Tollywood: ধূমপান নিষিদ্ধ! প্রদীপদার আফসোস, এভাবে কি বেঁচে থাকা যায়: টোটা

টোটা রায়চৌধুরী: প্রদীপ সরকার আমার প্রদীপদা।

আরও অনেকেরই অবশ্য। ওঁর সঙ্গে বহু বছরের হৃদ্যতা। ‘হৃদ্যতা’ শব্দটা বললেই প্রথম আলাপ মনে পড়ে যায়। ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘চোখের বালি’ মুক্তি পেয়েছে। আমার অভিনীত চরিত্র ‘বিহারী’ দর্শক-সমালোচকদের প্রশংসাধন্য। তখনই ফোনটা এল। প্রদীপ সরকার ফোন করে উচ্ছ্বসিত। প্রথম সম্বোধনেই ‘তুই’! আপ্লুত স্বরে বলেছিলেন, ‘‘তোর কাজ আমার ভীষণ ভাল লেগেছে। একদিন তোর সঙ্গে আমি কাজ করব, বুঝেছিস?’’ আমি স্তম্ভিত। তারপরেই একদিন ওঁর মুম্বইয়ের অফিসে ডাকলেন। গিয়েছিলাম। বিদ্যা বালন তখন ওঁর সহকারী। তারকা হননি। ফলে, ওঁকে চিনতাম না। চেনার কথাও নয়। কারণ, ‘পরিণীতা’ তৈরি হয়নি। যাই হোক, দাদা সবার সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিলেন।

 

আরও পড়ুন: Tollywood: শেষ শ্যুটেই দেখেছিলাম, প্রদীপদার কথা জড়িয়ে যাচ্ছে! হাঁটতেও পারছেন না: অম্বরীশ ভট্টাচার্য

এক বাঙালি বিজ্ঞাপনী ছবি করিয়ে। মু্ম্বইয়ে ওঁর দাপট দেখার মতো। ওঁকে ভাললাগার শুরু এই জায়গা থেকেই। বাঙালিয়ানায় ভরপুর এই মানুষটিকে মুম্বই শেষ দিন পর্যন্ত অবাঙালি করতে পারেনি। ওঁকে দেখলেই এক টুকরো উত্তর কলকাতা ভেসে উঠত। কথায়, আচরণে, হৃদ্যতায়, খাওয়াদাওয়ায় সেই ছায়া স্পষ্ট। বাংলা, বাঙালিকে প্রচণ্ড ভালবাসতেন। ‘ভালবাসতেন’ কথাটা উচ্চারণ করতে গিয়ে গলা কেঁপে যাচ্ছে। কাজপাগল মানুষ। সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকতেন। বলতেন, ‘‘চাইলে বছরে ৪০-৫০টা নানা স্বাদের বিজ্ঞাপনী ছবি বানিয়ে ফেলতে পারি!’’ ওঁর কাছে ছায়াছবি মানে দেড়-দু’বছর দিয়ে দেওয়া। সেই জন্যই সম্ভবত বিজ্ঞাপনী ছবির তুলনায় বড় পর্দার ছবি কম বানাতেন।

মুম্বইয়ে ওঁর কাজের ধারা, বিজ্ঞাপনী ছবি নিয়ে একটা কথা প্রচলিত আছে। প্রদীপ সরকারের আগে বিজ্ঞাপনী ছবি পাশ্চাত্য ঘেঁষা ছিল। দাদা এসে সেখানে বাঙালিয়ানা ছড়িয়ে দিয়েছেন। আগে পোশাক, ভঙ্গিমা, অনুভূতি— সবেতেই পশ্চিমের অন্ধ অনুসরণ। প্রদীপদা প্রথম দেখালেন, মডেল মানেই কন্দর্পকান্তি হতে হবে তেমনটা নয়। ইদানিং বিজ্ঞাপনী ছবিতে আমরা খুব সাধারণ, ঘরোয়া চেহারার মডেলদের দেখি। এটা কিন্তু প্রদীপদার দৌলতেই। বহু গুণী ব্যক্তিত্বের জন্ম দিয়েছেন দাদা।

