধ্যে আর এক মাতব্বর হয়েছে ‘হু’। দেখি, ওদের কে একজন বলেছেন, সামনের বছরের আগে ভ্যাকসিন আসতেই পারবে না। হতে পারে। সামনের বছর কেন তিন বছরও লাগতে পারে। কিন্তু ‘হু’–এর কথা শুনব কেন? চীনে যখন কোভিড মারাত্মক চেহারা নিচ্ছে এই ‘হু’ কিছু বলেছিল? না। আমেরিকায় ভয়াবহ হবে— ‘হু’ কিছু বলেছিল ? না। গোটা বিশ্বে ভয়ঙ্কর হবে— ‘হু’ বলেছিল? না। কোভিডের যে ভ্যাকসিন হতে পারে ‘হু’ বলতে পেরেছিল? না। ওরা কি স্পষ্ট করে বলতে পারছে কোভিড কি বাতাসেও ছড়ায়? না। ওরা শুধু বলেছে, ‘এই মাস্ক পরুন। না না, এই মাস্ক পরবেন না, ওই মাস্ক পরুন। না না ওই মাস্ক পরবেন না, সেই মাস্ক পরুন।’
কেন? ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন কি মাস্ক বিশেষজ্ঞ?
নিজেরা অনেক কষ্ট করে বেঁচে আছি। ভ্যাকসিনের আশায় একটু বল পেয়েছি। আমাদের আশা ভরসা হাসি কেড়ে নেওয়ার হু আর ইউ?
এবার শেষ কথা। এটা মজার।
যেসব ‘অমানুষ’ কোভিড রোগী, তাদের আত্মীয়স্বজন, জরুরি পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত মানুষদের ওপর অসভ্যতা করছে তাদের নাম ঠিকানা লিখে রাখা হোক। ভবিষ্যতে পুলিশের মাধ্যমে জমা পড়ুক মহামান্য আদালতে। মাননীয় বিচারকরা তাদের একমাস বিভিন্ন হাসপাতালের বাথরুম পরিষ্কারের দায়িত্ব দিন। ছোঁয়াচে অসুখের রোগীদের বাথরুম হলে সবথেকে ভাল। বিচারে এমন দৃষ্টান্ত তো আমাদের দেশে আছে। মহামান্য আদালত বহু ক্ষেত্রে সামাজিক কাজের মাধ্যমে নিজেকে শুদ্ধির সুযোগ দিয়েছেন।
আমার এই প্রস্তাব কেমন? খারাপ?