দলের সভায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বলেছিলেন, সরকারি প্রকল্পের সুফল কোথাও কোথাও মানুষের কাছে পৌঁছচ্ছে না। যাঁরা কাটমানি নিয়ে মানুষের উপকারের পথে বাধা হয়েছেন, তাঁদের শাস্তি পেতে হবে। এমন অভিযোগ চিরকালই ছিল। এই প্রথম কোনও রাজ্যের একজন মুখ্যমন্ত্রী সরাসরি বার্তা দিলেন, করা যাবে না। ঝাঁপিয়ে পড়ল নীতিহীন নেতি–রাজনীতি করা বিজেপি। এত বড় রাজ্য, কয়েক সপ্তাহ চেষ্টা করে কয়েকটা পঞ্চায়েতে গোলমাল পাকাতে পারল মোদি–শাহর দল। আক্রান্ত হলেন বিশেষভাবে তাঁরা, যাঁরা বিজেপি–র চাপেও দল বদলাতে রাজি হননি। গেরুয়া শিবিরে ঢুকলে নিশ্চিন্ত, আশ্বস্ত করা হল। যাঁরা সাড়া দিলেন না, তাঁরা আক্রান্ত, প্রধানত। একেবারে তৃণমূল স্তরের জনপ্রতিনিধি, যাঁরা আর্থিকভাবে শক্তিশালী নয়, তাঁদের ভয় দেখানো হল, এতটাই ভয় দেখানো হল যে, হামলা থেকে বাঁচতে কেউ কেউ ‘দাবি’ মেনে টাকা ফেরত দিলেন। কাটোয়ার এমনই একজন, তাঁকে সামান্য জমি বন্ধক রেখে টাকা দিতে হল। গুরুতর অসুস্থ। এটা একটা নমুনা মাত্র। বিজেপি নেতাদের কথা শুনুন, ‘দুর্নীতি মানব না। টাকার খেলা মানব না। সৎ, পরিচ্ছন্ন রাজ্য চাই!’ তা, গত লোকসভা ভোটে ৪২ কেন্দ্রে কত কোটি টাকা খরচ করেছে বিজেপি, রাজ্যবাসী দেখেছেন। বলছেন, ওঁরা ‘কাটমানি’ নেন না। টাকার উৎস? বিশ্বস্ত সংস্থার সমীক্ষায় জানা গেল, সাম্প্রতিক লোকসভা ভোটে ২৭,০০০ কোটি টাকা খরচ করেছে কেন্দ্রের শাসক দল। হ্যাঁ, ২৭,০০০ কোটি। একটা শূন্যও ভুল করে ছাপা নয়। নোটবন্দির পর যে–দলের বিষয়–সম্পত্তি কয়েকগুণ বেড়ে গেল, তাঁরা নাকি পরিচ্ছন্ন, দুর্নীতিহীন! তা, এই ২৭ হাজার কোটি টাকা এল কোথা থেকে? কারা দিল? কেন দিল? এই দলটাই বলছে, অন্য দল থেকে আসা লোকেদের ‘শুদ্ধ’ করে নেবে।
কৈলাস বিজয়বর্গীয় ও দিলীপ ঘোষ যখন বলেন যে, ‘শুদ্ধ’ করে নেবেন, স্বীকার তো করেই নেওয়া হচ্ছে যে, বেছে বেছে যাঁদের নেওয়া হচ্ছে, তাঁরা ‘অশুদ্ধ’! ‘শুদ্ধ’ দল গড়ার লক্ষ্যে অবিচল (!) বিজেপি দল–ভাঙানোর রাজনীতি নিয়ে আক্রমণ করছে তৃণমূলকে। মমতা মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর সরকারের কাজে মনোনিবেশ করার জন্য সংগঠনের কাজে যাঁকে সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব দিয়েছিলেন, তাঁর নাম কী? সেই নেতাই কি দল ভাঙানোর খেলাটা ‘শুদ্ধ’ দলে গিয়ে চালিয়ে যাচ্ছেন না? সঙ্গে বিপুল অর্থ, দেশের সব দলের মিলিত অর্থবলের চেয়ে অনেক বেশি। মমতা স্পষ্ট বলেছেন, সেই নেতাকে গুরুত্ব দেওয়া, সংগঠনের রাশ অনেকটাই ছেড়ে দেওয়া, ভুল হয়েছিল। সেই নেতাকেই দল ভাঙানোর দায়িত্ব দিয়ে নিজেদের ‘শুদ্ধ’ প্রমাণ করছে বটে বিজেপি!