‘হেলিকপ্টার ইলা’য় প্রদীপদা ডেকে কাজ দিয়েছিলেন। সেই যে কথা দিয়েছিলেন, একদিন আমার সঙ্গে কাজ করবেন! সেকথা রেখেছিলেন। আমি সেদিন মুম্বই থেকে পুণে যাচ্ছি। হাইওয়ে ধরে গাড়ি ছুটছে। দাদার ফোন এল, ‘‘কোথায়?’’ জানালাম কোথায়। জানতে চাইলেন, কবে ফিরছি। সব শুনে অনুরোধ করলেন, ফেরার পথে যেন ওঁর অফিস ঘুরে যাই। নতুন ছবি করছেন। সেখানে আমায় ভেবেছেন। খুব অবাক হয়েছিলাম। কেজো দুনিয়ায় কেউ কাউকে মনে রাখেন না। প্রদীপদাই ব্যতিক্রম। দেওয়া কথা রাখতে তিনি ঠিক আমায় মনে রেখেছিলেন।

ছবির সেটজুড়ে বাঙালির মেলা। আমি, ঋদ্ধি সেন, সিনেমাটোগ্রাফার শীর্ষ রায় বাঙালি। কাজল হাফ বাঙালি! সবাই মিলে সে কী মজা, হইহই, খাওয়াদাওয়া। দাদার সঙ্গে কাজ করতে করতে অবাঙালিরাও বাংল শিখে যেতেন। একমাত্র প্রদীপদার সেটে বাংলায় কথা হত। বড় বড় তারকাদের সঙ্গেও দাদা বাংলায় বলতেন। একে ‘দাদাগিরি’ ছাড়া আর কী বলা যায়? মু্ম্বইয়ে তাই ‘দাদা’ একমাত্র প্রদীপ সরকার। নিজের ঘরানা ধরে রাখার জন্য সবাই তাঁকে শ্রদ্ধাও করতেন। ছবির শেষে কাজল পর্যন্ত বলে ফেলেছিলেন, ‘‘এই ছবি করে আমার একটাই লাভ। বাংলাটা আবার সরগর হয় গেল।’’ খাওয়াদাওয়ার কথায় মন পড়ল, প্রদীপদার অনেক বাধা-নিষেধ ছিল। যেমন, তেল-মশলা তেওয়া খাবার, মিষ্টি, ধূমপান। বৌদি চোখের আড়াল হলেই দাদা এক ছুটে আড়ালে গিয়ে সুখটান দিয়ে আসতেন। আর আফসোস করে বলতেন, ''এভাবে কি বাঁচা যায়?''

খুব ইচ্ছে ছিল, করণ জোহরের ‘রকি ঔর রানি কি প্রেম কহানি’র ছবি-মুক্তির দিন প্রদীপদাকে আমন্ত্রণ জানাব। আমার কাজ দেখাব। সেটা আর হল না। আজ বড্ড মনে পড়ছে, শেষ দেখা হয়েছিল লকডাউনের আগে। বান্দ্রায় কাজ নিয়ে গিয়েছিলাম। যাঁদের কাছে গিয়েছিলাম তাঁদের অফিস বান্দ্রায়। হঠাৎ ফোন, ‘‘কী রে, আমার শহরে এসেছিস আর দেখা পর্যন্ত করছিস না?’’ অবাক হয়েছিলাম, কী করে দাদার কানে খবর গেল! সে কথা জানতে চাইতেই দাদার উত্তর, ‘‘ভুলে যাস না, তুই আমার পাড়ায় এসেছিস। কাজ শেষ হলেই চলে আসবি।’’ এরকম ভালবাসা, আন্তরিক মানুষের সংখ্যা এখন হাতেগোনা। প্রদীপদা চলে গেলেন। মুম্বইয়ে এমন আন্তরিক ভাবে আমায় আর কে ডাকবে?

 

আকর্ষণীয় খবর