অম্বরীশ ভট্টাচার্য: প্রদীপ সরকারের সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ ২০১৬-য়।
উনি আমায় চিনতেন না। কলকাতায় এসেছিলেন তাঁর একটা কাজে। যখন ফিরছিলেন তখনই বিমানবন্দরে যাওয়ার পথে বাইপাসে আমার একটা হোর্ডিং দেখেন। হোর্ডিংয়ে আমার ছবি দেখে ওঁর আগ্রহ জাগে। সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলে ছবিটা তুলে নিয়ে চলে যান। মুম্বই ফিরে দাদা ওঁর এক বাঙালি সহকারী শুভদীপকে আমার ছবি দেখান। শুভদীপ চিনতে পারেন। জানান, বাংলায় নিয়মিত অভিনয় করেন। শুনেই প্রদীপদার নির্দেশ, আমার নতুন বিজ্ঞাপনী ছবিতে ওঁকে আমার চাই। যোগাযোগ করে জানাও ওঁকে। সেই শুরু।
আরও পড়ুন: Bollywood: মাত্র ৬৭-তেই নিভল প্রদীপ! বলিউডে ‘বিনোদিনী’ অধরাই
প্রদীপদার ফোন আসতেই ভীষণ অবাক আমি। বিজ্ঞাপনী ছবির পরিচালক হিসেবে প্রচণ্ড নামডাক। মাসে ১২-১৫টি করে নানা ধরনের বিজ্ঞাপনী ছবি বানান। ওঁর পরিণীতা, লগা চুনরি মে দাগ দেখে ফেলেছি। দুর্দান্ত লেগেছে। অত বড় মাপের এক পরিচালকের তরফ থেকে ডাক পেয়ে স্বাভাবিক ভাবেই আমি একটু স্বন্ত্রস্ত। যাই হোক, দেখা করলাম। কথা হল। পরীক্ষা নিলেন। পাশ করে গেলাম। তারপরেই শ্যুটিংয়ের ডাক। মনে আছে, চণ্ডীগড়ে প্রথম কাজ করেছিলাম প্রদীপদার সঙ্গে। গত কয়েক বছরে ওঁর সঙ্গে কম করে ১৯টি বিজ্ঞাপনী ছবিতে কাজ করেছি। একটা সময় এমন হয়েছিল, প্রতি মাসে মুম্বই উড়ে যেতাম। বিজ্ঞাপনী ছবি শ্যুটের জন্য।
খুব ভালবাসতেন আমায়। পুরনো বাংলা গান গাইতে বলতেন। অখিলবন্ধু ঘোষ, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র গান শুনতেন আমার থেকে। ওঁর জন্য আমার জীবনে নতুন দিগন্ত খুলে গিয়েছিল। ওর দৌলতে মুম্বইকে চিনেছি। ওখানে কাজের অভিজ্ঞতা হয়েছে। বিজ্ঞাপনী ছবির দুনিয়ার দরজা খুলে গিয়েছিল। প্রদীপদা না থাকলে অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে শ্যুট করা হত না। বহু জাতীয় স্তরের বিজ্ঞাপনী ছবি আমার ঝুলিতে। তার নেপথ্যেও প্রদীপদা। খুবই মাটির মানুষ। আদ্যপান্ত বাঙালি। হিন্দি বলতেই পারতেন না! দেখেছি, বড় বড় তারকাদের সঙ্গেও উনি দিব্যি বাংলায় কথা বলতেন। বাংলা খাবার খেতে ভালবাসতেন। মনে আছে, একবার সেটে আমার আর ওঁর জন্য বাড়ি থেকে ইলিশ-পোস্ত করে নিয়ে এসেছিলেন। বৌদি রেঁধে নিয়ে এসেছিলেন। বিরতি হতেই আমরা ওঁর মেকআপ ভ্যানে বসে তারিয়ে তারিয়ে খেয়েছিলাম।
প্রদীপদা খুব যে অসুস্থ ছিলেন তা নয়। কিছু কিছু নিয়ম মানতে হত। উচ্চ রক্তচাপ, রক্তে চিনির মাত্রা বেশি থাকার জন্য। দাদা যদিও মোটেই কথা শুনতেন না। ধূমপানে নিষেধ ছিল। বাচ্চাদের মতো লুকিয়ে লুকিয়ে সুখটান দিতেন। তেল-ঝাল-মশলা দেওয়া খাবার নিষেধ। সেটাও ওঁর চাই। বৌদি নিজের সন্তানের মতো দাদাকে যত্ন করতেন। প্রদীপদার সঙ্গে শেষ কাজ বছরখানেক আগে। তখনই ওঁকে দেখে ভাল লাগেনি। সদ্য কোভিড থেকে ভুগে উঠেছেন। তার জেরেই শরীর-মনের জোর একেবারে ধূলিস্মাৎ। তখনই কথা জড়িয়ে গিয়েছে। ভাল করে কথা বলতে পারছেন না। ভাল করে দৃশ্য বোঝাতে পারছেন না। ওই বিজ্ঞাপনে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ও ছিলেন। দেখেছিলাম, ‘দাদা’র কাজ করতে বেশ অসুবিধে হচ্ছে। প্রদীপদার কথা বুঝতে পারছিলেন না। ভাল করে হাঁটতেও পারছিলেন না। দু’পাশে দু’জন সঙ্গী। তাঁরা ধরে ধরে নিয়ে যাচ্ছেন।
দাদাকে দেখে মনটা বেশ দমে গিয়েছিল। বৌদিও জানিয়েছিলেন, কোভিড প্রদীপ সরকারকে কাবু করেছে। গত এক বছর সে রকম ভাবে কাজ করেননি। তবে নিজেকে সারাক্ষণ ব্যস্ত রাখতেন। ফোন কথা হত। প্রদীপদার ফোন মানেই ভিডিয়ো কল! বক্তাকে না দেখে কথা বলতে পারতেন না। বৃহস্পতিবার রাতে হঠাৎই শরীরখারাপ। সোডিয়াম-পটাশিয়ামের মাত্রা কমে গিয়েছিল। বছর দুই আগেও একবার এরকমই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তখন অনেক দিন ভর্তি ছিলেন লীলাবতীতে। সে যাত্রায় চিকিৎসকেরা জিতে গিয়েছিলেন। এবার আর হল না। খারাপ খবরটা পেয়েই মনে হল, কত গান শোনানো বাকি থেকে গেল!