এরই মধ্যে, হেস্টিংসে একদিন ছিল নবাগত কিছু লোকের হাতে পতাকা তুলে দেওয়ার অনুষ্ঠান। হাজির থাকার কথা মুকুল রায়ের।
রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ জানিয়ে দিলেন, এরকম করা যাবে না। দলীয় নেতৃত্বের অনুমোদন ছাড়া এভাবে অন্য দল থেকে লোক আনা চলবে না। তবে কি দিলীপবাবু এতটাই নীতিনিষ্ঠ যে, নীতিহীন দল–ভাঙানোর বিরোধী? না। হালিশহর, কাঁচরাপাড়া, দক্ষিণ দিনাজপুরে কিছু জনপ্রতিনিধিকে ভাঙিয়ে ঢাক পিটিয়েছিল বিজেপি। অনেকেই ফিরে এলেন। বিধাননগরে লুচি আলুর দম, সুইমিং ক্লাবে ডিনার–রাজনীতি, তবু পুরসভায় ওলটপালট করা গেল না। মুখ পুড়ল বিজেপি–র। তবু আনন্দ রাজ্য সভাপতির। মুকুল রায় নতুন লোক এনে, ‘অশুদ্ধ’ (যাঁদের পরে ‘শুদ্ধ’ করে নেওয়া হবে!) লোকেদের এনে, সমান্তরাল নেতৃত্ব তৈরি করতে চাইছিলেন। মুখ পোড়ায় সুযোগটা দু–হাতে লুফে নিলেন দিলীপ ঘোষ।
কীরকম ‘শুদ্ধ’ এই দল? সিনেমা ও টেলিভিশনের একটু–চেনা কিছু শিল্পীকে দলে টানলেন দিলীপবাবুরা, দিল্লিতে। সর্বভারতীয় ব্যাপার তো! নামকরা শিল্পী চাই। মাধবী মুখার্জি ও বিপ্লব চ্যাটার্জির নাম ছড়ানো হল। মাধবী বললেন, দুঃস্থ শিল্পীদের সাহায্যে কিছু করা হবে, এ কথা তাঁকে বলা হয়, চশমা ছিল না কাছে, সই করে দেন। বিজেপি? মাধবী বললেন, না। মিথ্যা, মমতার প্রতি তাঁর আস্থা আছে। বিপ্লব বলে দিলেন, ‘বিজেপি–তে যাওয়ার প্রশ্নই নেই। বামপন্থী ছিলাম, আছি, থাকব।’ যাঁরা রইলেন, তাঁরা কারা? তৃণমূলের এক প্রাক্তন ছাত্রনেতা, যিনি অপসারিত। আরও কিছু। এঁদের ‘শুদ্ধ’ করে নেবে বিজেপি! নিজেরা ‘শুদ্ধ’ এই সার্টিফিকেট কোথায়?
‘শুদ্ধ’ দল গণতন্ত্রের কথা বলে। পঞ্চায়েত ভোটের কথা তুলে বলে, অনেক ক্ষেত্রেই প্রার্থী দিতে দেওয়া হয়নি। ৩৪ শতাংশ আসনে বিরোধী প্রার্থী ছিল না। এবার হিসেবটা দেখি। বিজেপি–শাসিত ৭ রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোটে ৫৭–৬৫ শতাংশ আসনে বিরোধী প্রার্থী ছিল না। সাম্প্রতিক উদাহরণ, ত্রিপুরা। পঞ্চায়েত ভোটে ৮৬ শতাংশ আসনে বিরোধী প্রার্থী নেই। ওঁরাই বলছেন ‘শুদ্ধ’ করে নেবেন!
শুধু রামে হবে না, দুর্গার খোঁজ পড়েছে, বাংলার মনীষীদের ডাক পড়েছে। কেন্দ্রীয় শিক্ষানীতির খসড়ায় রামমোহন, বিদ্যাসাগরের নাম নেই। বিবেকানন্দ ছিলেন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, অজস্র প্রমাণ আছে। তাঁকে ‘বিজেপি’ বানানো হচ্ছে। মনীষী ছিনতাই! চূড়ান্ত মিথ্যাচার। ওঁরাই নাকি অশুদ্ধদের এনে ‘শুদ্ধ’ করে নেবেন।
বিজেপি নেতারা বলছেন, বাংলায় শান্তি ‘ফিরিয়ে’ আনবেন। ভাটপাড়া দখল করে শান্তির বীভৎস নমুনা প্রকাশ করা হচ্ছে। পুলিশ শান্তি ফেরাতে সক্রিয়, বোমা–গুলি নিয়ে বিজেপি–র ‘শান্তি’ অভিযান। গণতন্ত্র, শান্তি, এমন কথা ওঁদের মুখেই মানায় বটে! কাদের আনা হল? কারা আনছেন? এর পরেও বলা হচ্ছে, ওঁরা ‘শুদ্ধ’ করে নেবেন! আয়নায় তাকালে নিজেরাই লজ্জা পাবেন। সুতরাং, আয়নার দিকে তাকাচ্ছেন না। আয়না সামনে রাখছেন না। ভগবানপুরে ২১ জুলাইয়ের প্রস্তুতি সভায় হামলা, আরও বহু জায়গায়। রাজ্যটাকে সাম্প্রদায়িকতা ও অশান্তিতে টালমাটাল করে দেওয়ার চক্রান্ত গোপন নেই। বাঙালিকে ভাগ করে দেওয়ার খেলায় মত্ত। যেমন নীতি, তেমন নেতা। ওঁরা নাকি ‘শুদ্ধ’ করে নেবেন!